রাজীব কুমার দেব :
আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং বিদ্যমান আইনি চর্চ্চায় বিচারাধীন মামলাসমূহে লিগ্যাল এইড তথা আইনগত সহযোগিতার মাধ্যমে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতি ব্যবহার করে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কাঙ্খিত সমঝোতায় পৌঁছা অনেকটা কঠিন কাজ হিসেবে ধারণা করা হয়। মামলার ভার, বিচারক স্বল্পতা, বিজ্ঞ আইনজীবী ও পক্ষদ্বয়ের দৃষ্টিভঙ্গি, বিচারাধীন মামলা লিগ্যাল এইড অফিসারের নিকট প্রেরণের সুনির্দিষ্ট বিধি বিধানের অনুপস্থিতি ইত্যাদি বিবেচনায় এ ধারণা অমূলক নয় মর্মে মনে হয়। তবে বিজ্ঞ বিচারিক আদালতের সমঝোতমূলক নিষ্পত্তির নিমিত্তে উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা, বিজ্ঞ আইনজীবীদের সহযোগিতামূলক মনোভাব এবং পদ্ধতিগত আইনি প্রক্রিয়ার সহজিকীকরণ প্রয়োগ এ ধারণা পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে।
আইনগত সহযোগিতার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি খরচে গরীব দু:খী মানুষদের আইনগত সহযোগিতা প্রদান। আইনগত সহযোগিতার সাংবিধানিক ভিত্তি হচ্ছে সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারাগ্রাফ ও অনুচ্ছেদ ২৭ এবং আইনগত ভিত্তি হচ্ছে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন-২০০০। মূল আইনকে কার্যকর করার জন্য প্রণীত হয়েছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধানমালা ২০১১, আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪, আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫, আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫, চৌকি আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী, ইত্যাদি প্রবিধানমালা, ২০১৬ এবং শ্রম আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলী, ইত্যাদি প্রবিধানমালা, ২০১৬। উল্লেখ্য ২০১৯ সালের ৩১শে মার্চ প্রকাশিত গেজেটের মাধ্যমে লিগ্যাল এইড অফিসারের কর্মকে ”বিচারিক কর্ম” হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আইনগত সহযোগিতার মূল আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক দিক হচ্ছে দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালতে বিচারাধীন মামলা সমূহ ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা। এতদুদ্দেশ্যে মূল আইনে ২১ক ধারা অনুবলে (২০১৩ সনের ৬২ নং আইন এর ১৫ ধারা বলে সংশোধনী মূলে) লিগ্যাল এইড অফিসার কে আইনগত সহায়তা প্রার্থীকে আইনি পরামর্শ প্রদান করার পাশাপাশি প্রচলিত আইনের অধীন কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রেরণ করা হলে তা তিনি নিষ্পত্তি করতে পারবেন মর্মে ক্ষমতা প্রদান করা হয়। আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫ এর ১৭ বিধি অনুসারে এ বিধিমালায় প্রদত্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রেরিত মামলাসমূহ বিকল্প বিরোধ পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করার বিধান রাখা হয়। তবে মূল আইনে আইনগত সহায়তায় দেওয়ানি মামলা সম্পর্কে কোন সীমাবদ্ধতা না রাখলেও ফৌজদারি মামলা সমূহের মধ্যে শুধুমাত্র আপোষযোগ্য মামলা সমূহ বিকল্প বিরোধ পদ্ধতিতে নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়। অপরদিকে প্রচলিত আইনে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি সংক্রান্তে কোন পরিবর্তন বা সংযোজন না আনলেও দেওয়ানী কার্যবিধির ৮৯ক ধারা (২০১৭ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি (সংশোধনী) আইন এর ২(ঙ) ধারা) মতে বিচারাধীন দেওয়ানী মামলাটি এডিআর পর্যায়ে (তিন টি বিকল্পের মধ্যে একটি) ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ অনুসারে নিষ্পত্তির নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট লিগ্যাল এইড অফিসারের নিকট প্রেরণ করা যেতে পারে মর্মে বিধান রাখা হয়।
লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে কার্যকর ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা আছে মর্মে আইনাঙ্গণে প্রচলিত আছে। লিগ্যাল এইড অফিসারের দায়দায়িত্ব ও ক্ষমতা বিধিবদ্ধ আইন, নীতিমালা, বিধিমালা ও প্রবিধানমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এবং সর্বোপরি তিনি একজন বিচারক কি তার কর্ম ‘বিচারিক কর্ম’ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ায় এবং তিনি একটি নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পক্ষদ্বয়ের সম্মতিতে ও পরামর্শকদের সহযোগিতায় বিচারিক মধ্যস্ততায় সুষম সমঝোতা করিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকায় মেডিয়েশন অগ্রযাত্রায় এই প্রক্রিয়াকে বাস্তবধর্মী প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করার রেওয়াজ চালু আছে।
অস্বীকার করার উপায় নাই বর্তমান আইনি চর্চ্চায় লিগ্যাল এইড অফিসারের পক্ষে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিচারাধীন মামলা সমূহ নিষ্পত্তি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রচলিত আইনে ফৌজদারি ও ট্রাইব্যুনালের কার্যবিধিতে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধি বিধান না থাকায় অর্থাৎ বিজ্ঞ বিচারিক আদালত কিভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় লিগ্যাল এইড অফিসে মামলা প্রেরণ করবেন তার সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় ফৌজদারি আদালতসমূহ লিগ্যাল এইড অফিসে মামলা প্রেরণে আইনি বা পদ্ধতিগত বাধ্যবাধকতা অনুভব করে না। আবার দেওয়ানী আদালত হতে এডিআর পর্যায়ে লিগ্যাল এইড অফিসে মামলা প্রেরণের চর্চ্চাও লক্ষণীয় নয়। উপরন্তু কতেক বিজ্ঞ আইনজীবীদের বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করে মামলা নিষ্পত্তিতে অনাগ্রহতা বিচারিক আদালত কর্তৃক লিগ্যাল এইড অফিসে মামলা প্রেরণ কে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। আবার কিছু কিছু মামলার পক্ষগণ সামাজিক ধ্যান ধারণার কারণে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে ‘সুলভ প্রকৃতির বিচার’ হিসেবে অকার্যকর মনে করে। এছাড়া আইনগত সহযোগিতার আইনি মাধ্যমগুলো বিশেষ করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ কমিটিগুলো নিষ্ক্রিয় থাকায় মাঠ পর্যায়ের প্রচরণার অভাবে বিরোধীয় মামলা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতির মাধ্যমে নিষ্পত্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত হতে পারেন না।
তবে পদ্ধতিগত কৌশল অবলম্বনে দেওয়ানী, ফৌজদারি ও ট্রাইব্যুনালের মামলা সমূহ বিকল্প বিরোধ পদ্ধতির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এতদুদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক প্রত্যেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারেন। মামলার যেকোন পর্যায়ে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে বিজ্ঞ বিচারক যদি উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে বিজ্ঞ আইনজীবীদেরকে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিচারাধীন মামলা লিগ্যাল এইড অফিসারের নিকট প্রেরণ করতে উৎসাহিত করেন তাহলে পক্ষদ্বয় বিজ্ঞ বিচারকের উৎসাহে আস্থা রেখে বিকল্প বিরোধের মাধ্যমে সমঝোতায় অধিক আগ্রহী হতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও গঠনমূলক এবং নমনীয় ভূমিকার মাধ্যমে বিজ্ঞ বিচারকের উৎসাহিতকরণের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। লিগ্যাল এইডে মামলা চলে গেলে নিজের কজ লিস্ট থেকে মামলা কমে যাবে এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসলে সহযোগিতামূলক ভূমিকা রাখা যাবে। তাছাড়া বিজ্ঞ আইনজীবীরা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পরিচরালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরামর্শমূলক ভূমিকা রাখতে পারেন।
বিচারাধীন মামলায় পক্ষদ্বয় যদি লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধে নিষ্পত্তি গ্রহণ করতে সম্মত হন তাহলে পদ্ধতিগত কৌশল কি হবে তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু মূল আইন লিগ্যাল এইড অফিসারকে বিকল্প বিরোধ পদ্ধতির মাধ্যমে বিচারাধীন মামলাসমূহ নিষ্পত্তির ক্ষমতা দিয়েছে এবং যেহেতু দেওয়ানী কার্যবিধিতে লিগ্যাল এইড অফিসারের বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি অনুসরণের বিধান সন্নিবেশ হয়েছে এবং যেহেতু কোন ফৌজদারি বা ট্রাইব্যুনালের কার্যপদ্ধতিতে বিচারাধীন আপোষযোগ্য মামলা সমূহ লিগ্যাল এইড অফিসে প্রেরণের ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার মত কোন বিধান নেই সেহেতু লিবারেল প্রসিডিউরাল ভিউ প্রয়োগ করে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত পক্ষদ্বয়ের সম্মতির প্রেক্ষিতে লিগ্যাল এইড অফিসে মামলা প্রেরণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান মতে সরকার পক্ষের বিজ্ঞ কৌশলী কে প্রদত্ত ক্ষমতা আইনি বাধা দিবে না। যাহোক এই পদ্ধতিগত কৌশলের অংশ হিসেবে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত আদেশনামায় পক্ষদ্বয়ের সম্মতিক্রমে বিকল্প বিরোধ পদ্ধতিতে নিষ্পত্তির লক্ষ্যে এবং নথি প্রাপ্তি সাপেক্ষে পরবর্তী শুনানীর জন্য দিন ধার্য করে নথি সংশ্লিষ্ট লিগ্যাল এইড অফিস বরাবরে প্রেরণের আদেশ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে দৈনন্দিন কার্যতালিকায় নথি লিগ্যাল এইড অফিসে প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ থাকতে হবে। উক্ত নথি প্রাপ্তির পর লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪, আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫ এবং আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা, ২০১৫ অনুসারে ‘বিকল্ল বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রতিবেদন আকারে নথি সহ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ বিচারিক আদালতে প্রেরণ করবেন। প্রতিবেদন অনুসারে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত মামলাটি নিষ্পত্তি করবেন। তবে প্রতিবেদনে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির কোন ইংগিত না থাকলে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত মামলাটি পূর্বে যেই অবস্থায় ছিল সেখান থেকে প্রসিড করবেন।
এটি সত্য কথা যে বিজ্ঞ আইনজীবীদের প্রত্যেক্ষ সহযোগিতা না পেলে বিজ্ঞ বিচারক কখনোই লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারবেন না। তবে বর্তমান বাস্তবতায় এই প্রক্রিয়া প্রচলনে মাননীয় জেলা জজ ও মাননীয় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেৃট এর অবগতিতে সংশ্লিষ্ট জেলা আইনজীবী সমিতিরি প্রতিনিধি (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) এর প্রত্যেক্ষ সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। আশার কথা কিছু কিছু জেলায় সীমিত আকারে এ প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালতের কিছু মামলা বিকল্প বিরোধ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তির কথা শুনা যায়।
পরিশেষে বিচারাধীন মামলায় লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতিতে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যেক্ষ ও আন্তরিক ভূমিকা বিচারপ্রার্থীকে যেমন দ্রুত সুষম বিচার প্রদানে সহায়ক হবে তেমনি মামলার ভার থেকে বিচার বিভাগকে কিছুটা হলেও লাঘব করা যাবে।
রাজীব কুমার দেব : সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার।