দিদার আহমদ: সাধারণত ‘রিমান্ড’ (Remand) শব্দটির সাথে আইনাঙ্ঘনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও টেলিভিশনের দর্শক, খবরের কাগজ পড়ুয়া ব্যক্তিগণও পরিচিত। তবে এ পরিচয় হয়তো কেবল শুনার বা পড়ার মাধ্যমে। অনেকেই এই শব্দ শুনলেই আতকে উঠেন। পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার আর নির্যাতনই কী রিমান্ড? সে সম্পর্কে চলুন কিছু ধারনা নেয়া যাক।
একটি কথা প্রথমেই বলে রাখি, রিমান্ড আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়, ইচ্ছে করলেই পুলিশ কাউকে রিমান্ডে নিতে পারেনা। রিমান্ড (REMAND) শব্দটির অর্থ ফেরত আনা। আমাদের দেশে মূলতঃ ফৌজদারি মামলার জন্যে অভিযুক্ত আসামির বেলায়ই ‘রিমান্ড’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যদিও ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ রিমান্ড (REMAND) শব্দটির কোনো সংজ্ঞা বা বিশ্লেষণ করেনি। তবে বর্ণিত আইনের ০২ টি ধারায় রিমান্ড (REMAND) শব্দটি উল্লিখিত। ধারা ১৬৭ ও ধারা ৩৪৪ এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারাতে যে অর্থে রিমান্ড:
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৬৭ ধারার আলোচনায় রিমান্ড বলতে বুঝানো হয়েছে। আসামিকে গ্রেফতারের পর,পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটবর্তী আদালতে পুলিশ কর্তৃক তাকে সোপর্দ করা হয়। তদন্তের স্বার্থে আনীত অভিযোগ বা জড়িত থাকার সত্যতার সত্য উদ্ঘাটনের জন্য যদি আরও প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার নিমিত্তে পুলিশ কর্তৃক উক্ত আদালতে আবেদন করাকে বুঝায়। পুলিশ কর্তৃক ধৃত করার পরই নিকটবর্তী আদালতে সোপর্দ করে এই ধারায় রিমান্ড চাওয়া হয়। রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশ প্রদানের ক্ষমতা ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া হয়েছে। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত একাধারে অনধিক ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৪ ধারাতে যে অর্থে রিমান্ড:
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৩৪৪ ধারার আলোচনায় রিমান্ড বলতে বোঝানো হয়েছে আদালত কর্তৃক আসামিকে কারাগারে প্রেরণের পর বিচারিক হেফাজতে থাকাকালীন পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকার পরও অধিকতর তদন্তের স্বার্থে আদালত থেকে কারাগারে হাজির করে পুলিশ কর্তৃক পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আবেদনকে বুঝায়। ইহা তদন্ত বা বিচার চলাকালীন আদালত একাধারে অনধিক ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন। বর্নিত ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা আদালতগুলোকে আদালত হিসেবে বোঝানো হয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারানুযায়ী রিমান্ড আবেদন করা হলে আসামিকে ধৃত করার পর যদি শারীরিক নির্যাতন করা হয় আসামি তা আদালতে প্রকাশ করতে পারবে এবং রিমান্ডের আবেদন থাকলে তা শুনানি না হওয়া পর্যন্ত আসামি কর্তৃক নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী আসামির জামিনের আবেদন শুনানি করতে পারবেন না। পুলিশ কর্তৃক রিমান্ডের স্বপক্ষে শুনানি করা কালে আসামি কর্তৃক নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীও রিমান্ডের বিপক্ষে তার যুক্তি তুলে ধরতে পারবেন। রিমান্ড আবেদনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে যা থাকে:
- মামলার ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন
- মূল আসামির নাম থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে এবং তার কাছ থেকে মূল
- আসামির নাম পরিচয় জানার চেষ্টা।
- ঘটনার উৎস জানা
- জড়িত অপর আসামির তথ্য পাওয়া
- আলামত থাকলে তা উদ্ধারের জন্যে খবর পাওয়া
- ঘটনার ক্লু উদঘাটনের লক্ষ্য।
ঊচ্চ আদালতের নির্দেশনা:
রিমান্ডে পুলিশের আচরন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হলে বিগত ২০০৩ সালে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট রিমান্ডে পুলিশের আচরন সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেন। যাহা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
- কাঁচের দেয়াল বিশিষ্ট কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে
- জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে আসামির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে
- প্রত্যেকবার রিমান্ডের মেয়াদ অনধিক ০৩ দিন হবে
- কাঁচের দেয়াল নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামির আইনজীবী ও আত্মীয়-স্বজনদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
এছাড়াও রিমান্ড প্রশ্নে মানবাধিকার লঙ্গনের ও পুলিশ কর্তৃক নির্যাতনের অভিযোগের সুর শোনা যায়। ২৭ এপ্রিল, ২০০৩ সাল, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ প্রচলিত আইন সংশোধনের নির্দেশ দেন। ব্লাস্ট ও কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার রিমান্ড প্রশ্নে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৪ ও ১৬৭ এর অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতেই এই নির্দেশনা দেয়া হয়। যাহা আপিল বিভাগ স্থগিত করেনি।
নির্দেশনায় ছিল:
- আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্যে পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
- কাউকে গ্রেফতার দেখানোর সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
- গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে।
- গ্রেফতারকৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ।
- গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে পুলিশকে।
- বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যদি কাউকে আটক করা হয় তাহলে আটক ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।
- আটক ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
- জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাঁচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।
- কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে,তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
- জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে।
- পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে, ঐ ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ড বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
- পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে।
- পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয়, ঐ ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দিবেন।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া এই নির্দেশনাগুলোই চুড়ান্ত। তা আপিল বিভাগেও বহাল। এই নির্দেশনাগুলোর ব্যতিক্রম আদালত অবমাননার শামিল। মূলতঃ হেফাজতে নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যেই এই নির্দেশনা। তবে একটা বিষয় জানা দরকার, রিমান্ড মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করতে আদালত বাধ্য নন। উপযুক্ত কারন ও যুক্তি সাপেক্ষে আদালত তা মঞ্জুরের আদেশ দিতে পারেন। অনেক সময় জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশও আদালত দিয়ে থাকেন। সুতরাং রিমান্ড হল আমলযোগ্য অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পুলিশ হেফাজতে আদালতের অনুমতিক্রমে নেয়া।
দিদার আহমদ: অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, সিলেট