ব্যারিস্টার নেওয়াজ মোরশেদ:
বাংলাদেশে প্রথম বারের মত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে শুরু হয়েছে আদালতের বিচার কার্যক্রম। মহামান্য রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশ যা আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ (অধ্যাদেশ নং- ০১, ২০২০) মোতাবেক আদালত করোনা প্রাদুর্ভাব এর কারনে সরকার কর্তৃক সাধারন ছুটি ঘোষনার ফলে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সকল প্রকার আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখার আদেশ দেন।
যার ফলে রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি শাখার একটি বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে যায়, বাধাগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার। স্বল্প আকারে আদালত কার্যক্রম চালু করার আদেশও সাধারণ আইনজীবীদের দাবির মুখে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিগত ২৬ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত ফুলকোর্ট সভায় ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর প্রয়োজনীয় আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির উক্ত অধ্যাদেশ জারি করেন আদালতের কার্যক্রম সশরীরে উপস্থিত না থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিচালনা করার জন্য, যা মূলত ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ (অধ্যাদেশ নং- ০১, ২০২০) এর ৫ ধারায় সুপ্রীম কোর্ট কে প্র্যাকটিস নির্দেশনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সে মোতাবেক সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের স্বাক্ষরিত আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ ও নিম্ন আদালতের জন্য পৃথক ৩টি প্রাকটিস ডিরেকশন বা নির্দেশনা জারি করা হয় বিগত ১০ মে ২০২০ তারিখে।
নতুন প্রণীত এই ভার্চুয়াল কোর্ট ব্যবস্থায় কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমি একজন আইনজীবী হিসেবে এই পদ্ধতিকে স্বাগত জানাই এবং এর সাফল্য কামনা করি। আমি মনে করে বাংলাদেশ অনেক দেরীতে হলেও নতুন এক যুগে প্রবেশ করলো।
এর মাধ্যমে কাগজ বিহীন বা paperless বিচার ব্যবস্থা বা E-Judiciary এর পথ উন্মোচিত হলো। আমার মতে সরকার যদি নিম্নোক্ত কয়েকটি উদ্যোগ নেন, তাহলে এই পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ কার্যকরী এবং জনপ্রিয় করা সম্ভব যা উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর জন্য সময়ের দাবি-
১. আদালতের প্রত্যেকটি কাজে A4 সাদা কাগজ ব্যবহার করতে হবে, স্ক্যানিং এর সুবিধার জন্য এবং মত দ্রুত সম্ভব সবই সফ্ট কপিতে রূপান্তরিত করতে হবে।
২. সেন্ট্রালাইজড মামলা দায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বা কোন পিটিশন দায়েরের আগে উক্ত আদালতে যথার্থ কোর্ট ফি অনলাইনে প্রদান করার পর মামলা নম্বর আইনজীবী কে দেয়া হবে এবং শুনানির তারিখ এবং সময় উল্লেখ করে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে বার এবং সরকারের ফি একই সময়ে প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. ডিজিটাল স্বাক্ষর প্রচলন শুরু করতে হবে।
৪. ওকালতনামায় স্বাক্ষর এর ক্ষেত্রে আধুনিকতা আনতে হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কারা কর্তৃপক্ষ আসামির স্বাক্ষর সহ একটি সহজ ক্ষমতা আইনজীবীর নাম এবং মেম্বারশিপ নম্বর অনুযায়ী স্ক্যান করে বারে পাঠাবে। বার সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপযুক্ত টাকা পাওয়ার পর আইনজীবীকে ই-মেইল করবে।
৫. আদালতে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি ফরম আদালতের নিজস্ব ওয়েভসাইটে থাকবে। উপযুক্ত ফি প্রদান করে তা ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে বেইলবন্ড নিয়ে আর ঝামেলা হবে না। সঙ্গে জামিনদারের জাতীয় পরিচয় পত্র স্ক্যান করে আদালতে জমা দিলে আরো অথেনটিক হবে।
৬. সার্টিভাইড কপির জন্য নথি যে আদালতে রক্ষিত সেই আদালতে আবেদন করতে হবে, আদালত সার্টিভাইড কপি ই-মেইলে আইনজীবী কে পাঠাবেন। এবং এর জন্য আদালতের প্রত্যেকটি কাগজ টাইপ থাকতে হবে। এফআইআর, এজাহার, চার্জশিট সবকিছুই। তাহলে প্রক্রিয়াটি সহজ হবে।
৭. আদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে বাধ্যতামূলক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। No training No Hearing আইনজীবীদের ক্ষেত্রে।
৮. প্রত্যেকটি আদালতকে এর আয়তায় আনতে হবে।
৯. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হচ্ছে নিজস্ব সফটওয়্যার, যেটি কিনা হাইলি সিকিউরড হবে। তৃতীয় পক্ষ কোন প্লাটফর্ম ব্যবহার করলে মামলার কনফিডেনশিয়ালিটি ব্যহত হবে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোন সফটওয়্যার কোম্পানিকে দায়িত্ব দিতে হবে।
অন্যদিকে ভার্চুয়াল কোর্ট নিয়ে ইতোমধ্যেই আইনজীবী মহলে একটা নেতিবাচক ধারনা কাজ করছে। বিভিন্ন জেলার আইনজীবী সমিতি ভার্চুয়াল কোর্ট বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকেই এটাকে ভার্চুয়াল কোর্ট না বলে প্রিভিলিজড কোর্ট বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ মন্তব্য প্রদান করছেন। এই পদ্ধতি শুধু করোনা প্রাদুর্ভাব এর জন্য মনে না করে ভবিষ্যতের একটি সুন্দর পরিপাটি E-Judiciary এর জন্য আসুন বিরোধীতা না করে একটি ভালো উদ্যোগ কে স্বাগত জানাই।
লেখক- আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।