সাঈদ আহসান খালিদ:
সম্বোধনের এমন মাহাত্ম্য প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে পৃথিবীর অন্য কোথাও দৃশ্যমান হয় না। প্রজাতন্ত্রের সরকারি কর্মচারী কর্তৃক জনগণের মুখ দিয়ে ‘স্যার’, ‘মেম’, ‘সাহেব’ কিংবা বিচারালয়ে বিচারককে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধনে প্রকট হয়ে উঠে কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের উত্তর-উপনিবেশী আকাঙ্ক্ষা। বাংলাদেশের আইন-আচার ও বিচারে এসব সম্বোধন কীভাবে এবং কেন অনুষজ্ঞ হয়ে উঠলো- সেটির হদিস অনুসন্ধান জরুরি।
স্যার:
‘স্যার’ (Sir) শব্দটি ইংরেজি হলেও এটির উৎপত্তি মধ্যযুগের ফরাসি দেশে ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘স্যায়ার’ (Sire) থেকে, সেখানে জমিদার বা সামন্ত প্রভুদের প্রজারা সম্বোধন করত ‘স্যায়ার’ বলে। Are We Still Slaves?– শিরোনামের এক নিবন্ধে ভারতীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক উদয়লাল পাই দাবি করেছেন, ফরাসি দেশে সামন্তযুগে SIR শব্দ দ্বারা বুঝানো হত- Slave I Remain, আর ইংল্যান্ডে রাজকীয় নাইট উপাধিপ্রাপ্তদের নামের আগে ব্যবহৃত SIR শব্দ দ্বারা নির্দেশ করে- Servant I Remain. SIR শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে ১২৯৭ সাল থেকে যখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ‘নাইট’ উপাধিপ্রাপ্তদের নামের পূর্বে ‘স্যার’ যুক্ত করা শুরু হয়। কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আভিজাত্য বুঝাতে বঙ্গদেশে SIR শব্দের প্রচলন শুরু হয় ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকে। ইংরেজরা আসার পর দিশি জনগণ কর্তৃক প্রশাসনিক কর্তাদের ‘স্যার’ হিসেবে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু হয় মূলত শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও প্রভুত্ব স্বীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। ইংরেজ কর্তাকে দিশি প্রজা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলেও ইংরেজরা নিজেরা ঊর্ধ্বতন বাঙালিদেরকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করতে পছন্দ করতেন। বাঙালিরাও বাঙালিদের পরস্পরকে ‘বাবু’ই বলতেন।
বর্তমানে ‘স্যার’ শব্দের সবচেয়ে বহুল ব্যবহার দেখা যায় শিক্ষাঙ্গনে। সেখানে অবশ্য এখন এটি প্রভুত্ব বুঝানোর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় সম্মানার্থে। বাংলায় স্যারের পরিবর্তে আগে শিক্ষক-কে সম্বোধনে ‘মাস্টারমশাই’, ‘পণ্ডিতমশাই’ প্রভৃতি সম্বোধন চালু ছিল যার ব্যবহার এখন প্রায় অচল। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় সম্বোধনের ক্ষেত্রে পুরুষ শিক্ষক-কে ‘স্যার’ এবং নারী শিক্ষক-কে ‘মিস’ (Miss) ডাকা বহুল প্রচলিত যেটি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় এদেশেও আত্মীকরণ হয়েছে। ফলে কোন স্কুলের প্রধান পুরুষ হলে ‘হেড-মাস্টার’ বা ‘হেড-স্যার’ এবং নারী প্রধান হলে তাঁকে ‘হেড-মিস্ট্রেস’ (Head- mistress) ডাকতে আমরা অভ্যস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও আপত্তি রয়েছে। ইংরেজি Master শব্দ এক অর্থে প্রভু বুঝায় এবং Mistress শব্দ পৃথিবীর অনেক স্থানে উপ-পত্নী বা রক্ষিতাও বুঝিয়ে থাকে। আমেরিকা ও ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে বর্তমানে শিক্ষককে ‘স্যার’, বা ‘মিস’ ডাকার পরিবর্তে ‘প্রফেসর’, ড. , কিংবা নাম ধরে ডাকার চল রয়েছে।
সাহেব/সায়েব:
সাহেব শব্দটি আরবি সাহাবী শব্দ থেকে এসেছে, একবচনে এটি সাহাবী এবং বহুবচন বুঝাতে সাহাব ও আসহাব শব্দ ব্যবহৃত হয়। আরবি ভাষার অর্থে এটি দ্বারা সঙ্গি, সাথী, সহচর কিংবা বন্ধুকে বুঝায়। ইসলামে সাহাবা শব্দ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মহান সঙ্গি-সাথীদেরকে বুঝানো হয়। ইরানিরা যখন এল ভারতে তখন নিয়ে এল সাহিব । ইংরেজরা এদেশে আসার পর সেই সাহিব হয়ে গেল সাহেব বা সায়েব এবং তখন তা সঙ্গি হিসেবে নয় ‘কর্তা’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল। ব্রিটিশ ও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় নারীরা হলেন মেমসাহেব, বাঙালি বিবাহিত মহিলারা পরিচিত হলেন- বেগম সাহেব শব্দে। মুনতাসীর মামুন তাঁর ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন (২০১৫)– গ্রন্থে লিখেছেন, এই সাহেব, মেমসাহেব বা বেগম সাহেব শব্দসমূহ ইংরেজ আমল হতে কর্তৃত্ব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে অথচ ১৮৬৯ সালের আগে কর্তৃত্বপ্রকাশক সম্বোধন অর্থে এই শব্দের ব্যবহার আমাদের দেশে ছিল না।
প্রশান্ত ত্রিপুরা তাঁর ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ (২০২০) গ্রন্থে প্রশ্ন রেখেছেন-
ব্রিটিশরা বহু দশক ধরে এই উপমহাদেশে আর সশরীরে না থাকলেও তাঁদের বদলে এখন যাদের বেলায় ‘সাহেব’ সম্বোধন প্রয়োগ করা হয়, যাদের অনেকের পেশাগত পরিচয়েও ব্রিটিশদের বা ইংরেজি ভাষার ছায়া লেগে আছে- মাস্টার, ডাক্তার, হেডম্যান, চেয়ারম্যান, জজ, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, ডিসি, ওসি, এমপি, প্রফেসর-তাদের চলন-বলন-মননেও কি ঔপনিবেশিক সাহেবিয়ানা দেখা যায় না? সেই সাহেবিয়ানার কতটা অসচেতনভাবে চলছে, আর কতটা চর্চিত হচ্ছে সচেতনভাবে?
ম্যাডাম/ মেম /মেমসাহেব:
ইংরেজি Madam শব্দটিও ফ্রেঞ্চ Madame থেকে এসেছে যেটির সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে মেম (Ma’am) শব্দও ব্যবহৃত হয়, ইংরেজিতে অর্থ- My Lady । ‘ম্যাডাম’ বা ‘মেম’ শব্দদুটি সাধারণত কোন ভদ্রমহিলাকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বা সহকর্মী কর্তৃক কোন নারী শিক্ষক-কে সম্মানার্থ সম্বোধনের ক্ষেত্রেও এই দুই শব্দের প্রচলন বেশ জনপ্রিয়। কিন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ‘মেম’ শব্দ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার যেটি দিয়ে শ্বেতাঙ্গী, অভিজাত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় নারীদের বুঝানো হত। লেখক নিখিল সুর এর সায়েবমেম সমাচার (২০১৯) গ্রন্থ হতে জানা যায়, শ্বেতাঙ্গিনীদের ‘মেমসায়েব’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ ভারতীয়দের মধ্যে চালু থাকলেও, বস্তুত শ্বেতাঙ্গিনীরা শুধুই ‘মেম’। তাঁর মতে, পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে ১৭৫৬ সালে সারা বাংলায় ‘মেম’ এর সংখ্যা ছিল ৮০ জন যদিও ভারতে ব্রিটিশ রানির শাসন কায়েম পরবর্তী সময়ে এদেশে মেমসায়েব আগমনের বান নেমেছিল। ভারতে আগত এই বিলেতি মেমদের অধিকাংশের জীবন ছিল ভোগ-বিলাস, আভিজাত্য, অহংকার, দিশি মানুষ ও সংস্কৃতির প্রতি বিরক্তি এবং এদেশীয় গৃহভৃত্যদের প্রতি অবিচার ও শ্রেণিবিদ্বেষে পূর্ণ। ‘মেমসায়েব’ শব্দের মধ্যে লুকায়িত ছিল প্রভু আর ভৃত্যের সম্পর্কের স্বরূপ। আদনান সৈয়দ এর লেখা ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা (২০১৬)– বই থেকে ভারতে আগত বিলাতি নারীদের মেমসাহেবি জীবন যাপন, তাদের মানসিকতা, প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে এবং সর্বোপরি তাদের গৃহস্থ জীবনের খুটিনাটি দিকসম্বন্ধে জানা যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছে কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও ঊর্ধ্বতন সরকারি নারী কর্মচারী কর্তৃক জনগণের মুখ হতে ম্যাডাম/মেম শুনার সংস্কৃতির অবসান হয়নি, ম্যাডাম/মেম না ডাকলে তাদের অনেকে রুষ্ট ও কুপিত হন, এমনকি শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন বলে প্রায়ই খবর পাওয়া যায়।
মাই লর্ড /মি লর্ড/ ইয়োর লর্ডশিপ:
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ তৈরির গোড়া থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সর্বত্রজুড়ে যে শব্দগুলো সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে মাই লর্ড একটি। প্রায় দুশো বছর ধরে উপনিবেশিত ভারতীয় প্রজারা মাই লর্ড বলে তারস্বরে ডেকেছেন প্রভু হয়ে জেঁকে বসা শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের সম্বোধন করতে গিয়ে- প্রজার নিঃশর্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পন প্রকাশের চিহ্নস্বরূপ। Lord শব্দটি প্রাচীন ইংরেজি শব্দ Loaf-ward থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে যেখানে প্রাচীন সামন্তযুগে Loaf অর্থ রুটি এবং Ward শব্দটি রক্ষাকর্তা অর্থে ব্যবহৃত। এই Loaf-ward শব্দ আদতে জার্মানির আদিবাসী সমাজের এমন সামন্ত সর্দারকে বোঝাত যে তার দাস ও অনুচরদের রক্ষণাবেক্ষণ ও খাদ্য যোগান দিত। যুক্তরাজ্যে এলিট সমাজের সদস্য ‘ব্যারন (Barron)’কে সাধারণত Lord নামে ডাকা হয়। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ‘হাউজ অব লর্ডস’ এর সদস্যরা ‘লর্ড’ নামে পরিচিত। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত হাউজ অব লর্ডস-এ যেসব বিচারক বসে বিচারকাজ করতেন তাদেরকে বলা হত- Law Lords. ইংল্যান্ডের কোর্ট অব আপিলের বিচারকবৃন্দ Lord Justice নামে সম্বোধিত হন। বিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ অব্দি ইংল্যান্ডের ব্যারিস্টাররা ব্রিটিশ আদালতে বিচারকদেরকে Milord (মি লর্ড) নামে সম্বোধন করতেন তবে পরবর্তীতে ‘মি লর্ড’ এর বদলে ‘মাই লর্ড’ জায়গা করে নেয়।
বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সাথে সাথে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে এই ‘লর্ড’ শব্দও এখানে আমদানি হয় যেটি দিয়ে ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ প্রশাসককে সম্বোধন করা হত, পরবর্তীতে আদালতের শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ বিচারকেরাও সম্বোধনের ক্ষেত্রে মাই লর্ড, মি লর্ড বা ইয়ুর লর্ডশিপ সম্বোধনের আওতায় আসেন। আদালতের আচার ও আনুষ্ঠানিকতায় এই ‘লর্ড’ যুক্ত হওয়ার পেছনে বাংলার প্রজাদের উপর ব্রিটিশ শাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাই যে মূল উদ্দেশ্য ছিল- তা বলা বাহুল্য। বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের বিচারকবৃন্দকে আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীরা এখন আর ‘মাই লর্ড’ ডাকেন না, সম্মানার্থে বিজ্ঞ আদালত, Your Honour, বা Sir নামে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দকে বাংলাদেশে এখনো মাই লর্ড, মি লর্ড বা ইয়ুর লর্ডশিপ সম্বোধনে ডাকা হয়। প্রশ্ন হতে পারে- বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দকে এরূপ সম্বোধন করা কি আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীর জন্য আইনগতভাবে বাধ্যকরী কোন বিধান কিনা?
বাংলাদেশের আইনজীবীদের পেশাগত শৃংখলা ও আচরন নিয়ন্ত্রণকারী আইন Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order and Rules, 1972 এবং Canons of Professional Conduct and Etiquette এর কোথাও এমন কোন বিধান নেই। অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত আইন- The Civil Rules and Orders (CRO) এর ৮২৫ ও ৮২৬ বিধিতে আইনজীবীদের নির্দিষ্ট পোশাক-পরিচ্ছেদের জন্য আইনগত বাধ্যকরী নির্দেশনা থাকলেও সম্বোধনের ক্ষেত্রে My Lord, MiLord, বা Your Lordship বলার কোন আইনগত বিধান নেই। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত আইন – The Supreme Court (High Court Division) Rules, 1973 সংশোধন করে এই আইনে Chapter XVIA সংযুক্ত করা হয়েছে যেটির ১(৩) বিধিতে আদালতে পালনীয় ডেকোরাম এর মধ্যে বিচারককে সম্বোধনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিধান অনুসরণের কথা লেখা আছে-
Advocates or any other person addressing the Court must do so with utmost respect to the Court and in a disciplined manner maintaining the tradition so long prevailing and mode of address to the judge shall be the same irrespective of gender of the Judge.
অর্থাৎ, এখানে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারকদেরকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে সম্মান প্রদর্শনমূলক সম্বোধনের কথা বলা হয়েছে কিন্তু ‘মাই লর্ড’ বলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এখন, ‘প্রচলিত দীর্ঘ ঐতিহ্য’ বলতে কি পাকিস্তান যুগ অতিক্রম করে ব্রিটিশ উপনিবেশিত সমাজের প্রচলিত লর্ড ডাকা বুঝাবে কিনা সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। ১৯৮৮ সালে প্রণীত The Supreme Court (Appellate Division) Rules ও এই বিষয়ে চুপ। মোটাদাগে, এটি বোধগম্য যে, কোন বিচারক-কে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন বাংলাদেশের প্রচলিত আইনানুসারে বাধ্যকরী কোন বিধান নয়, এটি স্রেফ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রথা, ব্রিটিশদের প্রভুত্ব ও বাঙালির দাসত্বের ধ্বংসাবশেষ চিহ্ন।
প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র- যার সাথে আমরা একত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশ এর অংশীদার ছিলাম, সেই ভারত কিন্তু বিচারকদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে এসব ‘মাই লর্ড’, ‘মি লর্ড’-কে ঔপনিবেশিক দাসত্বের চিহ্ন গণ্যপূর্বক আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার ক্রমাগত উদ্যোগ নিয়েছে, নিচ্ছে। ভারতের আইনজীবীদের প্রতিবাদ ও দাবির প্রেক্ষিতে প্রথম উদ্যোগটি আসে- ভারতের বার কাউন্সিলের হাত ধরে। ২০০৬ সালে এক ঐতিহাসিক রেজুলেশন (Res. No. 58/2006) এর মাধ্যমে ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৬১ – এর অধীনে Bar Council of India Rules সংশোধন করে সিদ্ধান্ত নেয়- এখন থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারকদেরকে আইনজীবীরা Your Honour বা Hon’ble Court বলে সম্বোধন করবে, আর অধস্তন আদালতের বিচারকদেরকে ‘স্যার’ অথবা সমজাতীয় আঞ্চলিক সম্মানসূচক সম্বোধন করা হবে। ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে কেরালা হাইকোর্ট অ্যাডভোকেট এসোসিয়েশন এবং ২০১১ সালে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট বার সমিতিও বিচারকদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০১৯ সালে ভারতের রাজস্থান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রবীন্দ্র ভট্টের নেতৃত্বে সর্বসম্মতিক্রমে এক আদেশে বিচারকদেরকে ‘মাই লর্ড’ ও ‘ইয়োর লর্ডশিপ’ সম্বোধন ‘ঔপনিবেশিক দাসত্বের স্মৃতি’ গণ্য করে এটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আদেশে বলা হয়েছে, বিচারকদের সম্মানসূচক অন্য যে কোন সম্বোধন যেমন- Sir বা Your Honour বলা যাবে। বিচারকদের নামের পূর্বে এসব ঔপনিবেশিক সম্বোধন নিরুৎসাহিত করার এমন বিচারিক সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত ভারতে এটিই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে এক জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, বিচারপতিদের সম্মান জানানোটা জরুরি হলেও সেজন্য তাদের ‘মাই লর্ড’ বা ‘ইয়োর লর্ডশিপ’ বলে সম্বোধন করাটা বাধ্যতামূলক নয়। অন্যান্য দেশে বিচারক-কে সম্বোধনের ক্ষেত্রেও ও প্রায় একই রীতি। ইটালিতে বিচারককে সম্বোধন করা হয়- Mr President of the Court, স্পেনে ডাকা হয়-Your Honour, জার্মানিতে বলা হয়- Mister Chairman, নারী বিচারকদের ক্ষেত্রে Madam Chairwoman এবং যুক্তরাষ্ট্রে Justice অথবা Judge সম্বোধনের পর ব্যক্তির নাম যুক্ত হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত গিয়েছে ঢের আগে, পাকিস্তানের উপনিবেশিকতা থেকেও মুক্তি এসেছে- তাও প্রায় অর্ধ শতক তবু স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সত্ত্বা নিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ঔপনিবেশিক প্রেতাত্মা আজো ভর করে আছে, নানারূপে- সম্বোধন তার একটি।
লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।