জেসমিন সুলতানা :
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। মেঘে মেঘে বেলা কম হলোনা।
আইন পেশায় আমার শুরুটা ১৯৯৪ সনে। বাংলা সাহিত্যে সন্মান সহ মাস্টার্স করে ছিলাম রেজাল্টও ভালোই ছিলো, ভেবেছিলাম একজন শিক্ষক হবো, গরগর করে সাহিত্যকে তুলে ধরবো ছাত্র ছাত্রীর মাঝে। আবৃত্তি করবো নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে।
আমাকে আমার মনকে, আমার পেশা নির্বাচনের লক্ষ উদ্দেশ্যকে পরিবর্তন করে দিলো কুমিল্লার বিশিষ্ট আইনজীবী, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, বার কাউন্সিলের তৎকালীন অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহামেদ আলী সাহেব।
স্বামীর চাকুরী সুবাদে ছাত্রী থাকাকালীন ক্লাস করার খুব সুযোগ পাইনি কিন্তু সংসার করতে ও গড়তে আমার কুমিল্লায় বাগিচাঁগাও এ খালুজানের সান্নিধ্যে আসা। তখন তিনি কুমিল্লার চাঞ্চল্যকর নিদারাবাদ হত্যা মামলার আসামী পক্ষের আইনজীবী। ওনাকে দেখতাম কি নিষ্ঠার সাথে চেম্বারে সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, রাত নেই কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। ওনার পেশার প্রতি একাগ্রতা আমাকে আকৃষ্ট করলো। ওনি আইনজীবীদের নেতা, ভাল আইনজীবী, সর্বোপরি ভাল মানুষ। ওনাকে দেখার পরই সিদ্ধান্ত নিলাম আইনজীবী হবো।
ইতিমধ্যেই স্বামীর পোস্টিং কক্সবাজারে। মাষ্টারর্স পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এল,এল,বি ভর্তি হলাম। দ্বিতীয় শ্রেনী পেলাম। তখন বা এখন কেউ প্রথম শ্রেনী পেয়েছে কিনা জানা নেই। আমরা দুজন পেয়েছিলাম, এর মাঝে দুটো মেয়ে নিজে জীবন যুদ্ধ সাথে পড়াশুনা খুব কুসুমাস্তীর্ণ ছিলোনা; তবে পরিবারের সবার সহযোগিতা ছিল।
পাশ করার পর বার কাউন্সিলের সনদ নিতে গিয়ে আমার ইন্টিমেশন দিয়েছিলাম আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বোন জান্নাতুল মাওয়া আরজুর বাবা এড আবুল বশর সাহেবের অধীনে।
এনরোলড হওয়ার পর এড আয়াসুর রহমান নিয়ে গেলেন একটি চেম্বারে আমার সিনিয়র, মেন্টর বড় ভাই ফৌজদারী আইনে বিশেষজ্ঞ এড জাহাঙ্গীর সাহেবের চেম্বারে। ঐ চেম্বারে পেশার প্রতি ওনার একাগ্রতা, সততা, মেধার চর্চা সব দেখেছি, শুনেছি, আয়ত্ব করেছি।
শুরু হলো জীবনের পট পরিবর্তন। প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টায় চেম্বারে যাওয়া রাত নটা দশটায় ঘরে ফেরা। চেম্বারে আমি সহ আরো পাঁচজন পুরুষ আইনজীবী ছিল। সিনিয়র সব সময় কক্সবাজারের তখন কার সময়ের বড় বড় চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো করতেন। শুধু ৪৯৮ নয় সাক্ষী, জেরা, আর্গুমেন্ট, নজীর উপস্থাপন কি সুন্দর করে গবেষনা করেছি, শিখেছি ঐ চেম্বার থেকে তা আজও বয়ে চলেছি।।
শুরু করলাম কোর্টে যাওয়া দেখতে মনে হয় খারাপ ছিলাম না, স্মার্টলি চলতাম। কক্সবাজার খুব কনজারভেটিভ জায়গা সেখানে দাঁড়ানো আমার জন্য সহজ ছিলোনা, বিস্তারিত নাই বললাম। অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।
প্রতিদিন সিনিয়রের চেম্বারে যাই, মক্কেল আসে, টাকা বেশ ইনকাম সিনিয়রের। মক্কেল সর্বোচ্চ, ভাবতাম আমার কাছে কি কখনো ক্লায়েন্ট আসবে? কক্সবাজার বাড়ি নয়, স্বামীর বাড়ি নয়, এখনো ছোট উকিল, কে আসবে কেন আসবে?
তবে হাল ছাড়িনি। আমরা কোর্টে তিনজন নারী আইনজীবী; একজন এড রেবেকা সুলতানা, যিনি আমাকে বড় বোনের মতো জড়িয়ে রেখেছিলেন, এড শামিম আরা স্বপ্না ভাল সম্পর্ক ছিলো আর আমি। কোর্টে, চেম্বারে আসি যাই। শিখি আর শিখি। এরপর মনে হলো সিভিল একটু শিখে ফেলি, যাওয়া শুরু করলাম সিভিলে দক্ষ এড আবুল কালাম সাহেবের চেম্বারে। সিভিলে পা দিয়ে দেখি মহাসমুদ্র। এখানে শেখার শেষ নেই। সাঁতার কাটতে থাকলাম।
ইতিমধ্যে আমার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায়। আমি কক্সবাজার মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। সবাই আমাকে ১৯৯৮ সনে বানিয়ে দিল এ,জি,পি। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। কাজ করছি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ উইমেন লইয়ারস এসোসিয়েশন এর আইনজীবী হলাম। কৃষি ব্যাংকে হলাম, রূপালী ব্যাংকে হলাম, ফিসারিজ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন এর আইনজীবী হলাম। কাজ আর কাজ। আর ভাবতে হয়নি আমি কক্সবাজারের না।
একসময় ঢাকায় চলে আসার সিদ্বান্ত হলো। হাইকোর্টে এনরোলড আগেই, তাই ভাইবা দিয়ে সদস্য হলাম সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির। চিনি না কিছুই কোর্টের উত্তর, দক্ষিন, পূর্ব, পশ্চিম। শুরু হলো এক অন্যরকম যুদ্ধ। মেধা, মনন, পেশা, অর্থ আর প্রতিকূলতার যুদ্ব। একটি চেম্বারে কাজ শুরু করলাম। আসার এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হলো মামলা আসা। প্রথমেই আসলো একটি ফাষ্ট আপিল। আমি তো ড্রাফটিং কিছুই জানিনা। মামলার ২০,০০০/ টাকা ফাইল দিলাম সিনিয়রের হাতে ওনি আমাকে ৩০০০/- টাকা সাথে ১ টাকা হাতে দিলেন আর তৎকালীন ২০০০ সনের কথা। মামলার ফাইল, টাকা দিয়েছি কিন্তু সিনিয়র সময় পাচ্ছেন না তাই ফাইলের ফিতাও খুলছেন না। এ দিকে সিভিল মামলার লিমিটেশন, ফাইলিং। কান্নাকাটি শুরু করলাম। পরে দায়ের হলো মামলা, ষ্টে, স্ট্যাটাসকো সবই হলো।
কক্সবাজারবাসীর সাথে সুসম্পর্কের কারণে এবং একটি খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীর জুনিয়র হিসেবে কাজ করার কারণে সিনিয়রের সহযোগিতায় আমার কাছে সিভিল, ক্রিমিনাল, রীট সবই আসা শুরু হলো। তবে যে সিনিয়রকে মামলা দেই বিশেষ করে এন্টিসিপেটরীতে মক্কেল সহ নিয়ে যায়। একি বিস্ময়! আমি অবাক। কি করবো? কোথায় যাবো? কে সহযোগিতা করবে?
আমি হতাশ, দ্বিগবিদিক শূন্য হয়ে ভাবছি কি করবো, কোথায় পাবো ভাল মানুষ, ভাল চেম্বার, ভাল সিনিয়র। তখনকার সময় বিচারপতিগণ ছিলেন জাদরেল। সিনিয়রগণও ছিলেন তেমনি; ব্যারিস্টার ইসতিয়াক আহমেদ, ব্যারিস্টার টি, এইচ খান, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিষ্টার রোকন উদ্দীন মাহমুদ, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন স্যারদের আর্গুমেন্ট মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতাম আর ভাবতাম আমিও কি পারবো? প্রথম প্রথম সামনে দাঁড়াতেই পা কাঁপতে থাকতো। এক সময় বিচারপতি বদরুল হক বাচ্চু সাহেবের কোর্টে দেখা হলো, আমার সিনিয়র জাহিদুল বারি সাহেবের সাথে ওনি আমাকে চিনতেন কক্সবাজারের সিনিয়র আবু বকর ভাইয়ের মাধ্যমে।
স্যার ডাকলেন ওনার চেম্বারে, বললেন ওনার চেম্বারে আমি কাজ করতে পারি। আমি অকুল সাগরে হাবু ডুবু খাওয়া মানুষটি খড়কুটো আটকে বাঁচতে শুরু করলাম। চেম্বারে যাওয়া শুরু হলো। ভাবী বর্তমানে এডভোকেট, বিশ্বজিৎ দেবনাথ, অমিত চক্রবর্তী, ব্যারিস্টার জাকির হোসেন; কোর্টে সবাই মিলে আন্তরিকতা পূর্ন পরিবেশে কাজ শিখতে লাগলাম। বাসা বাসাবো, চেম্বার দীলু রোড, তখন গাড়ী ছিলোনা, আমার হাজব্যান্ডের পোস্টিং ছিলো সোনারগাঁতে; প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে এসে বসে থাকতো সদ্য করোনায় মৃত বন্ধু ডঃ মহিউদ্দিনের চেম্বারে। রাত দশটায় বাসায় ফিরতাম। একটি মেয়ের জন্য, এ পরিশ্রম পরিবারের জন্য সুখকর তো নয়ই কষ্টেরও বটে।
একসময় স্বাবলম্বী হয়ে নিজেই দাঁড়াতে শুরু করলাম। বেছে বেছে মামলা নিতাম বলে আমার সাফল্যের হার ১০০%। পেশায় পূর্বপুরুষ, ভাই, বন্ধু পরিবারের কেউ না থাকা একজন নারী আইনজীবীর জন্য কতো কঠিন কতো কষ্টের আমি ছাড়া ভুক্তভোগী আর কে জানে। বড় বড় মামলাগুলো যখন আসতে লাগলো বিশেষ করে ১/১১ কক্সবাজার আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাদের মামলা করেছি। তখন সিনিয়র ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন স্যারের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। চলছে পেশা, বসার জায়গা নেই, চেম্বার নেই, পেশার সাথে সাথে এখানকার রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। ২০০০ সনের পর থেকে সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচন গুলোতে, মিছিলে মিটিং এ আন্দোলনে সংগ্রামে সবার সাথে কাজ শুরু করেছিলাম। ইতিমধ্যে ব্যারিস্টার রোকনদ্দীন মাহমুদ স্যার সভাপতি, ওনাকে অনুরোধ করার পর আমার সিনিয়রের পুরনো একটি রুম তিনি বরাদ্দ করলেন।
সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে ওয়াষ্ট রুম ছিলো সেটি। বরাদ্দের পর রুমটিতে নাক ঢুকিয়ে দেখলাম অসম্ভব, কিভাবে বসবো? তারপর অসম্ভব অসুন্দর রুমকে সুন্দর করে সাজিয়ে ফেললাম সিনিয়র তবারক হোসেন স্যার এবং বর্তমান মাননীয় বিচারপতি নাজমুল আহসান সাহেবের সহযোগিতায়। আজো চলছি, চলতে হবে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা।
নারী আইনজীবীদের চেম্বারে কাজ করা, সিনিয়র দেয় সাথে কাজ করা অনেক কঠিন, যদিও বেশীর ভাগ সিনিয়রগণই ভাল। তবে খারাপ হলে জীবন বিপন্ন, ফিরে যাওয়া ছাড়া পথ থাকেনা, ফিরে গেছেও অনেকে। মেয়েদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন একটু বসার জায়গা, একটি ভাল চেম্বার, একজন নৈতিকতা সম্পন্ন ভাল সিনিয়র।
আমাদের সন্তান সম্ভবা আইনজীবী বোনেরা বা সদ্য সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া আইনজীবী বোনদের সমূহ কষ্ট স্বীকার করে পেশা চালাতে হয় কোর্ট চত্বরে। নতুন পুরাতন বিল্ডিং মেয়েদের আলাদা টয়লেট নেই, নেই ব্রেস্ট ফিডিং এর আলাদা কক্ষ। যৌন হয়রানী বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়ে কমিটি করার কথা থাকলেও নেই কোন কমিটি। বাচ্চাদের জন্য মায়ের মন সব সময় কাঁদে তাই বাচ্চাকে কাছে রেখে প্রফেশন চালানোর জন্য নেই পর্যাপ্ত সুবিধা সম্পন্ন, নির্বিঘ্ন ডেকে কেয়ার সেন্টার।
তবে আশাবাদী পেশায় এখন অনেক মেধাবী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন আইনজীবী বোনেরা এসেছে, বেশ ভালো করছে, সুনাম অর্জন করছে তাদের দেখে আনন্দিত হই, ভবিষ্যতের সুখ স্বপন রচনা করি।
করুনা হয় কিছু নারী আইনজীবীদের যারা লোভে পরে দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায়। আসলে যখন দুকান কেটে যায় তখন কোন কিছু পরোয়া করে না ভয়ও করে না।
গর্বিত হই সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে মহিলা আইনজীবীরা যখন ভাল পারফরম্যান্স দেখায়। প্রতিবন্ধকতা থাকবে, বাধা থাকবে, সব থাকবে তারপরও আমরা আশায় থাকি নিশ্চয়ই নতুন ভোরের আলোয় আলোকিত হবে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নারী আইনজীবীরা এগিয়ে যাবে অভিষ্ট লক্ষ্যে।
নারীরা আসলে জনম দোষী। এতো স্টাইল কেন? এতো সাজার কি দরকার? চুল কেটেছে কেন? চুল লাল করেছো কেন? লাল লিপস্টিক পেরেছো কেন? বোরকা পরেনা কেন? স্যুটেড বুটেড কেন? নির্বাচনে দাঁড়াতে চাও কেন? বিচারপতি হবে কি যোগ্যতা? এটর্নি জেনারেল অফিসে যাবে কার রেফারেন্স? সিনিয়রদের চেম্বারে যাও কেন? এতো বেশী মামলা ওর কাছে আসে কেন? ছেলে মেয়ে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করিয়েছে টাকা পেলো কোথায়? সব দোষ নন্দ ঘোষদের।।
আসলে আমরা নিজেরাই এ কাজটি বেশী করি।
শুভকামনা ভাইদের জন্য তোমাদেরও প্রতিবন্ধকতা কম সহ্য করতে হয়না। সবাই অপেক্ষা করি, একটি সুন্দর আগামীর।
জেসমিন সুলতানা : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সংগঠক