চন্দন কান্তি নাথ :
করোনা আমাদের জীবনের চিন্তা ভাবনাকে গুলোকে অনেক পরিবর্তন করে দিয়েছে। অনেক প্রিয় জন চলে ও যাচ্ছেন। অন্য দিকে আমাদের দেওয়ানী মামলার কার্যক্রম এখন ও প্রায় বন্ধ। করোনার কারণে কোর্ট এ শুধু জামিন ও অতীব জরুরি শুনানি হচ্ছে। অন্য সব কার্যক্রম বন্ধ।
ইতিমধ্যেই গত ৩০ শে মেতে সুপ্রীম কোর্ট নতুন করে প্র্যাক্টিস direction ইস্যু করেছেন। তাতে ডিজিটাল অধ্যাদেশ ২০২০ এবং সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ /০৫ /২০ তারিখের ২১৪ নং প্র্যাক্টিস direction অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, “ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাই থাকুক না কেন, যেকোনো আদালত এই অধ্যাদেশের ধারা ৫ এর অধীন জারিকৃত প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে, অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীর ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে যেকোনো মামলার বিচার বা বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণ বা যুক্ততর্ক গ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদান করতে পারবে।” উক্ত আইনে বিচার, দরখাস্ত বা আপিল শুনানি, সাক্ষী গ্রহণ আদেশ বা রায় প্রদান ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে করা যাবে বলা হয়েছে।
দেওয়ানি মামলার অধিকাংশ মামলাই স্বত্ব বা জমিজমা বা সম্পদ এবং পদসংক্রান্ত মামলা। ডিজিটাল মাধ্যমে কিভাবে হবে তা জানার আগে আমরা জেনে নিতে পারি দেওয়ানি মামলার স্তর বা ধাপ গুলো কি? প্রতিটি ধাপের জন্যই আইনের কিছু নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। আর এই ধাপ গুলো ডিজিটাল প্রক্রিয়াতে সম্পন্ন করা যায় কিনা। দেওয়ানি মামলার পূর্বশর্ত আরজি গঠন। বাদীর নালিশি লিখিত বিবরণকে আরজি বলা হয়। এটি সহজেই জামিন দরখাস্ত এর মত আদালতে ডিজিটাল মাধ্যমে দেয়া যায়। আমরা জানি যে আর্জি দাখিল হওয়ার পর দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার বা তাঁর অনুপস্থিতিতে সেরেস্তাদার হিসেবে কর্মরত কর্মকর্তা মামলার আরজি গ্রহণ করে আরজির গায়ে বা এর সঙ্গে যুক্ত অর্ডারশিটে বা স্লিপে মামলার ফাইলিং নম্বর লিখেন । যেমন—দেওয়ানি মামলা নম্বর ৫৩৮/২০১২ ইং (এর অর্থ হলো ওই আদালতের ২০১২ সালে ৫৩৮ নম্বর দেওয়ানি মামলা)। সেরেস্তাদার আর-১২ ফাইলিং রেজিস্টারে (যাকে স্যুট রেজিস্টারও বলা হয়) আরজির বিষয়বস্তু ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ করেন। সাধারণত যেদিন আরজি গ্রহণ করা হয়, সেদিনই তা নিবন্ধন করা হয়।আরজি দাখিলের সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বিষয় পালন করতে হয়। যেমন:-মামলার বিষয়বস্তুর মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয়েছি কি-না এবং আরজিটিতে যথার্থভাবে কোট ফিস প্রদান করা হয়েছে কি-না ইত্যাদি।
আরজি ও আরজির সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছু যথাযথভাবে পরীক্ষার পর কোনো ত্রুটি দেখা না গেলে সেরেস্তাদার আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা শুরু করার জন্য আরজিটি পেশকারের কাছে পাঠিয়ে দেন। কোর্ট ফিস, প্রসেস ফিস, সমন ইত্যাদি সঠিক না হলে বা দাখিলকৃত দলিল এবং ওকালতনামা ইত্যাদির মধ্যে কোনো ত্রুটি বা অনিয়ম থাকলে বা আরজিতে অন্য কোনো ত্রুটি থাকলে সেরেস্তাদার ত্রুটি বা অনিয়মগুলো দূর না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখতে পারেন। বাদী বা মামলা কারী সঠিকভাবে পূরণ করে দিলেই আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা শুরু করা হয়।সেরেস্তাদার আরজি পরীক্ষা করে আরজির প্রথম পৃষ্ঠার বাঁ প্রান্তের উপরিভাগে স্ট্যাম্প পর্যাপ্ত হয়েছে কি না তা লিখবেন। অপর্যাপ্ত স্ট্যাম্প থাকলে তাও উল্লেখ করবেন এবং বাকি স্ট্যাম্প আদায়ের পর দ্বিতীয়বার তা উল্লেখ করে প্রত্যয়ন করবেন। বাদীকে ২১ দিনের মধ্যে বাকি স্ট্যাম্প দিতে হবে।
এক্ষেত্রে অনলাইন এ একটি ফাইলিং রেজিস্টার বা স্যুট রেজিস্টার প্রস্তুত করতে হবে এবং স্ট্যাম্প এর টাকা সরাসরি ব্যাংকে জমা দেয়া যেতে পারে। এখন ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং সিস্টেম এ টাকা জমা হলেই message ও ইমেইল আসে এবং অনেক সময় মোবাইল করে তথ্য জানা যায়। তাই ব্যাংক এ কোর্ট এর নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট থাকতে পারে। ব্যাংকে জমা দেয়া রশিদ আর্জির সাথে প্রাসঙ্গিক কাগজ পত্র সহ (বর্তমান জামিন দরখাস্ত এর মতই) attach করে দেয়া যায়। আর সেরেস্তাদার বা বিচারক মামলার নাম্বারটি এবং ঘাটতির বিষয়ে তথা কোর্ট ফিস, প্রসেস ফিস, সমন ইত্যাদি সঠিক না হলে বা দাখিলকৃত দলিল এবং ওকালতনামা ইত্যাদির মধ্যে কোনো ত্রুটি বা অনিয়ম থাকলে বা আরজিতে অন্য কোনো ত্রুটি থাকলে বা অনিয়মগুলো দূর না হলে ফিরতি ইমেইলে জানিয়ে দিতে পারেন। স্ট্যাম্প ডিউটি কম তাও জানিয়ে দেয়া যায়। কোনো অন্তর্বর্তী দরখাস্ত থাকলে তার জন্যে বর্তমান প্রক্রিয়ার মতই শুনানির সময় নেয়া যায় |বর্তমান ডিজিটাল প্রক্রিয়াতেই আর্জি দাখিল এর পর শুনানিতে সমস্ত ঘাটতি গুলো উপস্থাপন পূর্বক পরবর্তী ধাপ তথা সমন জারির আদেশ হতে পারে।
আরজি ফেরত বা প্রত্যাখ্যান হওয়া উচিত মনে করলে সেরেস্তাদার তা বিচারকের কাছে উল্লেখ করবেন। বিচারক আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। আগেই বলা হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে মামলা দাখিল করে একটা ডিজিটাল মামলা নাম্বার ফেলা যায় এবং পরে একটা হার্ড কপি সংগ্রহ করে রাখা যায়। পরবর্তীতে একটা হার্ড কপি ফাইল সংরক্ষণ করা যায়। বিজ্ঞ আইনজীবী ও একটা হার্ড কপি ফাইল সংরক্ষণ করতে পারেন। যেখানে আর্জি থেকে রায় অবধি সব কিছুই থাকবে। অন্তর্বর্তী দরখাস্ত থাকলে ডিজিটাল মাধ্যমে লিঙ্ক পাঠিয়ে সহজে শুনানি করে প্রয়োজনীয় আদেশ অনলাইন এ দেয়া যায়।
একটি মামলা দায়েরের পরের ধাপ সমন জারি। আগের প্রক্রিয়ায় দেরী হত বিধায় উপরে উল্লেখিত মতে ২০১২ সনে সংশোধন এনে আদেশ ৫ এ বলা হয় সমন ৫ দিনের মধ্যে জারি করতে হবে, না হলে এটা জারি কর্মকর্তার misconduct হবে। courier service, fax massage কিংবা electronic mail, পত্রিকার মাধ্যমেও সমন পাঠানো যাবে বলে নতুন আইনে আছে। সেক্ষেত্রে পরবর্তী ধাপে আদালতের আদেশের পর আদালত ও বাদী যৌথ উদ্যোগে আইন মোতাবেক ডিজিটাল মাধ্যমে নিজ নিজ প্রক্রিয়াতে জারির ব্যবস্থা নিবেন (নতুন আইনে সুযোগ আছে)। সমন জারি সংক্রান্ত রিপোর্ট অনলাইন এ দাখিল করা যায়। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী আদেশ অনলাইন এ দেয়া যায়।
বিবাদী হাজির হওয়ার পর মামলা প্রথম শুনানির তারিখে বা এর আগে বা আদালতের অনুমোদিত সময় দুই মাসের মধ্যে লিখিত জবাব দাখিল করবেন (দে.কা.বি. আদেশ-০৮, নিয়ম-০১)। আইন অনুসারে ডিজিটাল মাধ্যমে এই কাজটি ও করা যাবে তা না হলে মামলাটি একতরফাভাবে শুনানির জন্য নির্ধারিত হবে। আর হাজির না হলে মামলায় expartee decree হবে। বিবাদী হাজির হয়ে তাঁর দাবির সমর্থনে যে দলিলের ওপর নির্ভর করেন, অবশ্যই তা ফিরিস্তিসহ দাখিল করবেন।
উল্লেখ্য যে বাদী ও বিবাদী অনলাইন এ প্রয়োজনীয় কাগজ আপলোড করবেন এবং শুনানির সময় তা দেখাবেন এবং আদেশ গুলো my কোর্ট ওয়েব পেইজ সংশ্লিষ্ট মামলা নম্বরে পর্যায়ক্রমে হবে। মামলার জবাব দাখিলের পর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পক্ষরা যেকোনো সময় আপস-নিষ্পত্তির জন্য আদালতের মধ্যস্থতায় বা আদালতের বাইরে বসতে পারেন। দেওয়ানি কার্যবিধির ৮৯(ক) ধারা মোতাবেক আপস-নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে, যা এডিআর নামে পরিচিত। ADR এর জন্যে আইন অনুসারে সংশ্লিষ্ট আদালত যাকে নিষ্পত্তির জন্যে নির্ধারণ করবেন তাঁকে প্রয়োজনীয় কাগজসহ মামলাটি ইমেইল করবেন এবং আদেশে উল্লেখ করবেন। ADR এ নিষ্পত্তি না হলে মামলার প্রথম শুনানির তারিখ বা জবাব দাখিলের তারিখের মধ্যে যেটি পরে , তা থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ইস্যু গঠন করতে হবে (দে.কা.বি. আদেশ-১৪, নিয়ম-০১) আইনে আছে। যেসব বিরোধীয় বিষয়ের ওপর মামলা নিষ্পত্তি হবে, সেসব বিষয়বস্তু নিয়ে ইস্যু গঠন করা হবে। এক্ষেত্রে আদালত অনলাইন শুনানিতে পক্ষদের উপস্থিতিতে ইস্যু গঠন করতে পারেন। ইস্যু গঠনের পর মামলায় কোনো ৩০ ধারার তদবির আছে কি না, তার জন্য এ রাখা হয়। ইস্যু গঠনের পর ১০ দিনের মধ্যে বাদী বা বিবাদী আদালতের অনুমতি নিয়ে অন্য পক্ষকে লিখিত প্রশ্ন দাখিল করতে পারবে। তবে একটি পক্ষ একবারই প্রশ্ন দাখিল করতে পারবে (আদেশ-১১, বিধি-০১)। অন্য পক্ষকে এফিডেভিটের মাধ্যমে ১০ দিনের মধ্যে প্রশ্নোত্তর দাখিল করতে হবে (আদেশ-১১, বিধি-০৮)। চূড়ান্ত শুনানির তারিখ নির্ধারণ ইস্যু গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে মামলার চূড়ান্ত শুনানির তারিখ ধার্য (এডি) করতে হয় (আদেশ-১৪, নিয়ম-০৮, দে.কা.বি.)। মামলা শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর অনধিক সাত দিনের মধ্যে আদালত রায় ঘোষণা করবেন (আদেশ-২০, বিধি-১১, দে.কা.বি.)। রায় ঘোষণার তারিখ থেকে সাত দিনের মধ্যে ডিক্রি প্রণয়ন করতে হবে (আদেশ-২০, নিয়ম-০৫, দে.কা.বি.)। এ ছাড়া মামলার যেকোনো পর্যায়ে দুই পক্ষই আরজি, জবাব সংশোধন, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা, স্থানীয় পরিদর্শন ও স্থানীয় তদন্তের জন্য আদালতে দরখাস্ত দিতে পারবে। উক্ত প্রক্রিয়া গুলোতে ও সহজে অনলাইন এ শুনানি সম্পন্ন করে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করা যায়।
ডিজিটাল অধ্যাদেশ, ২০ এর বিধান এবং সুপ্রীম কোর্ট এর প্র্যাক্টিস direction গুলো নতুন। দেওয়ানি আদালতে সময়ের প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে ত্রুটি গুলো উন্মোচন হবে এবং সেগুলোর সমাধান হবে বলেই আশা করা যায়। সেক্ষেত্রে শুধু করোনা থেকে বাঁচা ছাড়া ও মামলা গুলো ও আদালতের টাউট, দালাল এবং দুর্নীতি মুক্ত পরিবেশে নিষ্পত্তি করা যাবে এবং দেওয়ানি আদালতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে।
চন্দন কান্তি নাথ : সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।