মামলার বিচার (trial), বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণ (evidence) বা যুক্তিতর্ক গ্রহণ (argument) বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্তে বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
আইনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
৫টি ধারা সমৃদ্ধ সংক্ষিপ্ত এ আইনে ভিডিও কনফারেন্সিং সহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের বৈধতা দেয়া হয়েছে। প্রচলিত আইনে ভিডিও কনফারেন্সিং এবং অন্যান্য পদ্ধতিতে মামলা গ্রহণ, সাক্ষ্যগ্রহণ, জামিন কিংবা জামিন কার্যক্রম বাস্তবায়ন এগুলোর বিধান না থাকায় এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন এর মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম চলমান রাখা সহজ করা হয়েছে।
ধারা ১ অনুসারে এই অধ্যাদেশ “আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০” নামে অভিহিত হইবে এবং অবিলম্বে কার্যকর হইবে। যেহেতু সরকারি গেজেটে ৯ মে ২০২০ তারিখে এটি প্রকাশিত হয়েছে সেহেতু আজ থেকেই আইনটি কার্যকর হয়েছে।
ধারা ২ অনুসারে; উপধারা ১ এ আইন, আদালত, দেওয়ানী কার্যবিধি, ফৌজদারী কার্যবিধি ও ভার্চুয়াল উপস্থিতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কোন কিছু না থাকিলে এই অধ্যাদেশে “ভার্চুয়াল উপস্থিতি” বলতে বুঝাবে অডিও-ভিডিও বা অনুরূপ অন্য কোন ইলেকট্রনিক পদ্ধতির মাধ্যমে, কোন ব্যক্তির আদালতের বিচার বিভাগীয় কার্যধারায় উপস্থিত থাকা বা অংশগ্রহণ। উপধারা ২ অনুসারে এই অধ্যাদেশে ব্যবহৃত যে সকল শব্দ বা অভিব্যক্তির সংজ্ঞা এই অধ্যাদেশে প্রদান করা হয় নাই, সেই সকল শব্দ বা অভিব্যক্তি ফৌজদারী কার্যবিধি বা দেওয়ানী কার্যবিধিতে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সেই অর্থে প্রযোজ্য হইবে।
ধারা ৩ (১) অনুসারে এ আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। উপধারা ১ অনুসারে ফৌজদারী কার্যবিধি বা দেওয়ানী কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যেকোনো আদালত, এই অধ্যাদেশের ধারা ৫ এর অধীন জারিকৃত প্রাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে, অডিও-ভিডিও বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত ক্রমে যে কোন মামলার বিচার (trial), বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry) বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণ (evidence) বা যুক্তিতর্ক গ্রহণ (argument) বা আদেশ (order) বা রায় (judgment) প্রদান করিতে পারিবে।
উপধারা ১ এর অধীন অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানী কার্যবিধি অনুসরণ করিতে হইবে বলে উপধারা ২ বিবরণ দেয়।
ধারা ৪ অনুসারে ভার্চুয়াল উপস্থিতি সশরীরে আদালতে উপস্থিতি বলে গণ্য হবে। ধারা ৩ অনুযায়ী কোন ব্যক্তির ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা হইলে ফৌজদারী কার্যবিধি বা দেওয়ানী কার্যবিধি বা অন্য কোন আইনের অধীন আদালতে তাহার স্বশরীরে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতার শর্ত পূরণ হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।
ধারা ৫ অনুসারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টকে প্র্যাকটিস নির্দেশনা জারির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ধারা ৩ ও ৪ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা ক্ষেত্রমত হাইকোর্ট বিভাগ, সময় সময়, প্রাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) জারি করিতে পারিবে।
অধ্যাদেশের সুবিধাসমূহ:
১. এই অধ্যাদেশটি মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কে প্রাক্টিস নির্দেশনা জারির বৈধতা দিয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করার পথ সহজীকরণ হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিধি প্রণয়ন ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোন আইন সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লইয়া প্রত্যেক বিভাগের এবং অধস্তন যেকোন আদালতের রীতি ও পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিসমুহ প্রণয়ন করিতে পারিবেন। অনুচ্ছেদ ১১১ অনুসারে আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে।
২. অধ্যাদেশের ধারা ৩ ও ৪ অনুসারে অনলাইন আদালত ব্যবস্থায় আসামিকে জেলখানায় রেখে, আইনজীবী বাসায় থেকে এবং সাক্ষী কে অন্য জায়গায় রেখে ভিডিও কনফারেন্সিং এবং অন্যান্য ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে বিচারকার্য করা সম্ভব হবে।
অধ্যাদেশের চ্যালেঞ্জ সমূহ:
ভার্চুয়াল উপস্থিতি বা ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের স্বার্থে কিছু বিষয় বিবেচনায় নিলে সুফল আসতে পারে বলে এই লেখক মনে করে। আমাদের আদালত সমূহ প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর স্বল্পতায় এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আদালতের বিচারক বৃন্দ এবং আইনজীবীবৃন্দ উভয়ই ডিজিটাল লিটারেসির অভাবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় প্রয়োজন । ইন্টারনেটের ধীরগতির কিংবা সংযোগ বিচ্ছিন্নতা আদালতের কার্যক্রমে দেখা হতে পারে। তথ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চয়তা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা নানা অজুহাতে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে।
যাহোক, করোনাকালের একটি নতুন সংযোজন ভার্চুয়াল আদালত। ভার্চুয়াল আদালত ডিজিটাল বাংলাদেশে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। ধন্যবাদ জানাই সরকারকে সময় উপযোগী এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য।
লকডাউন এর কারণে বিচারপ্রার্থীরা যে বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন এবং মামলাজট বৃদ্ধি পাচ্ছিল একথা পরিস্কার। এ বিষয়ে সীমিতভাবে আদালত চালু করা কিংবা অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আদালত চালু করার বিষয়ে সামাজিক মাধ্যম, আইনি পোর্টাল, আইনজীবী সমিতি সমূহ এবং আড্ডায় আলোচনা-সমালোচনা চোখে পড়ার মতো। সুতরাং বিদ্যমান আইন গুলিকে সহজীকরণ করার স্বার্থে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে যা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী অধ্যাদেশ হিসেবে বিবেচিত হবে।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনী বিশ্লেষন ও শিক্ষামূলক লেখক এর ব্যক্তিগত অভিমত)
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সমন্বয়ক: বাংলাদেশ লিগ্যাল রাইটিং সোসাইটি
ইমেইল: bnm.mir@gmail.com