অবশেষে দেশের বিচার বিভাগে শুরু হতে যাচ্ছে ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম। আজ ৯ মে রাষ্ট্রপতি সাক্ষরিত ভার্চুয়াল কোর্ট নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
এরই মধ্যে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার জন্য একটি ওয়েভ পোর্টাল প্রস্তুত করা হয়েছে। আবেদন, শুনানি সবই হবে এ পোর্টালে। ইমেইলে শুনানির সময় ও ভিডিও কনফারেন্সের লিংক পাঠানো হবে আইনজীবীকে। এসএমএসে দেওয়া হবে অ্যালারট। নির্দিষ্ট সময়ে বিচারক সহ সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা যুক্ত হবে ভিডিও কনফারেন্সে। শুরুতে এ পদ্ধতিতে শুধু জামিন আবেদন দাখিল, শুনানি, ও বেইল বন্ড দাখিলের সুযোগ পাবেন আইনজীবীরা। পরে যুক্ত হতে পারে অন্যান্য বিষয়ও।
এদিকে গত বুধবার ভিডিও কনফারেন্সসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম চালানোর সুযোগ তৈরি করতে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে ২৬ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত ফুল কোর্ট সভায় ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর প্রয়োজনীয় আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় ভার্চুয়াল কোর্ট কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারিক সংস্কারসংক্রান্ত বিশেষ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি এ-সংক্রান্ত আইনি জটিলতাগুলো দূরীকরণে উদ্যোগ নেন।
মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদনের পর এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কভিড-১৯-এর কারণে সব জায়গায় আদালত চালানোর সুযোগ নেই। সংক্রমণের আশঙ্কায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যার যার অবস্থানে থেকে যেন বিচার করা যায়। বিচার কার্যক্রমের সুবিধার্থে ভিডিও কনফারেন্সসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম করার জন্য আইনি বিধান প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট মনে করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাদেশের খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে তাতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
কেমন হবে এই ভার্চুয়াল কোর্ট?
দেশে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম শুরু করতে সুপ্রিম কোর্টকে তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রজেক্ট। শুরুতে এ পদ্ধতির মাধ্যমে শুধু জামিন আবেদন ও বেইল বন্ড দাখিল করতে পারবেন আইনজীবীরা। এজন্য mycourt.judiciary.org.bd ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে সাইন আপ (নিজের প্রোফাইল তৈরি) করতে হবে সব আইনজীবীকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, সাইন আপ করার পর নিজের ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে ভার্চুয়াল কোর্ট পোর্টালে প্রবেশ করতে পারবেন আইনজীবীরা। পোর্টালে প্রবেশ করলেই জামিন আবেদন ও বেইল বন্ড দাখিল সংক্রান্ত দুটি ঘর আসবে। কোনো আইনজীবী জামিন আবেদন করতে হলে প্রথমে এ-সংক্রান্ত ঘরে প্রবেশ করে মূল জামিন আবেদন, ওকালতনামা ও সংযুক্ত নথিপত্র পৃথক তিন ধাপে আপলোড করবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার আবেদন ফি লাগবে না।
এই বিষয়ে আরও জানা যায়, আইনজীবীর আবেদন দাখিলের পর সংশ্লিষ্ট আদালতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করবেন। বিচারকের অনুমোদনসাপেক্ষে আইনজীবীর নির্ধারিত ইমেইলে পাঠানো হবে শুনানির সময় এবং একই ইমেইল বার্তায় ভিডিও কনফারেন্সের জন্য একটি লিঙ্ক প্রেরণ করা হবে আইনজীবীকে। নির্ধারিক সময়ে ওই লিঙ্কে প্রবেশ করে আইনজীবী বিচারকের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে নিজের আবেদনের বিষয়ে শুনানি করতে পারবেন। জামিন মঞ্জুরের পর একই পোর্টালেই বেইল বন্ড দাখিল করতে পারবেন আইনজীবীরা।
হাইকোর্ট রুলস সংশোধনে কমিটি গঠন :
ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম হাইকোর্ট রুলসে অন্তর্ভুক্ত করতে হাইকোর্ট রুলস সংশোধনে কমিটি গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুবকে সভাপতি করে ৫ সদস্যর এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি জে বি এম হাসান, বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান।
সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে গঠন করা এ কমিটি ইতোমধ্যে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুটি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ভার্চুয়াল কোর্টের নতুন এ কনসেপ্টকে বিচারকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে পরিচিত করানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে উচ্চ আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে মৌলিক অধিকার রক্ষায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। তাই ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম পরিচালনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে সহজে বিচার পাওয়ার পথকে কীভাবে সুগম করা যায় সে বিষয়ে বৈঠকে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
অধ্যাদেশ জারি:
আজ ৯ মে রাষ্ট্রপতি সাক্ষরিত ভার্চুয়াল কোর্ট নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে অধ্যাদেশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়। অধ্যাদেশের প্রথমেই বলা হয়েছে- ‘মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য গ্রহণ বা যুক্তিতর্ক গ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্ত বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রণীত অধ্যাদেশ’।
আইনজীবীর মন্তব্য:
ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর দাবীতে শুরু থেকে লেখালেখিতে সোচ্চার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম। দাবীর পূর্ণতার প্রেক্ষিতে উচ্ছ্বসিত এই আইনজীবী ল’ ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সরকারের যে প্রত্যয় তা এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরো একধাপ এগিয়ে গেল। দীর্ঘদিনের যে পুরাতন রেওয়াজ আদালতের তা থেকে কিছুটা মুক্ত হওয়া যাবে। বিচারপ্রার্থীরা এতে উপকৃত হবে বলেই মনে করি। তবে যে উপকারটা বেশি হবে সেটা হল এই করোনার মত ভয়াবহ মহামারীতে আদালতের দুয়ার কখনোই বন্ধ হবেনা। এই আদালত মাত্র শুরু ধীরে ধীরে আরো পাকাপোক্ত হবে। বিচারক,আইনজীবী আর বিচারপ্রার্থীরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তবে ভার্চুয়াল কোর্ট পুরোপুরি সফল হতে বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থার দ্রুতগতি এবং নিরবিচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সংযোগের বিষয়টিতেও সরকারের নজর দিতে হবে।’