আইনুল ইসলাম বিশাল :
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাস। প্রতিটি দেশ, প্রতিটি গোষ্ঠী এই করোনা ভাইরাসের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। বিশ্বের স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো যেখানে প্রতিনিয়ত লাশ ও আক্রান্তের সংখ্যা গুনতে গুনতে ক্লান্ত। সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের চিত্র ভিন্ন। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের বিভিন্ন গ্রুপ গুলো দেখলে আপনি কিছুক্ষনের জন্য বর্তমান কোভিড ১৯ এর ভয়াবহ বিশ্ব থেকে হারিয়ে যাবেন। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সকল আকুতি, মিনতি ও প্রার্থনা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি বছর নিয়মিত বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট পরীক্ষা।
উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী প্রতি ক্যালেন্ডার ইয়ারে এনরোলমেন্ট পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন সময়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা মানববন্ধন, সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে আমরণ অনশনে অংশ নেয়। অবশেষে দীর্ঘ প্রায় তিন বছর পর গত ২৮ শে ফেব্রুয়ারি এনরোলমেন্ট পরীক্ষার প্রথম ধাপ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসেও পরীক্ষার দাবিতে ও সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায় কার্যকর করার আবেদন জানিয়ে আমরণ অনশন এবং সেই অনশন সর্বোচ্চ আদালতের আঙ্গিনায় অনুষ্ঠিত হওয়া একটি বিরল ঘটনা। আইনের ছাত্রদের এবং ভবিষ্যৎ আইনজীবীদের আইন ও আদালতের প্রতি এমন শ্রদ্ধা একটি জাতির জন্য অবশ্যই আশা জাগানিয়া একটি বিষয়।
আমাদের শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সৌভাগ্য জাতির জনক যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন আমরাও সেই বিষয়ের ছাত্র ছিলাম কিন্তু সেই বিষয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা একটি পরীক্ষার জন্য, সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের প্রাঙ্গণে আমরণ অনশন করা ও বছরের পর বছর অপেক্ষা করা সত্যিই দুঃখজনক।
“দারুল ইহসান বনাম বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ” মামলায় ২০১৭ সালে আপিল বিভাগ যে রায় দেয় সেখানে বার কাউন্সিলের প্রতি (১২) টি নির্দেশনা দেয়। উক্ত রায়ের (১২) নাম্বার নির্দেশনায় বলা হয়েছে ” The Bar Council shall complete the enrollment process of the applications to be enrolled as advocates in the district courts each calendar year.”। এই নির্দেশনাটি নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বছর থেকে কার্যকর হবে। আইনের ছাত্র হিসেবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নিকট শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অনুরোধ এই মুজিব বর্ষ ২০২০ সালেই উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনাটি কার্যকর করা হোক।
যেহেতু করোনা ভাইরাস এর কারনে বিশ্ব জুড়ে মহামারি চলছে এবং এমতাবস্থায় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং অনেক প্রাণহানির আশংকা থাকে। এই মহামারীর অবসান কবে হবে সেই বিষয়েও সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। সেক্ষেত্রে বার কাউন্সিল বিকল্প ভাবতে পারে। বার কাউন্সিলের বর্তমান কমিটি যদি মেয়াদের শেষ সময়ে এসে রায় অনুযায়ী প্রতি ক্যালেন্ডার ইয়ারে এনরোলমেন্ট পরীক্ষা সম্পন্ন করার বিষয়টি নিশ্চিত করে তাহলে একদিকে জাতির পিতা ও উচ্চ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ হয় অন্যদিকে মুজিব বর্ষে আইনাঙ্গনের জন্য সেটি অনেক বড় উপহার হয়। এজন্য প্রয়োজন বার কাউন্সিলের উদ্যোগ এবং আন্তরিকতা।
অতীতে বহুবার আইনের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি এবং উচ্চ আদালতের প্রতি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আন্তরিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে সর্বশেষ ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা।
স্বল্প সময়ের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন কার্ড বিতরণ করে ফরম ফিলাপ সম্পন্ন করে নির্ধারিত তারিখেই পরীক্ষা সম্পন্ন করা বার কাউন্সিলের আন্তরিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এছাড়াও আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ বার কাউন্সিল “দারুল ইহসান বনাম বাংলাদেশ বার কাউন্সিল” মামলার আপিল বিভাগের রায়ের (৭) নাম্বার নির্দেশনাটি “No private university shall issue Bachelor of Law degree unless such person undergoes four years education in law course and this direction shall have prospective effect. No public or private university shall admit students in bachelor of law course more than 50 ( fifty) students in a semester.” এবার কার্যকর করেছে এবং এই (৭) নাম্বার নির্দেশনা লঙ্গন করে যেসব ইউনিভার্সিটি ৫০ এর অধিক স্টুডেন্ট ভর্তি করেছিলো তাদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড প্রদান করতে অপারগতা জানায়, সবশেষে বিষয়টি উচ্চ আদালত থেকে নিষ্পত্তি হয়ে আসে এবং যেসব ইউনিভার্সিটি উক্ত নির্দেশনাটি লঙ্ঘন করেছে তারা জরিমানা প্রদান করে। এর প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের বরাবর বার কাউন্সিল রেজিস্ট্রেশন কার্ড ইস্যু করে। বার কাউন্সিলের নিকট শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অনুরোধ একই মামলার (১২) নাম্বার নির্দেশনা যেনো ২০২০ সাল এই মুজিববর্ষ থেকেই কার্যকর করা হয়।
লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা যেহেতু সময় সাপেক্ষ বিষয়, সেহেতু জুনের মধ্যে যদি বার কাউন্সিল কবে লিখিত পরীক্ষা নিবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারে সেক্ষেত্রে গেজেট প্রকাশ করে আপিল বিভাগের নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করে দীর্ঘ জটের অবসান ঘটাতে পারেন। অন্যথায় লিখিত পরীক্ষা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটকে যাবে, এনরোলমেন্ট পরীক্ষার জট দীর্ঘায়িত হবে। পরবর্তী প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পিছিয়ে যাবে। বর্তমান পরীক্ষার কার্যক্রম শেষ হতে আরো দেড় থেকে দুই বছর সময় অতিবাহিত হবে। যদি বিষয়টি সেদিকে যায় তাহলে বর্তমান কমিটির অধীনে কোনো এনরোলমেন্ট পরীক্ষা পুরোপুরি সম্পন্ন হবে না। এটি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা হবে।
পরীক্ষার এই দীর্ঘ সূত্রিতা সহসায় নিরসন না হলে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের মধ্যে হতাশা বাড়বে এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের জীবনের মূল্যবান সময় গুলো নষ্ট হবে। বেকারত্বের অভিশাপ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের উপর আরো দীর্ঘ স্থায়ী হবে। রাষ্ট্রও এই বোঝা এড়িয়ে যেতে পারবে না। তাই সবদিক বিবেচনা করে মুজিব বর্ষেয় আপিল বিভাগের রায়টি কার্যকর করা হোক এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সকল অনিশ্চয়তার অবসান ঘটানোর জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
আইনুল ইসলাম বিশাল : শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা আইনজীবী সমিতি