আবদুল্লাহ আল মামুন :
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে ‘আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম’ এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। এক অভাবনীয় সাড়া পড়েছে পুরো বাংলাদেশে। কিছু কিছু জেলায় বিজ্ঞ আইনজীবীদের অনিচ্ছুকতা থাকলেও পরে তারাও তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এবং আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমে অংশগ্রহন করেছেন। ইতিবাচক এই দিকটি বিবেচনায় রেখেই আমরা মনে করি আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রয়োজন।
পুরো দেশের গত কয়েকদিনে আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমের মাধ্যমে জামিন সংক্রান্ত ২৮৩৪৯টি জামিনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় জামিন লাভ করেছেন ১৮৫৭৫ জন অভিযুক্ত। নিঃসন্দেহে করোনাকালীন সময়ে আদালতের এই কার্যক্রম বিচারপ্রার্থীদের আশাবাদী করেছে। তারা দৃশ্যমানভাবে কিছু প্রতিকার পেয়েছেনও। কিন্তু, এই কার্যক্রমের বিষয়ে আরো বিশদ চিন্তা ভাবনা এবং সিদ্ধান্তের অবকাশ রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়ে বিচারকগণ যেমন সমস্যায় পড়েছেন, তেমনি আইনজীবীগনও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। করোনা ভাইরাস বিশ্বকে যেমন আতংকিত করেছে, তেমনি ভেঙে পড়েছে অনেক বড় বড় দেশের শাসন ব্যবস্থা। একে সামলাতে বিশ্বের প্রায় সব দেশই গলদঘর্ম। করোনা কতদিন থাকবে বা কখন অবস্থা স্বাভাবিক হবে তা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয় এবং এটাই বাস্তবতা।
১. সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমানে আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমের মাধ্যমে কগনিজেন্স/আমলী আদালত বা বিচারিক আদালতের কারাগারে থাকা অভিযুক্তের শুধুমাত্র জামিনের আবেদন শুনানী হচ্ছে।
আমাদের কারাগারগুলো ধারণক্ষমতার ৩ গুণ বন্দী ধারণ করায় আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম অবশ্যই একটি বাস্তবতা এবং অত্যাবশ্যক ছিলো। কোভিড পরিস্থিতির কারণে আদালত সম্পূর্নভাবে খুলে দেওয়ার পরিস্থিতি বর্তমানে নেই। কিন্ত একইভাবে রাষ্ট্রের তিনটি অংশের একটি অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকতে পারেনা৷ আমাদের আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ,সহায়ক স্টাফ, বিচারপ্রার্থী সহ আনুমানিক ৬/৭ লাখ লোক প্রতিদিন আদালতে আসেন। কোভিড পরিস্থিতিতে এর অর্ধেক মানুষও যদি প্রতি কার্যদিবসে আদালতে আসেন তবে তা কোভিড পরিস্থিতিকে নিঃসন্দেহে আরো নাজুক, জটিল করে তুলবে। আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমের মেয়াদ আপাতত এই মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত। এরমধ্যে ঈদ পরবর্তী ২৭, ২৮ তারিখ দুইটি কার্যদিবস রয়েছে। সুতরাং,ঐ ২টি কার্যদিবসে আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম চলবে। হয়তো এর পরেও কোভিড পরিস্থিতির জন্য আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম অব্যহত থাকার ক্ষেত্রে আমরা মনে করি কিছু বিচারিক এখতিয়ার যেমন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি কিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২. বিচারিক/ট্রায়াল আদালতগুলোতে শুধুমাত্র জামিনের বিষয় থাকলেও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কগনিজেন্স বা আমলী আদালতগুলো কিন্তু শুধুমাত্র জামিনের বিষয় নিষ্পত্তি করে না। বরং, একটি মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই আদালতে থাকে বলে এই আদালতে রিমান্ড, শ্যোন এরেষ্ট, গাড়ি জিম্মার আবেদন দাখিল করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কারাগারে থাকা অভিযুক্তের জামিন ছাড়া অন্য কোন আবেদন শুনানীর সুযোগ নেই। সুতরাং, কারাগারে থাকা অভিযুক্তের জন্য পুলিশ তদন্তের প্রয়োজনে রিমান্ডের আবেদন দিলেও তা নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। কারন, জামিনের আবেদন ছাড়া কারাগারে থাকা অভিযুক্তের ক্ষেত্রে অন্য কোন আবেদন শুনানীর ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
সমস্যা হলো- কারাগারে থাকা অভিযুক্ত পক্ষে জামিনের আবেদন দেয়া হলে এবং একই সঙ্গে পুলিশ রিমান্ডের বা শ্যোন এরেষ্টের আবেদন দেয়া হলে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বিচারকের জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষমতা থাকলেও রিমান্ডের বা শ্যোন এরেষ্টের আবেদন নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা না থাকায় জামিন বা রিমান্ড বা শ্যোন এরেষ্টের আবেদন কোনটাই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, আবেদনগুলো নথিতে রাখার এবং আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলে নিষ্পত্তির জন্য রাখতে হচ্ছে। ফলে অভিযুক্ত যেমন প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জামিন লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি পুলিশ তদন্তের প্রয়োজনে অভিযুক্তকে রিমান্ডের বা শ্যোন এরেষ্ট করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে,তদন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরমধ্যে অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যা,ধর্ষণ মামলা প্রভৃতিও রয়েছে।
৩. পুলিশ অভিযুক্ত ধরার সাথে সাথে যদি রিমান্ডের আবেদন/শ্যোন এরেষ্টের আবেদন, কেস ডকেট প্রভৃতি একসাথে প্রেরন করে এবং সাথে আদালতে অভিযুক্ত রিমান্ডের ক্ষেত্রে যদি জামিনের আবেদন করে, তবে ম্যাজিস্ট্রেট শুনতে পারেন কিনা সেটি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। একটি মত হলো অভিযুক্ত আদালতের সামনে থাকায়,কেস ডকেট সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ সামনে থাকায় রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করে জামিনের আবেদন না মঞ্জুর করতে পারবেন। অথবা রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করে জামিনের আবেদন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর দুটোই করতে পারবেন। এই মতের স্বপক্ষে যারা বলছেন তাদের বক্তব্য হলো অভিযুক্ত, কেস ডকেট আদালতের সামনে থাকায় আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।কারণ সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনায় শুধু ‘কারাগারে থাকা’ অভিযুক্তের বিষয় বলা হয়েছে। কারাগারে প্রেরণ করার আগেই অভিযুক্তের এই শুনানী করা যেতে পারে। এর ভিন্নমতের বক্তব্য হলো- ভার্চুয়াল কার্যক্রমে শুধুমাত্র জামিনের আবেদন শুনানীর ক্ষমতা দেয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট এই আবেদন শুনতে পারবেন না।
এই দুটো পরিস্থিতির অবসান প্রয়োজন।
শ্যোন এরেষ্টের আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদন অভিযুক্তের উপস্থিতিতে সিডি দেখে মঞ্জুর করা হলে অভিযুক্তের জামিনের আবেদন করার অধিকার সৃষ্টি হয়। এর আগে নয়। সুতরাং, এই পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেট এর করনীয় নির্ধারণ প্রয়োজন।
৪. গাড়ি বা অন্যান্য জিনিসের জন্য জিম্মার আবেদন করা হলেও ম্যাজিস্ট্রেট তা নিষ্পত্তি করতে পারছেন না। কারণ,আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমে শুধুমাত্র কারাগারে থাকা অভিযুক্তের জামিন শুনানীর ক্ষমতা দেয়ায় অন্য কোন আবেদনই নিষ্পত্তি করা যাবে না। ফলে, জিম্মায় দেওয়া যায় এরকম অনেক সম্পত্তি থানায় খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকছে। এই সম্পত্তির মধ্যে অনেক সরকারী সম্পত্তি যেমন- দূর্ঘটনার কবলে পড়া সরকারী গাড়িও রয়েছে। ফলে, এই আবেদনগুলোও আদালতের স্বাভাবিক সময়ে শুনানীর জন্য রাখা হচ্ছে।
আদালতের বিচারিক অনেক কার্যক্রম যেমন- মামলা ফাইলিং, চার্জ শুনানী, সাক্ষ্য শুনানী, যুক্তিতর্ক, রায় ভার্চুয়াল কার্যক্রমের মাধ্যমে হয়তো এই মুহুর্তে করা সম্ভব নয়। আমাদের সফটওয়্যারও প্রস্তুত নয়। কারণ, MYCOURT/ MYORDER এই মুহুর্তে শুধু জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।এটি অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত নয়। এর জন্য অনেক সময় এবং দক্ষতারও প্রয়োজন। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি অব্যাহত থাকার কারণে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করা না গেলে অন্তত যে সকল অভিযুক্ত বিচারধীন মামলার শেষ পর্যায়ে কারাগারে রয়েছেন তাদেরকে ভিডিও কল/ কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি আদালতে উপস্থিত করে ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা বা যুক্তিতর্ক বা রায় ঘোষণা করা যায় কিনা সেটি বিবেচনা করা যেতে পারে। গত দুইমাসে সব জেলার ম্যাজিস্ট্রেসিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু উক্ত পুলিশ রিপোর্টগুলি সম্পর্কে কোন আদেশ প্রদান করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং, উক্ত পুলিশ রিপোর্টগুলি গ্রহণপূর্বক অপরাধ আমলে গ্রহণ করা এবং পলাতক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট/সমন ইস্যু করার ক্ষমতা আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমে যুক্ত করা হলে বিপুল পরিমাণ মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত করার কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে। এরমধ্যে হত্যা, অপহরণ, দস্যুতা,ধর্ষণ এর মতো অপরাধ রয়েছে।
সুতরাং, কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় সুপ্রীম কোর্টের ‘আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমের’ আদেশটি সংশোধন করে উক্ত আদেশে জরুরী ভিত্তিতে-
ক. রিমান্ডের আবেদন,
খ. শ্যোন এরেষ্টের আবেদন
গ. জব্দকৃত সম্পত্তি জিম্মার আবেদন এবং
ঘ. পুলিশ রিপোর্ট/অভিযোগপত্র গ্রহণ করে ওয়ারেন্ট/সমন ইস্যু করার ক্ষমতা
আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমে যুক্ত করা হলে আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম যেমন শক্তিশালী হবে,ঠিক তেমনি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতও তদন্তের প্রয়োজন অনুযায়ী আদেশ প্রদান করতে পারবেন। ফলে,পুলিশি তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে না।
এছাড়াও,অভিযুক্ত কারাগারে আছেন এমন বিচারাধীন মামলা যদি বিচারের শেষ পর্যায়ে থাকে অর্থাৎ ৩৪২ ধারায় অভিযুক্ত পরীক্ষা বা যুক্তিতর্ক বা রায়ের পর্যায়ে থাকে,তবে অভিযুক্তকে ভার্চুয়ালি আদালতে উপস্থিত করে এই পর্যায়গুলো শেষ করে রায় ঘোষণা করা যেতে পারে এবং এই জন্য আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমের কার্যপরিধি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এই ভাবে বিচারাধীন কিছু মামলা নিষ্পত্তি হতে পারে।
এই প্রক্রিয়ায় কারাগারে থাকা অভিযুক্তকে সুপারিনটেনডেন্ট অব জেল, জেলার বা ডেপুটি জেলারের মাধ্যমে শুনানির সময় ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত করে ভার্চুয়ালি আদালতের সামনে উপস্থিত করে তার আইনজীবীর বা অভিযুক্তের বক্তব্য শুনে রিমান্ড বা শ্যোন এরেষ্টের আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব।প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও থানায় বসে এই কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন। জানামতে শুধুমাত্র বান্দরবান পার্বত্য জেলার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, সিরাজগঞ্জ জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে অভিযুক্তকে কারাগার থেকে আদালতের ভার্চুয়াল শুনানীতে অংশগ্রহণ/উপস্থিত করিয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে উভয় জেলার মাননীয় বিচারকগণের দূরদর্শীতা এবং যথাযথ সিদ্ধান্তের কারণে। আমরা আশা করবো অচিরেই বাংলাদেশের সকল দায়রা জজ আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা চীফ জুডিসিয়াল/মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মাননীয় স্যারগণ এই প্রক্রিয়া শুরু করবেন। ফলে আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমের কার্যকারীতা আরো দৃশ্যমান হবে।
জিম্মার আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারী ভিডিও কনফারেন্সে আইনজীবীর চেম্বার বা পিপি,এপিপি বা সিএসআই এর সামনে থেকে বা অন্য যে কোন স্থান থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হতে পারেন। এভাবেই জিম্মার আবেদন নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।
৫. কোভিড পরিস্থিতিতে সরকারী দায়িত্ব পালনরত প্রায় সকলেই একাধিক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রাপ্তির বা কোভিড আক্রান্ত বা মৃত্যুবরণ করলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ প্রাপ্তির নিরাপত্তার ছায়াতলে এসেছেন। বিচার বিভাগ এই নিরাপত্তার বাইরে আছেন। আমরা চাইবো না আমাদের কোন বিচারক বা সহায়ক স্টাফ দায়িত্ব পালনকালে আক্রান্ত হোক। কিন্তু, যেহেতু আমরা না চাইলেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু, আমরা আশা এবং প্রার্থনা করবো বিচার বিভাগের সদাশয় কর্তৃপক্ষ পূর্বেও যেমন ব্যবস্থা নিয়েছেন, ঠিক তেমনি এই পরিস্থিতিতেও বিচারক এবং সহায়ক স্টাফদের আর্থিক নিরাপত্তার চাদরে আবৃত করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করবেন। করোনার সম্পূর্ণ সময়ে এবং অদ্যাবধি সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনার সকল বিচারক যার যার কর্মস্থলে অবস্থান করছেন। তথাপি, নেত্রকোণার মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ এবং মুন্সিগঞ্জের মাননীয় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্টাফসহ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং,আমরা আশা করবো বিচারক এবং স্টাফদের আর্থিক নিরাপত্তা বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি জেলার কোর্টের প্রবেশমুখে জীবাণুনাশক টানেল তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এবং দ্রুত এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
৬. আমরা অবগত হয়েছি যে,অনেক জেলায় শুধু একটি ই-মেইলের মাধ্যমে কাজ করা হয়েছে। আবার অনেক জেলায় একাধিক মেইলের মাধ্যমে কাজ করা হয়েছে। যে সব জেলাগুলোতে মামলার বা আবেদনের আধিক্য বেশি সেই সব জেলাগুলোতে দ্রুত একাধিক ইমেইল তৈরি করা যুক্তিযুক্ত। ম্যাজিস্ট্রেটদের অধিক্ষেত্র প্রতিদিন পাল্টালে ই-মেইল চেক করা থেকে শুরু করে সি এস আই, জি আর ও সব পাল্টে যায়। ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই, আবেদন করবো একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে অন্তত একসপ্তাহ বা তার বেশি সময় বা এই পরিস্থিতির উত্তোরণ না হওয়া পর্যন্ত একই অধিক্ষেত্রের দায়িত্বে রাখার জন্য। ফলে, ম্যাজিস্ট্রেট এর কাজ অনেক সহজ এবং দ্রুততার সাথে করা সম্ভব হবে। ম্যাজিস্ট্রেট সহজভাবে কাজ করতে পারলে তা আমাদের সবারই অর্জন হবে৷ কিন্তু প্রতিদিন অধিক্ষেত্র পাল্টালে তা ম্যাজিস্ট্রেট এর জন্য দূরহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আমরা আশা করবো আমাদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে সদয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন।
৭. আদালতে বিচারক বা সহায়ক স্টাফ হিসেবে কাজ করা সবারই পিপিই বা নিরাপত্তা সামগ্রীর প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আশা করবো পিপিই ক্রয় করার বা সরবরাহ করার জন্য আমাদের কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত অর্থ সংস্থানসহ এই বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করবেন বা আমাদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কন্টিজেন্সী খাত থেকে পিপিই ক্রয় করে বিচারক, স্টাফদেরকে সরবরাহ করবেন অথবা আমাদের কর্তৃপক্ষ ভালো মানের কোভিড নিরাপত্তা সামগ্রী ক্রয়পূর্বক তা আদালতগুলোতে প্রেরণ করবেন।
সম্পূর্ণরুপে প্রস্তুত না হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতির সাথে আমরা খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সকলকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সত্য হলো আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমে অসফল হওয়ার কোন সুযোগ ছিলো না। আমাদেরকে যে কোন মূল্যে এই প্রক্রিয়াকে সফল করতে হতো ভবিষ্যৎ ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থার জন্য। গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান বলছে আমরা অসফল নই। একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছে বিচার বিভাগে। অবশ্যই এর পুরোভাগে আছেন আমাদের কর্তৃপক্ষ। নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশের সকল আইনজীবীগণ। কিন্তু,আমরা জানি প্রতিটা জেলার বিপুল তরুন বিচারক এই সফলতার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। দায়িত্ব পেয়ে বা না পেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই তরুণ বিচারকরা দায়রা জজ স্যার বা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্যারদের কার্যক্রমে সহায়তা করেছেন। শুনানীর পুরো সময় উপস্থিত থেকেছেন এবং প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো স্যারদের নির্দেশনায় সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি বিভিন্ন বারের আইনজীবীগণকে প্রশিক্ষন প্রদান করেছেন। তরুণ আইনজীবীগণও নিজেরা যেমন এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছেন,তেমনি সিনিয়র আইনজীবীকেও শুনানীর সময়ে সহযোগিতা করেছেন। এই তরুণ প্রাণদের আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা যে ডিজিটাল বিচার বিভাগের স্বপ্ন দেখছি তা সবার সম্মিলিত অবদানের মাধ্যমেই এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।
আমরা আশা করবো কোভিড পরিস্থিতি চলে গেলেও আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আমাদের গত কয়েকদিনের সফলতা নিশ্চয়ই সবাইকে আশ্বস্ত করেছে। সুতরাং, আমরা চাইবো আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রমে আমাদের আওতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হোক। আমাদের সুরক্ষার উপকরণ সরবরাহ করা হোক। আমাদেরকে আর্থিক নিরাপত্তার চাদরে আবৃত করা হোক এবং এই কার্যক্রম আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম হিসেবেই পরিগনিত করা হোক।
৮. দায়রা জজ আদালত, ট্রাইব্যুনাল এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালত শুধুমাত্র জামিনের আবেদন নিষ্পত্তি করেছেন। জামিন বিষয়টি মানুষের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। কিন্ত,আমাদেরকে মানুষের জীবন,স্বাধীনতার সাথে সাথে সম্পত্তির অধিকার এর বিষয় ভুলে গেলে চলবে না। দেওয়ানী আদালত বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থীদের এই বিষয়েও আমাদের নজর দিতে হিবে। সুতরাং,আমরা আশা করবো দেওয়ানী আদালতের অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা শুনানীর জন্য Judiciary.Org.bd -কে প্রস্তুত করা হবে। পোর্টাল প্রস্তুত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত বিষয়গুলো ই-মেইলের মাধ্যমে ভার্চুয়াল কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা হোক। দেওয়ানী আদালতের কিছু অংশ স্বল্প পরিসরে খুলে দেওয়া হোক।
৯. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম অনুসঙ্গ হলো লিগ্যাল এইড অফিস। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জামিনের আবেদন শুনানী করতে গেলে অনেক সময় লিগ্যাল এইডের আইনজীবী প্রয়োজন হচ্ছে। আইনজীবীদের অগ্রিম অর্থ দিতে হচ্ছে। আবার, এই অফিসে অনেকের কিস্তির টাকাও লেনদেন হয়। সুতরাং, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এই অফিসটিও ভার্চুয়াল ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্মুক্ত করা যায় কিনা সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত কামনা করছি।
সুতরাং, আমরা প্রত্যাশা করতে পারি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনাটি সংশোধন করা হবে এবং উক্ত আদেশে দেওয়ানী আদালতের বিষয়সমূহও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দেওয়ানী আদালত সীমিত পরিসরে চালু করা হোক। ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার সংশোধন করা হোক এবং একই সাথে লিগ্যাল এইড অফিস জনস্বার্থে চালু করা হোক।
মাননীয় বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান (ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম এ প্রকাশিত এক লেখায়) উচ্চ আদালতের জন্য অনুসরণযোগ্য নির্দেশনা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। উক্ত প্রস্তাবনাসমূহ যথাযোগ্য এবং বিবেচনার দাবী রাখে। আমাদেরকে অবশ্যই আইনজীবী, মুহুরি/ক্লার্ক এদের নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হবে। ইতোমধ্যে একজন মাননীয় বিচারপতি এবং বেশ কয়েকজন আইনজীবী করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সুতরাং, আদালত সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা বিধান করেই আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
আবদুল্লাহ আল মামুন : অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান