সাঈদ আহসান খালিদ:
বাংলাদেশের ‘ভিআইপি কালচার’- এই ভূখণ্ডে প্রায় দুশো বছরের দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের একটি মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকার ও সাংস্কৃতিক জের। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্ত- সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের সুবর্ণ জয়ন্তির শুভক্ষণে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশ ‘ভিআইপি’- নামের ঔপনিবেশিক অভিজাত-তন্ত্র থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে এখনো সমর্থ হল না। এটি অনস্বীকার্য যে, ‘ভিআইপি কালচার’-নামক এই বিষবৃক্ষের শেকড়ে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে এটির আইনিভিত্তি ও বৈধতা দান করেছে কতিপয় আইন, বিধি, প্রজ্ঞাপন ও প্রথা। উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ বাস্তবতায় এগুলিকে পুনঃনিরীক্ষণ ও পর্যালোচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার এবং এ সংক্রান্ত জনমনস্তত্ত্ব পরিবর্তনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।
ভিআইপি কে?
‘ভিআইপি’ এবং ‘ভিআইপি কালচার’- দুটো আদতে ভিন্ন। ‘ভিআইপি’ শব্দের কতেক আইনিভিত্তি থাকলেও ‘ভিআইপি কালচার’ মূলত আইনবহির্ভূত সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক আচরণের প্রকাশ। ভিআইপি (VIP) শব্দের ইংরেজি পূর্ণরূপ হচ্ছে- Very Important Person । VIP বা Very Important Person –এই শব্দগুলি প্রথমবারের মত বাংলাদেশের আইনে প্রবেশ করে সামরিক শাসকের হাত ধরে। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ Presidential Security Force Ordinance, 1986 শিরোনামে একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির শারীরিক নিরাপত্তাবিধানের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্সিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (PSF) গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে উক্ত অধ্যাদেশটি সংশোধন করে শিরোনাম দেওয়া হয়- The Special Security Force Ordinance, 1986 , উক্ত আইনের অধীনে গঠিত নিরাপত্তাবাহিনীর পরিবর্তিত নাম হয়- Special Security Force (SSF) । The Special Security Force Ordinance, 1986– এর ধারা-৮(১) অনুযায়ী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (SSF) এর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে- বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রির শারীরিক নিরাপত্তা প্রদান করা। VVIP শব্দটি সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও বুঝা যাচ্ছে- আইনানুযায়ী ‘ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট পার্সন’ বা VVIP হচ্ছেন- রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য আরো আছে স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট । এসএসএফ অধ্যাদেশের ধারা-৮(২) এ বলা হয়েছে- এসএসএফ বাংলাদেশের ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ তথা Very Important Person (VIP) কে-ও শারীরিক নিরাপত্তা (Physical Security) প্রদান করবে। প্রশ্ন হচ্ছে- কে এই Very Important Person (VIP) ?
একই আইনের ধারা- ২(ঘ) এই Very Important Person এর সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবেঃ
Very Important Person অর্থ- রাষ্ট্রের প্রধান বা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের সরকার প্রধান বা সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে VIP হিসেবে ঘোষিত অন্য যে কোন ব্যক্তি।
মোদ্দা কথা- এই আইনের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রি, বিদেশি সরকার প্রধান এবং সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা ভিআইপি ঘোষিত ব্যক্তি এসএসএফ এর মাধ্যমে শারীরিক নিরাপত্তা লাভ করবেন। সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে মোট কতজন ব্যক্তিকে এখন অব্দি এই আইনের আওতায় VIP মর্যাদা দেওয়া হয়েছে- সেই তথ্য অজানা।
ভিআইপিদের নিরাপত্তা প্রটোকলের নিমিত্তে বাংলাদেশের প্রশাসন একটি ‘নিরাপত্তা প্রটোকল রেড-বুক’ অনুসরণ করে থাকে। রেড-বুক অনুসারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রি ভিভিআইপি। ভিআইপি হলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, সিনিয়র সচিব, সচিব, তিনবাহিনী প্রধান ও পুলিশের প্রধান। মন্ত্রি বলতে পূর্ণমন্ত্রি, প্রতিমন্ত্রি, উপমন্ত্রি সবাইকে বোঝায়। বিচারপতি বলতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট দুই বিভাগের বিচারপতিদের বোঝায় আর সচিব বলতে বোঝায় সচিব পদমর্যাদার সবাইকে। তবে সরকার প্রয়োজন অনুয়ায়ী অন্য যে কাউকে ভিআইপি মর্যাদা দিতে পারে। বিধি অনুযায়ী ভিআইপি-রা সরকারি প্রটোকল, নিরাপত্তা, গার্ড, গানম্যান ও আবাসন পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশের আইনানুযায়ী VVIP ও VIP-র পরে আরেক শ্রেণি বিশেষ সুবিধা ও মর্যাদা পেয়ে থাকেন, তাঁরা হলেন- CIP অর্থাৎ, Commercially Important Person । দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বিধায় তাঁদেরকে এই ‘সিআইপি’ মর্যাদা দিয়ে থাকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৷
২০০৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জীবিত দুই কন্যা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯ প্রণীত হয় যেটির ধারা- ৪ এ বলা হয়েছে-
Special Security Force Ordinance, 1986 এর অধীন Very Important Person এর জন্য যেরূপ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে সেইরূপ নিরাপত্তা সরকার জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণকে আজীবন সর্বস্থানে প্রদান করবে।
একই আইনে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যগণ প্রত্যেকে সরকার কর্তৃক নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদিও প্রাপ্য হবেন। অর্থাৎ, এই আইনে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যগণ-কে VIP হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
বিমানবন্দরে ভিআইপি:
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘ভিভিআইপি লাউঞ্জ’ ও ‘ভিআইপি লাউঞ্জ’ ব্যবস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও রয়েছে সামরিক শাসকের হাত। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালের ৬ মার্চ তারিখে এক অফিস স্মারকের মাধ্যমে Instructions regarding use of the VVIP and VIP Lounges at the Hazrat Shahjalal International Airport, 1983 শিরোনামে বিমানবন্দরে ‘ভিভিআইপি লাউঞ্জ’ ও ‘ভিআইপি লাউঞ্জ’ সৃষ্টি করেন এবং এই লাউঞ্জ ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনার এনেক্সার-১ ও এনেক্সার-২ এ বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জ ও ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের প্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের তালিকা রয়েছে। প্রথম এনেক্সারে প্রাধিকারপ্রাপ্ত বাংলাদেশি এবং দ্বিতীয় এনেক্সারে প্রাধিকারপ্রাপ্ত বিদেশি ব্যক্তিদের তালিকা আছে। এনেক্সার-১ অনুসারে বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অধিকারী পাঁচ ক্যাটেগরির ভিভিআইপি ব্যক্তির মধ্যে সবার উপরে রয়েছেন- বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, তারপর যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রি, সংসদের স্পিকার। প্রধান বিচারপতি এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আছেন চতুর্থ অবস্থানে, ক্রমতালিকার পাঁচ নম্বরে অবস্থান করছেন ক্যাবিনেট মন্ত্রি, চিফ হুইপ, সংসদের ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা।
অন্যদিকে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোট ১৭ ক্যাটেগরির বিভিন্ন পদমর্যাদার ভিআইপি ব্যক্তিদের তালিকা রয়েছে। এই ক্রমতালিকার ১ নং এ আছেন ক্যাবিনেট মন্ত্রি নন কিন্তু মন্ত্রির পদমর্যাদায় আসীন- এমন ব্যক্তি আর ক্রমতালিকার সর্বনিম্ন ১৭ নং এ অবস্থান করছেন সরকারের প্রশাসনের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাবৃন্দ। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা ভিআইপি হিসেবে গণ্য হবেন।
সড়কে ভিআইপি:
প্রশাসনিক নিরাপত্তা প্রটোকল রেড-বুক এর বিধি অনুসারে শুধু ভিভিআইপি মুভমেন্ট অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রির চলাচলের সময় সড়কের একপাশ খালি করে চলাচলের বিধান আছে। ভিভিআইপিদের চলাচলের ১৫ মিনিট আগে থেকে নির্দিষ্ট সড়কটির এক পাশ ফাঁকা করে সেখানে সাধারণ যান চলাচল বন্ধ রাখার নিয়ম অনুসরণ করা হয়। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের চলাচলের ক্ষেত্রেও একই রীতি প্রযোজ্য। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনানুসারে ভিভিআইপি ব্যতীত সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে আর কোন ব্যক্তি এমনকি কোন ভিআইপি-র জন্যও রাস্তা ফাঁকা করে দেয়ার সুযোগ নেই। ভিআইপি-রা চলাচলের ক্ষেত্রে পুলিশি নিরাপত্তা, বডিগার্ড বা গানম্যান সুবিধা পেতে পারেন কিন্তু কোন অবস্থাতেই সড়ক বন্ধ করে অগ্রাধিকার চলাচল কিংবা সড়ক পরিবহন আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির এখতিয়ার তাঁরা রাখেন না। মোটাদাগে, বাংলাদেশের আইনানুযায়ী একজন ভিভিআইপি ও ভিআইপি-র আইনসম্মত প্রাধিকার ও প্রাপ্য সুবিধা এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকার কথা।
ভিআইপি কালচার ও ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী মানস:
আইনানুসারে ভিআইপি-র সংজ্ঞা এবং সুবিধার সীমারেখা সুনির্দিষ্ট। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য নিরাপত্তা বা তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি-বাড়ির ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জনগণের আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু বিপত্তি হয় যখন ‘ভিআইপি’ পরিচয় কালক্রমে ব্যক্তিসত্ত্বার আইনি পরিধি ছাপিয়ে, ভিআইপি-র জন্য আইন নির্ধারিত সুবিধার সীমারেখা অতিক্রম করে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তৃত হয়ে উঠে একটি ‘কালচার’ রূপে- ‘ভিআইপি কালচার’। ভিআইপি কালচার বর্তমানে অভিজাততন্ত্র, জনবিচ্ছিন্নতা,ক্ষমতাচর্চা, বৈষম্য, বর্ণবাদ আর জনদুর্ভোগের সমার্থক। বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট এই প্রজাতন্ত্রের সামান্য কর্মচারী থেকে জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার তুচ্ছ উচ্ছিষ্ট পাওয়া ব্যক্তিটাও এখানে ‘ভিআইপি’ নামের প্রভু হয়ে উঠতে চায়!
‘ভিআইপি কালচার’- বলতেই চোখে ভেসে উঠে এমন এক চিত্র যেখানে কেউ চাইলেই আইন ও রীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনায়াসে ক্ষমতার প্রদর্শনী করতে পারেন, যিনি রাস্তার উল্টো পথে সদর্পে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারেন, আইন যাকে ছুঁতে পারে না, যিনি জনগণের সাথে এক কাতারে দাঁড়াতে পারেন না, জনগণকে দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে রেখে যার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশ এর ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়, ভিআইপি মানে- নগর জীবনের কোন কষ্ট, যন্ত্রণা, যানজট, দূষণ, ধূলো, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অব্যবস্থা যাদের স্পর্শ করতে পারবে না। ভিআইপি কালচারে জনগণ থাকে অচ্ছুৎ, ভিআইপি-র থাকে আলাদা গাড়ি, গাড়িতে লালবাতির ঝলকানি, বাজে গগনবিদারী হাইড্রোলিক সাইরেন, থাকে চলাচলের রাস্তা থেকে জনসাধারণকে সরিয়ে দেওয়ার পুলিশি ব্যতিব্যস্ততা। ভিআইপিদের জন্য সবখানে থাকে বিশেষ সুবিধের ব্যবস্থা যাতে কোনরূপ কষ্টের সম্মুখীন হতে না হয়- বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনে ভিআইপি লাউঞ্জ, রেল কিংবা জাহাজের কামরায় ভিআইপি কেবিন, এমনকি ভিআইপি ওয়াশরুম অব্দি! এদেশে ভিআইপি-দের নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য সড়কে পৃথক লেন করার আনুষ্ঠানিক সরকারি প্রস্তাব আসে, বিমানবন্দরে নিরাপত্তা তল্লাশি থেকে ভিআইপিদের অব্যাহতির সুপারিশ উত্থাপিত হয়, মহামারীকালে ভিআইপিদের চিকিৎসার জন্য বিলাসবহুল চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের তোড়জোড় চলে।
এত সব আয়োজন বারংবার জনগণকে যেন মনে করিয়ে দেয়- তোমরা অচ্ছুৎ, হীন, অধস্তন; আমরা ভিআইপি- স্বতন্ত্র, অভিজাত এবং ঊর্ধ্বতন। ভিআইপি কালচার এর শেকড় প্রোথিত হয়ে আছে দুশো বছরের দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতায়, ভিআইপি কালচার ঔপনিবেশিক প্রভু আর দেশীয় প্রজার বর্ণবাদী সম্পর্কের আধুনিক রূপ। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- আমেরিকায় বর্ণবাদ প্রথার দিনগুলিতে রেস্টুরেন্টে সাঁটানো WHITE ONLY কিংবা অভিজাত ক্লাবের দরজায়- ‘কালো ও কুকুরদের প্রবেশ নিষেধ’- লেখা সেসব বর্ণবাদী নোটিশ। ‘ভিআইপি কালচার’ বর্তমানে একটি মনোবিকারের নাম, এক গভীর অসুখ।
ভিআইপি কালচার: সংবিধান ও আইনের আলোয়
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা বলছে-
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।
সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদ বলছে- ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হলো, তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দেশের নাগরিকদের সাথে শ্রেণি বৈষম্য করে ভিআইপি-দের জন্য আরাম আয়েসের ব্যবস্থা করার কথা কোথাও নেই। ১৯(১) অনুচ্ছেদ বলছে- সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ২৮(১) অনুচ্ছেদ বলছে- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।
সুতরাং, ভিআইপি কালচার বাংলাদেশের সংবিধানের চেতনা ও সাংবিধানিক বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন। একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে সংবিধানের কাস্টোডিয়ান- বাংলাদেশের উচ্চ আদালত এর সিদ্ধান্তেও। ২০১৯ সালে সরকারের এক যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি না ছাড়ায় তিতাস ঘোষ নামের এক অসুস্থ স্কুল ছাত্রকে জীবন দিতে হয় বিনা চিকিৎসায়। ‘ভিআইপি কালচার’ এর এটি এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ঘটনা গড়ায় উচ্চ আদালত অব্দি। এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মর্মে পর্যবেক্ষণ দেন যে, সরকারি কর্মকর্তারা ভিআইপি নন, তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মাত্র । আদালত আরও বলেন, ভিআইপি কারা সেটা আইনে বলা আছে। শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভিভিআইপি হিসেবে গণ্য, আর কেউ নয়।
বাংলাদেশে ভিআইপিদের নিরাপত্তা ও প্রটোকলের জন্য পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একটি বড় অংশকে প্রতিনিয়ত ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়, যোগান দিতে হয় অর্থ ও জনবল যা আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের নিয়মিত দায়িত্ব সম্পাদনে বড় অন্তরায়। গাড়িতে লালবাতি জ্বালিয়ে, কর্ণবিদারী সাইরেন বাজিয়ে, রাস্তা থেকে সাধারণ মানুষ ও যান হটিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলাচলের ‘ভিআইপি কালচার’- নিঃসন্দেহে বেআইনি এবং একটি গণ-উৎপাত (Public Nuisance)। এটি অসভ্যতা। যে কোন সভ্য সমাজে এই ধরণের প্রাধিকারমূলক গাড়ি চলাচল করতে পারে শুধু দুর্যোগকালীন জরুরি সেবা সরবরাহের কাজে। প্রতিবেশী ভারত ২০১৭ সালের ১ মে থেকে ভিভিআইপি ও ভিআইপিদের গাড়িতে লালবাতি ও সাইরেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্তের আওতায় রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বা লোকসভার স্পিকারও পড়ছেন। অর্থাৎ পয়লা মে থেকে গোটা ভারতে এমন একজনও আর নেই, যিনি তাঁর সরকারি গাড়িতে লাল আলো জ্বালিয়ে ও সাইরেন বাজিয়ে চলাফেরার যোগ্য। শুধু জরুরি সেবায় নিয়োজিত গাড়িতে নীলবাতি ব্যবহার করা যাবে।
ভিআইপি কালচার অসাংবিধানিক, বেআইনি, অগণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। স্বাধীন দেশে ভিআইপি ব্যবস্থা থাকবে কিনা সেটির পুনর্মূল্যায়ন জরুরি, এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন সময়ের দাবি। ভিআইপিদের গাড়িতে গণবিরক্তি সৃষ্টিকারী লালবাতি ও সাইরেন বাজানো নিষিদ্ধ করা হোক। জনমানসে ভিআইপি কালচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্ফূরণ উঠুক। বাংলাদেশ হোক এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে VIP এর পরিবর্তে থাকবে EPI অর্থাৎ, Every Person Important ।
লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।