চন্দন কান্তি নাথ:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুব ভালো বাসতেন। তাঁর জন্ম দিনকে শিশু দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। রবীন্দ্র নাথ বলেছেন ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে। শিশুদের শিক্ষার জন্যে বঙ্গবন্ধু হাজার হাজার প্রাইমারী স্কুল সরকারি করেছেন। সংবিধানে শিশুদের জন্যে বিধান রেখেছেন। ১৯৭৪ সনে আইন করেছেন। তাঁরই যোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ২৫ ০০০ হাজার প্রাইমারী স্কুল সরকারি করেছেন। মেয়ে শিশুর জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছেন। প্রতি বছর কোটি বই শিশুদের বিতরণ করেন। নতুন বই এর গন্ধে আর শিশুদের কলকাকলিতে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস আনন্দে মৌ মৌ করে। আবার তিনিই তাদের জন্যে করেছেন শিশু আইন, ২০১৩। উক্ত আইনে একজন সিনিয়র বিচারক তথা জেলা জজ কে রাখা হয়েছে যাতে শিশুর বিষয়টি বিশেষ ভাবে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সংবিধানে প্রস্তাবনা তে মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত হবে বলা আছে। অনুচ্ছেদ ১৭ তে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের কথা আছে। অনুচ্ছেদ ২৮ (৪) এ আছে,” নারী বা শিশুদের অনুকূলে বিধান করা হবে। সে মোতাবেক শিশু আইন, ২০১৩ হয়। সঙ্গে সঙ্গে Children Act, 1974 বাতিল হয়। শিশুর নানা চাহিদা, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি নিয়ে রয়েছে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ ১৯৮৯। জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৯১টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। প্রথম যে সব দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। আমাদের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে আছে, “…. আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা-এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র….”
আবার আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের ৫৪টি ধারায় শিশু কল্যাণ নিশ্চিত করাসহ সকল প্রকার শোষণ, বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে তাদের মুক্তির বিবরণ রয়েছে। সনদে স্বীকৃত অধিকারের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও মা-বাবার সর্ম্পকে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, নাগরিক অধিকার, শিশু শোষন এবং আইনের সাথে বিরোধ জড়িত শিশুসহ অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উক্ত সনদ এর প্রস্তাবনাতে আছে,
“Bearing in mind that the need to extend particular care to the child has been stated……. and recognized in the Universal Declaration of Human Rights, in the International Covenant on Civil and Political Rights (in particular in articles 23 and 24), in the International Covenant on Economic, Social and Cultural Rights (in particular in article 10) and in the statutes and relevant instruments of specialized agencies and international organizations concerned with the welfare of children,
Bearing in mind that, as indicated in the Declaration of the Rights of the Child, “the child, by reason of his physical and mental immaturity, needs special safeguards and care, including appropriate legal protection, before as well as after birth” অনুচ্ছেদ ৪০ এ আছে,
“1. States Parties recognize the right of every child alleged as, accused of, or recognized as having infringed the penal law to be treated in a manner consistent with the promotion of the child’s sense of dignity and worth, which reinforces the child’s respect for the human rights and fundamental freedoms of others and which takes into account the child’s age and the desirability of promoting the child’s reintegration and the child’s assuming a constructive role in society.
2. To this end, and having regard to the relevant provisions of international instruments, States Parties shall, in particular, ensure that:(a) No child shall be alleged as, be accused of, or recognized as having infringed the penal law by reason of acts or omissions that were not prohibited by national or international law at the time they were committed; (b) Every child alleged as or accused of having infringed the penal law has at least the following guarantees: (i) To be presumed innocent until proven guilty according to law; (ii) To be informed promptly and directly of the charges against him or her, and, if appropriate, through his or her parents or legal guardians, and to have legal or other appropriate assistance in the preparation and presentation of his or her defence;(iii) To have the matter determined without delay by a competent, independent and impartial authority or judicial body in a fair hearing according to law, in the presence of legal or other appropriate assistance and, unless it is considered not to be in the best interest of the child, in particular, taking into account his or her age or situation, his or her parents or legal guardians; (iv) Not to be compelled to give testimony or to confess guilt; to examine or have examined adverse witnesses and to obtain the participation and examination of witnesses on his or her behalf under conditions of equality; (v) If considered to have infringed the penal law, to have this decision and any measures imposed in consequence thereof reviewed by a higher competent, independent and impartial authority or judicial body according to law; (vi) To have the free assistance of an interpreter if the child cannot understand or speak the language used; (vii) To have his or her privacy fully respected at all stages of the proceedings.
3. States Parties shall seek to promote the establishment of laws, procedures, authorities and institutions specifically applicable to children alleged as, accused of, or recognized as having infringed the penal law, and, in particular:(a) The establishment of a minimum age below which children shall be presumed not to have the capacity to infringe the penal law; (b) Whenever appropriate and desirable, measures for dealing with such children without resorting to judicial proceedings, providing that human rights and legal safeguards are fully respected.
4. A variety of dispositions, such as care, guidance and supervision orders; counselling; probation; foster care; education and vocational training programmes and other alternatives to institutional care shall be available to ensure that children are dealt with in a manner appropriate to their well-being and proportionate both to their circumstances and the offence.”
উক্ত সনদ এর ইতিমধ্যেই ৩ টা protocol ও সাক্ষর হয়েছে। একই রূপে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮ এর ২৫ অনুচ্ছেদে ও শিশুর অধিকারের কথা আছে।
বাংলাদেশে শিশু আইন ২০১৩ আন্তর্জাতিক সনদ এর বাস্তবায়ন এর নিমিত্তে প্রণয়ন করা হয়। এর প্রস্তাবনা তে আছে,” যেহেতু জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ পক্ষভুক্ত হইয়াছে; এবং যেহেতু উক্ত সনদ এর বিধানাবলী বাস্তবায়নের নিমিত্ত বিদ্যমান শিশু আইন রহিতপূর্বক… একটি নূতন আইন প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল:-” তাই শিশু আইনে উক্ত সনদ এর বিভিন্ন অনুচ্ছেদের কথাই আছে। আইনে মূলত সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অধীন নিরাপদ স্থান, প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান, শিশুকল্যাণ বোর্ড, শিশুউন্নয়ন কেন্দ্রসহ প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ, বিকল্প পরিচর্যা (alternative care), বিকল্পপন্থা (diversion), শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা, সামাজিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন, সুবিধাবঞ্চিত শিশু, বর্ধিত পরিবার (extended family), আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক’, আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু (Children in Conflict with the Law), আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (Children in Contact with the Law) এর বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। শিশু আইন ২০১৩ এর ৫২ ধারা মোতাবেক শিশুকে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশু আদালতে হাজির করতে হবে। থানা হতে জামিনপ্রাপ্ত হয় নাই এমন কোন শিশুকে শিশু-আদালতে উপস্থাপন করা হলে শিশু-আদালত তাহাকে জামিন প্রদান করবে বা নিরাপদ স্থানে বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখবার আদেশ প্রদান করবে।
আইনের ৪৭ ধারা তে আছে – “শিশুর মাতা-পিতা এবং তাহাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ অথবা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা ক্ষেত্রমত, বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা বা সমাজকর্মীর উপস্থিতিতে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা শিশুর জবানবন্দী গ্রহণ করিবেন। ” তাই উক্ত আইন অনুসারে কোনো ভাবেই শিশু কে ১৬৪ কিংবা ও ২২ ধারার জন্যে কিংবা ১৬৭ এর অধীন remand এর জন্যে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করার সুযোগ নাই। এমন কি শুক্রবার ও শনিবার ও নয়। শিশুকে বয়স্ক এর কোর্ট এ উপস্থাপন, সাথে বিচার কিংবা একসাথে রাখার সুযোগ নাই।
আবার আইনের ৫৫ (১) ধারায় আছে, – আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর পক্ষে আইনগত প্রতিনিধিত্ব ব্যতীত কোন আদালত কোন মামলার বিচার কার্য পরিচালনা করিবে না। শিশুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের জন্যে ও আইনে শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে। উক্ত আইনের ৩৪ ধারায় আছে, “(১) কোন শিশু মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোন অপরাধে দোষী প্রমাণিত হইলে শিশু-আদালত তাহাকে অনুর্ধ্ব ১০ (দশ) বৎসর এবং অন্যূন ৩ (তিন) বৎসর মেয়াদে আটকাদেশ প্রদান করিয়া শিশুউন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখিবার জন্য আদেশ প্রদান করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোন শিশু মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় নয় এমন কোন অপরাধে দোষী প্রমাণিত হইলে শিশু-আদালত তাহাকে অনধিক ৩ (তিন) বৎসর মেয়াদে আটকাদেশ প্রদান করিয়া শিশু উন্নয়ন কেণ্দ্রে আটক রাখিবার জন্য আদেশ প্রদান করিতে পারিবে। “আদালতে শিশু নিজে শুনানিতে অংশও নিতে পারবেন।
বিকল্প পরিচর্যা (alternative care) বিকল্পপন্থা (diversion)এর মাধ্যমে শিশুকে মূল ধারায় প্রতিষ্ঠা করাই উক্ত আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে আমাদের দেশে বয়স লুকানোর একটা বিষয় আছে। অনেক সময়ই কাগজে কলমে শিশুরা বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে শিশুর বয়স আদালতের বিবেচনায় ২১ ধারা অনুসারে বয়স নির্ধারিত হবে।
আমাদের শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত। শিশুরা জন্ম গত অপরাধী নয়। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও দরিদ্র অবস্থা, চারপাশের পরিবেশ তাদের অপরাধী করে। তাদের বয়স কম এবং তাদের সময় ও অনেক। আইন এর মাধ্যমে তাদের মূল স্রোতে আনাই অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই শিশুদের জন্যে প্রণীত আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ এর আইন অনুসারে তাদের প্রতি সবার ব্যবহার করা উচিত।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।