খন্দকার এম এস কাউসার:
গত ১৯শে এপ্রিল ২০২০ ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দা ফাইনানশিয়াল এক্সপ্রেসে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল যেখানে আমি লিখেছিলাম বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে এই মুহূর্তে কিছু আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ব্যপারে আমি মোহাম্মদি গ্রুপের কর্ণধার এবং বিজিএমইএ এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডঃ রুবানা হক এর সাথে কথা বলেছিলাম যিনি বলেছিলেন শ্রমিকদের মজুরি এর ব্যপারগুলো আগে মীমাংসা করে পরে অন্যান্য পদক্ষেপ নিবেন। ওই লেখায় আমি গার্মেন্টস এর অর্ডার বাতিল এর সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম, যা ইতিমধ্যে ঘটে যাচ্ছে।
বিশ্বের ১২ দেশে প্রায় ৩৭০টি বিপনি এর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইমারক বাংলাদেশের উৎপাদকদের থেকে কাপড় নিয়ে বিক্রি করত বিশ্ব দরবারে, যাদের মাসিক বিক্রি ছয়শত পঞ্চাশ মিলিয়ন ইউরো থেকে এখন দাঁড়িয়েছে শূন্যে, সে প্রতিষ্ঠান কভিড-১৯ এর কারনে যেমন বন্ধের পথে, বিশ্বের আরেক মহাকায় প্রতিষ্ঠান এইচএনএম এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোন অর্ডার বাতিলের পক্ষে না। আরেক মহীরুহ মার্ক্স-এন্ড-স্পেন্সার ও একই পথে হাঁটছে। তবে বর্তমান অর্ডার শেষ হয়ে গেলে ওরা পরবর্তীতে আর অর্ডার করবেন কিনা, সে ব্যপারে কোন নির্দেশনা নাই। তাই ধোঁয়াশা এবং অনিশ্চয়তা রয়েই গেল।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানি মার্চ মাসে কমেছে ত্রিশ শতাংশের অধিক, এপ্রিলে কমেছে সাতাত্তর শতাংশের অধিক এবং ইতিমধ্যে এক হাজার একশত বিশটি বাংলাদেশী উৎপাদকের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমাদের বিশ্বাস ডঃ রুবানা হক এর মতো যোগ্য নেতৃত্ব বর্তমান সঙ্কটের একটি সমাধান বের করবেন। বিশ্বব্যাপী অর্ডার কমেও যা বাকি থাকবে তা থেকে বাংলাদেশ যেন তাঁর আনুপাতিক অংশ হারিয়ে না ফেলে, বরং বাংলাদেশ যেন তাঁর সিংহভাগ দখল করতে পারে, সে পদক্ষেপগুলো এখন সময়ের দাবী। সরাসরি পঁচিশ লক্ষ এর অধিক এবং পরোক্ষভাবে এক কোটি এর অধিক মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে এ শিল্পের উপর। আমাদের কোন অনিচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততা বা তড়িৎ পদক্ষেপ না নেয়া যাতে এ শিল্পকে ঝুকিতে না ফেলে এ দাবী সবার।
বিদেশী বায়ারদের সাথে আপোষ-আলোচনা (নেগোসিয়েশন) এর জন্য বিজিএমইএ জরুরী ভিত্তিতে কিছু ‘নেগোসিয়েশন বিশেষজ্ঞ’ নিয়োগ দেয়া উচিত, যারা বিদেশী বায়ারদের সাথে প্রতিনিয়ত আপোষ-আলোচনা চালিয়ে যাবে ইমেইল, ওহাটসআপ বা অন্যান্য মাধ্যমে। নেগোসিয়েশন বিশেষজ্ঞগন প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে তুলে ধরবে বায়ারদের কাছে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস এর প্রতিপালন (কমপ্লায়েন্স) এবং অন্যান্য বিশেষ সুবিধার তথ্য তুলে ধরবে প্রতিনিয়ত। বায়ারদেরকে আশ্বস্ত করবে বিপদ কেটে গেলে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং দ্রুততার সাথে পরবর্তী অর্ডার সরবরাহ করবো। পরবর্তীতে যদি কোন দ্বন্দ্ব হয় বিদেশী বায়ারদের সাথে, তাহলে এ যোগাযোগগুলো সাক্ষ্য আইনের সহায়ক হবে। এগুলো আইনের দৃষ্টিতে ক্ষতি কমানোর (মিটিগেটিং) প্রচেষ্টা হিসেবে কাজ করতে পারে। বায়াররা হয়তো বর্তমানে লং টার্ম চুক্তিতে যাবে না, তাই তাদেরকে শর্ট টার্ম চুক্তির প্রস্তাব দিতে হবে। করোনা পরবর্তীতে ১/২ টা কন্সাইনমেন্ট জিরো প্রফিট এ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া যায়। প্রয়োজনে চুক্তি/এলসি রিভাইজ করা যেতে পারে।
কোন ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রয়োজনে বিজিএমইএ এর ১/২ জন ‘ইমারজেন্সি আরবিট্রেটর’ নিয়োগ দেয়া দরকার হতে পারে। কোন বিদেশী বায়ার যদি একতরফা সিদ্ধান্তে অর্ডার বাতিল বা স্টে এর মতো পদক্ষেপ নেয়, তবে ইমারজেন্সি আরবিট্রেটর সর্বোচ্চ ১৪ দিনে দ্বন্দ্ব সুরাহা করার পদক্ষেপ নিতে পারে। কোন অর্ডার বাতিলে যদি কোন ছোট গার্মেন্টস এর অস্তিত্তের সঙ্কট তৈরি হয়, তবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন এ যেতে হতে পারে, যা নিউইয়র্ক কনভেনশন অনুযায়ী হবে। তখন হয়তো বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানকে ফোরস মেঝর বা ফ্রাস্ট্রেশন এর মতো আইনি বিষয়গুলোকে তুলে ধরতে হতে পারে। তবে আরবিট্রেশন এর মাধ্যমে দ্বন্দ্ব সুরাহার চেষ্টার আগে দ্বন্দ্ব সুরাহার অধিক কার্যকর পদ্ধতি মেডিয়েশন এর পদক্ষেপ নেয়া সুবিধাজনক হবে, যা সিঙ্গাপুর কনভেনশন অন মেডিয়েশন অনুযায়ী পরিচালিত হতে পারে। ভার্চুয়াল দ্বন্দ্ব সুরাহার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। মেডিয়েশন এমন একটি কার্যকর পদ্ধতি যেখানে দ্বন্দ্ব ও সুরাহা হয় এবং পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক ও বহাল থাকে। বায়ারদের সাথে সুসম্পর্ক বহাল রাখাটা অধিক জরুরী।
এছাড়া বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে রক্ষার জন্য জরুরীভিত্তিতে স্থায়ী ভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি গার্মেন্টস এর প্রবেশ মুখে হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা এবং চেঞ্জিং রুম এর স্থায়ী ব্যবস্থা করা উচিত। গার্মেন্টস এর প্রবেশ দ্বারে একজন সিকিউরিটি দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিদিন কর্মীদের দূরত্ব বজায় রেখে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা উচিত। সব কর্মকর্তাদের মাস্ক সহ সকল নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিজিএমইএ এর পর্যবেক্ষণে ছোট বড় সকল গার্মেন্টস বিল্ডিং এর অগ্নি নির্বাপক সহ অন্যান্য প্রতিপালন (কমপ্লায়েন্স) নিশ্চিত করতে হবে, যা যথারীতি অনেকখানি হয়ে গেছে রানা প্লাজা ধ্বসের পর। সস্তা শ্রমিকের ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা রোবটের কার্যকারিতাকে স্বাগত জানাতে হবে আমাদের অদূর ভবিষ্যতে।
পারতপক্ষে কাউকে চাকরিচুত না করাটাই শ্রেয়, কারন আপনার দুর্দিনে এবং সুদিনে সে আপনার পাশে ছিল, আপনার উত্থান পতনের সাক্ষী সে। আজ তাঁর দুর্দিনে আপনি তাঁর পাশে থাকবেন এমনটাই কাঙ্খিত। বর্তমান দুর্দিন হয়ত বেশিদিন থাকবে না, “শীত চলে আসলে বসন্ত কি খুব দূরে থাকতে পারে?” (ইংরেজ কবি শেলি)। শীত ইতিমধ্যে গভীর হয়ে গেছে, তাই আমরা সুসময়ের অপেক্ষায়। আর কয়েকটাদিন ধৈর্য ধরে কাউকে চাকরিচুত না করাটাই শ্রেয়। যদি পদক্ষেপ নিতেই হয়, উপযক্ত প্রাপ্য না দিয়ে কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন না। এটা আইন এবং মানবিকতার দাবী। বিদেশী বায়ারদের বিশ্বাস ধরে রাখার জন্য বর্তমানে কর্মীদের ন্যুনতম মজুরি নিয়মিত ভাবে চালু রাখা হোক। গার্মেন্টস লে অফ করার পূর্বে বার বার পুনঃবিবেচনা করা উচিত এবং লে অফ করতে হলে সকল প্রক্রিয়া যথাযথ পালন করা উচিত যাতে এ নিয়ে পরবর্তীতে আইনি জটিলতা তৈরি না হয়। গার্মেন্টস কর্মীদের ও আরো সহনশীল হতে হবে এবং পরিস্থিতি বুঝতে হবে।
২০১৮ সালে আমাদের গার্মেন্টসের রপ্তানি ছিল সামগ্রিক জিডিপির ১৪.৮ শতাংশ। এ শিল্প ধ্বংস হলে আমদের অর্থনীতি আইসিইউতে চলে যাবে। তাই এই শিল্পকে বাঁচাতে আমাদের সরকার, মালিকগন এবং গার্মেন্টস কর্মীদের একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা বাঁচাতে পারে এ শিল্পকে।
খন্দকার এম এস কাউসার : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইয়াং আরবিট্রেটরস ফোরাম এর আঞ্চলিক (উত্তর এশিয়া) প্রতিনিধি।