নাম জহিরুল ইসলাম খান পান্না। তবে জেড আই খান পান্না নামেই পরিচিত সবার কাছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এবং আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বারবার নির্বাচিত সদস্য। আইনজীবী তথা সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় সম্মুখ সারির একজন আইনজীবী হিসেবে খ্যাত। দেশের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন ‘ব্লাস্ট’ এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং দায়িত্ব পালন করছেন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এর মতো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সনের। তিনি আইন পেশায় আজ ৩০ মে পার করেছেন ৪০ বছর। তাঁর এই কর্মময় জীবনের নানান চ্যালেঞ্জ, স্বপ্ন, আক্ষেপ, প্রত্যাশা এসব নিয়ে মুঠোফোনে দীর্ঘ আলাপ হয় ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচির সাথে। সেই কথোপকথনের কিছু কথা তুলে ধরা হল আমাদের পাঠকদের জন্য-
স্যার কেমন আছেন?
-ভালই আছি।
বন্ধীদশায় নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে উঠেছেন?
-না। আমার খুব একটা খারাপ লাগেনা। বই পড়ছি, গান শুনছি। সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া রাজনীতি করতে গিয়ে বহুবার জেল খেটেছি।
জেল! কবে? স্বাধীনতার আগে না পরে?
-আগে এবং পরেও। ৭৫ পরবর্তীতে জেল খেটেছি একটানা ২৭ মাস। মামলা দিয়েছিল প্রায় ১৭ টি। রাজনৈতিক মিথ্যে মামলা সবই। আমি বরাবরই প্রতিবাদী ছিলাম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণেই এইসব মামলা।
জেড আই খান পান্নার রাজনীতি শুরু ছাত্রলীগ দিয়ে। স্বাধীনতার আগে আইন পড়তে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের করাচী। এলএলবি প্রথম বর্ষ পাশ করেছেন। পরিবার থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে পাঠানোর; সেটা বুঝতে পেরে পড়া শেষ না করেই করাচী থেকে ফিরে আসেন। কারণ রাজনীতিই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। ছোট বেলা থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠা সন্তান এমনই হবার কথা। দাদা খান বাহাদুর হাশেম আলী খান। ছিলেন অবিবক্ত বাংলার প্রথম সংসদের এমএলএ এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভার কৃষি ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রী। বরিশালে তাদের বাড়িতে সবসময়য় ছিল রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু সহ তৎকালীন সকল নেতাদের গমনাগম ছিল তাদের বাড়ি। আর জেড আই খান পান্না ছোট বেলা থেকেই দাদার সন্নিকটে থাকতেন। সেইভাবে তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা খুব প্রভাব ফেলে। ৭০ এর নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। ঘটনাচক্রে হয়ে উঠেনি। ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যাওয়াও হয়নি তাঁর। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি শেষ পর্ব পরিক্ষা দিয়ে পাশ করলেন।
১৯৮০ সালের আজকের দিনে আইন পেশায় প্রবেশ করেন। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন ৮৫ সাল থেকে। তারপর আস্তে আস্তে পেশাজীবী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বাস, ভালবাসার প্রিয় দলটি ক্রমশই পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত হয়ে যাচ্ছে মনে করে, তাই নিজেকে জাতীয় রাজনীতি গুঁটিয়ে নেন। এরপর নিজের নেতৃত্ব জাগিয়ে রাখেন নিজ পেশার সদস্যদের মাঝে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন আইনজীবীদের প্রিয় অভিভাবক। আলাপচারিতায় তিনি স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন।
স্যার, একজন আইনজীবী নেতা হিসেবে, বার কাউন্সিলের চারবার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আইনজীবীদের স্বার্থ সুরক্ষায় আপনার দায়িত্ব পালনে কতটুকু সফল মনে করেন?
-আমি যখন পেশায় আসি তখন নারী আইনজীবী ছিল প্রায় তিনশ। আজ সারাদেশে সে চিত্র ভিন্ন। আমি নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের বার গুলোতে গিয়ে আইনজীবী বন্ধুদের বুঝিয়েছি, আপনাদের মেয়েদেরকেও আইন পড়ান, পেশায় আনেন। আজ দেশে বহু নারী আইনজীবী, নারী বিচারক, নারী বিচারপতি রয়েছে।
এমন অর্জনের বিপরীতে আছে হতাশাও। এই পেশার মান নিয়ে আজ বেশ প্রশ্ন রয়েছে। সমাজে আইনজীবীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে না, দেখে ভয়ের চোখে, পুলিশকে যেমন দেখে। কোন বাড়িওয়ালা আইনজীবী শুনলে ঘর ভাড়া দিতে চায় না। কারণ কি? নিশ্চয়ই এই পেশাকে কেউ কেউ ভয়ের জায়গায় নিয়ে গেছে। অথচ, একজন মসজিদের ইমাম, যার পয়সা নেই তাকেও মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে।
আমার দাদা বলতেন ‘যার আছে বিদ্যা বুদ্ধি, সেই করবে উকালতি।’ অথচ আজ কথাটি ভিন্ন ভাবে শোনা যায়। এখানে আমার বা আমাদের বড় রকমের ব্যর্থতা আছে। আমি বা আমরা এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারিনি। পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব এসে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
স্যার, আইন পেশায় ৪০ বছর পার করেছেন; অনুভূতি কেমন?
-আরও ৪০ বছর এই পেশায় থাকতে পারলে ভাল লাগবে (হা হা হা)। আমি সকলের দোয়া প্রার্থী। প্রবীণ থেকে শুরু করে নবীন আইনজীবী, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। মহান স্রষ্টা যেন আমার সকল ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে সরল পথে আমৃত্যু চলার তৌফিক দান করেন।
স্যার, নিশ্চয়ই আপনি একজন সফল আইনজীবী। তারপরও পেশা নিয়ে আপনার মনে কখনো অতৃপ্তি কাজ করে?
-আদালত অঙ্গন থেকে দুর্নীতি দূর করতে না পারার অতৃপ্তি আমার রয়ে গেছে। আদালতে দুর্নীতির ফলে ন্যায়বিচার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। আমি মনে করি, অন্য কোথাও দুর্নীতির শাস্তি থেকে বিচারাঙ্গনে দুর্নীতির শাস্তি বেশি হওয়া উচিত। কারণ একজন মানুষ কোথাও আশ্রয় না পেয়ে যখন শেষ আশ্রয়স্থল আদালতে এসে দুর্নীতির মাধ্যমে পরাজিত হয় এর চেয়ে হতাশার জায়গা আর কিছু হতে পারে না। বিচারাঙ্গনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমি সোচ্চার ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব।
স্যার, করোনার এই মহাসংকটে দাঁড়িয়ে বিচার বিভাগ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কি?
-সংকট উত্তরণের জন্য উন্নত ধারণার জন্ম হয়। এই সংকটে বিচারাঙ্গনেও তেমন কিছু হবে আশাকরি। ভার্চুয়াল আদালত করার মাধ্যমে যেটা হয়েছে সেটা সাময়িক ব্যবস্থা। বরং এই উদ্যোগকে আরও আধুনিক চিন্তার মাধ্যমে পুরো আদালত সিস্টেমকে ডিজিটালাইজড করা উচিত। আমি প্রত্যাশা করি, এই সংকটে কোর্ট ম্যানেজমেন্ট ও কেইস ম্যানেজমেন্ট ডিজিটালাইজড হবে।
স্যার, প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আপনাকে অনেকক্ষণ কথা বলতে হল ফোনে।
-কথা বলতে কষ্ট কিসের। আইনজীবীদের কথা না বললে হয়? তাছাড়া আমি আড্ডা প্রিয় মানুষ।
এভাবেই কথা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা। যাক, আমি ভেবেছিলাম স্যার বিরক্ত হচ্ছেন। ক্লান্তি আসতে পারে। না তিনি ক্লান্ত নন মোটেই। বলেন, আমার বয়স এখন ৭২। কিন্তু আমার চিকিৎসক বলেন আপনি নিজের বয়স সবসময় উল্টোটা ভাববেন। তাই আমি নিজেকে ২৭ ভাবি। একজন তরুণের মতো আমি এখনো নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি সারাদিন…
জেড আই খান পান্না। জন্ম ১৯৪৮, তারিখ ৩০ নভেম্বর। শখ- বই পড়া, গান শোনা। নেশা- চা খাওয়া।