আবু রাসেল মিয়া :
দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন প্রয়োজনে দায় অথবা ঋণ পরিশোধের নিমিত্তে চেক এর ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সময়ে চেকে উল্লিখিত অংকের টাকা চেক প্রদানকারীর একাউন্টে না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পক্ষে চেক গ্রহণকারীকে টাকা দেয়া সম্ভব হয় না। অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে ব্যাংক কর্তৃক চেক প্রত্যাখ্যান করা হয়। যা চেক ডিজঅনার নামে পরিচিত।
পর্যাপ্ত টাকা না থাকার কারণে চেক ডিজঅনার হলে চেক প্রদানকারী অ্যাকাউন্টধারীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। কারন, অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংকের চেক প্রত্যাখ্যাত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তহবিল অপর্যাপ্ততায় কোন চেক প্রত্যাখ্যাত বা ডিজঅনার হইলে সেইসব অপরাধের প্রতিকারের সুরক্ষা বিধান করা হয়েছে নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের (এনআই অ্যাক্ট) ১৩৮, ১৪০ ও ১৪১ ধারায়।
এরূপ ডিসঅনার হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে উক্ত চেক দাতাকে N.I. Act এর ১৩৮ ধারার বিধান মোতাবেক ৩০ দিন সময় দিয়ে টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ দিতে হয়।
এরূপ নোটিশ দেওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে যদি চেকদাতা চেকগ্রহীতাকে চেকে উল্লেখিত টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তবে তার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেকগ্রহীতা এখতিয়ারসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।
চেক ডিসঅনার মামলার শাস্তি বা জরিমানা-
১. এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড।
২. অথবা জরিমানা যা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুন পর্যন্ত হইতে পারে।
৩. অথবা উভয়দন্ড।
আপীল দায়ের পদ্ধতি
N.I. Act এর ১৩৮ ধারায় চেক ডিসঅনার মামলায় প্রদত্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা দায়ের করা যায়। যদি এরূপ দন্ড যুগ্ম জেলা জজ কোর্টের হয় তবে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা জজ কোর্টে আপীল দায়ের করতে হবে। তাছাড়া এরূপ দন্ড যদি জেলা জজ কোর্টের হয় তবে ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করতে পারবেন।
আপীল দায়েরের পূর্বশর্ত
চেক ডিসঅনারের মামলায় চেকে উল্লেখিত অর্থের সর্বনিম্ন ৫০% জমা দিয়ে আপীল দায়ের করতে হবে। চেক ডিসঅনারকৃত চেকের টাকার ৫০% টাকা যে আদালত শাস্তি দেয় সেই আদালতে জমা দিয়ে আপীল দায়ের করতে হবে। তার মানে ৫০% টাকাটা বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে, আপীল আদালতে নয়।
রিভিশন দায়ের পদ্ধতি
চেক ডিসঅনারের মামলায় রিভিশন দায়ের করা যায়। তবে তা শুধুমাত্র আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখানেও ফৌজদারী কার্যবিধির রিভিশনের বিধান প্রযোজ্য হবে। এখানে বলা হয়েছে,আইনগত প্রশ্নে রিভিশন দায়ের করা যায়। এখন কথা হলো আইনগত প্রশ্ন বলতে আমরা কি বুঝি? যেমন-ব্যাংক থেকে চেকটি অপরিশোধিত হয়ে আসার পর ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে নোটিশ না দেয়া। এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। আবার মামলা করার কারণ আছে কিনা এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন। মামলাটি তামাদিতে বারিত কিনা, এটাও একটা আইনগত প্রশ্ন।
১৩৮ ধারার মামলা থেকে আইনগত বিষয় উদ্ভূত হলে ফৌজধারী কার্যবিধির ৪৩৯ ধারা মতে হাইকোর্ট বিভাগে অথবা একই আইনের ৪৩৯ক ধারা মতে দায়রা আদালতে রিভিশন দায়ের করা যায়। আগে একমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশন ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন। ১৯৭৮ সালে Law Reforms Ordinance দ্বারা ফৌজদারী কার্যবিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে দায়রা জজকে রিভিশন ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
রিভিশন দায়েরের সময়সীমা
তামাদি আইনে ফৌজদারী মামলায় রিভিশন দায়েরের সময়সীমা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের case law এর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হবে। উচ্চ আদালত অভিমত প্রকাশ করেন, “ফৌজদারী আপীল মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে প্রচলিত সময়সীমাই রিভিশন মামলা দায়েরের সময়সীমা বলে গণ্য হবে।”
১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ১৫৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচারিক আদালত রায় প্রদানের ৬০ দিনের মধ্যে ফৌজদারী আপীল দায়ের করতে হয়। রিভিশন দায়েরের ক্ষেত্রেও একই সময়সীমা প্রযোজ্য হবে। তার মানে বিচারিক আদালত কর্তৃক রায় প্রচারের ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশন দায়ের করতে হবে।
রিভিশন নিষ্পত্তির সময়সীমা
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৪২ক(২) ধারায় বলা হয়েছে,পক্ষগণের উপর নোটিশ জারী হওয়ার তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে রিভিশন আদালত রিভিশন কার্যক্রম নিষ্পত্তি করবেন।
রিভিউ (Review) সংক্রান্ত
দেওয়ানী মোকদ্দমায় রিভিউ (Review) করার বিধান রয়েছে। দেওয়ানী কার্যবিধির ১১৪ ধারা এবং ৪৭ আদেশে রিভিউ করার বিধান আছে। কিন্ত ক্রিমিনাল মামলায় রিভিউ করার কোন বিধান নেই। তবে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত থেকে দেখা যায় N.I. Act এর ১৩৮ ধারার চেক ডিসঅনারের মামলা কিছুটা ফৌজদারী এবং কিছুটা দেওয়ানী প্রকৃতির।
সেহেতু তার আলোকে চেক ডিসঅনারের মামলায় রিভিউ করা যেতে পারে। যেমন – Nizam Uddin Mahmood v. Abdul Hamid Bhuiyan and another [24 BLD (2004)(AD)239] মামলায় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ চেক ডিসঅনার সংক্রান্ত মামলায় রিভিউ সংক্রান্ত বিধানের অনুমতি দিয়েছেন।
আবু রাসেল মিয়া : অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট ময়মনসিংহ।