কাজী শরীফ:
সাংবাদিক নোমান মোহাম্মদ তার “নট আউট নোমান” নামক অনুষ্ঠানে আজকের বাংলাদেশের সাবেক উপস্থাপক ও বর্তমানে ডয়েসে ভেলের সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করেছেন “সাংবাদিকতার জন্য কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ – দক্ষতা না সততা?”
জনাব মুহিউদ্দীন জবাব দিয়েছেন সততা। তিনি আরও করে বলেছেন সাংবাদিকতা করতে হলে সততা থাকতেই হবে। দক্ষতা কাজ করতে করতে অর্জিত হয়।
আমি মনেকরি জনাব মুহিউদ্দীন ঠিক কথাটিই বলেছেন। আমি সততা ও দক্ষতা নিয়ে ভাবলাম। ভেবে মনে হলো –
যেকোন পেশার জন্য দক্ষ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ডাক্তার যখন রোগীর চিকিৎসা করেন তখন তাকে সে কাজে অবশ্যই দক্ষ হতে হবে। অস্ত্রোপচারের মত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ একজন ডাক্তার কী অসাধারণভাবে করেন! আমরা এ সম্পর্কে বলার সময়ও বলি ” ডাক্তার সাহেব কী নিপুণ দক্ষতায় অপারেশনটা করলেন!”
আবার একজন বিচারক যখন আইনের কঠিন মারপ্যাঁচকে সরলীকরণ করে মোকদ্দমার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেন সেটাও তার দক্ষতার পরিচায়ক।
এখন শিক্ষক একটা বিষয়বস্তুকে কতটা সহজ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে ছাত্রের সামনে উপস্থাপন করেন এটা নির্ভর করে সে বিষয়ে তার দক্ষতার উপর।
একজন আইনজীবী কত সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে তার মক্কেলের অবস্থান আদালতে প্রতিষ্ঠিত করছেন তাও নির্ভর করে বিজ্ঞ আইনজীবীর দক্ষতার উপর।
আমাদের বাসায় প্রায় প্রত্যকে নারীই রান্না করতে জানেন। তারপরও কারো গরুর মাংস ভালো হয়, কারো ভালো হয় মুরগি আর কেউ সেরা চা বানানোয়। প্রত্যেকটা বিষয়ই তার দক্ষতার নির্দেশক।
এরকম প্রত্যেকটি পেশায় দক্ষতা খুবই দরকার। অদক্ষ লোক দিয়ে উন্নতি অসম্ভব। তাই দক্ষতার প্রয়োজনীতা অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পেশার মানুষটি যদি অসৎ হন তখন তার সে দক্ষতার কোন মূল্য নেই! বরং সেটা বেশি ক্ষতিকর। তিনি যে দক্ষতা অর্জন করেছেন তা অসৎ কাজে লাগালে অদক্ষ অসৎ মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়।
দক্ষ ডাক্তার যদি রোগীর রোগ নির্ণয় করার পরও শুধু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনের লোভে রোগীকে টেস্ট করান কিংবা ইচ্ছা করে প্রয়োজন না থাকলেও প্রাইভেট ক্লিনিক বাঁচিয়ে রাখতে সিজার করান তাহলে তিনি যত দক্ষই হন না কেন তিনি অসৎ। অসৎ ব্যক্তি তার স্বার্থে পেশার মর্যাদা জলাঞ্জলি দিতে পারে নির্দ্বিধায়।
একজন বিচারক যদি অর্থের প্রলোভনে ন্যায়বিচার না করেন তাহলে তার সে দক্ষতা রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরুপ। সবচেয়ে বড় অন্যায় করেন ন্যায়বিচারবঞ্চিত মানুষটির প্রতি। বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরে যদি ন্যায়বিচার বঞ্চিত হন তবে তেমন দক্ষ বিচারকের প্রয়োজন নেই!
একজন আইনজীবী যদি মক্কেলকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্থ আদায় করেন তবে তিনি যত দক্ষই হন না কেন আখেরে তিনি অসৎ। যে আইনজীবী অসততার সাথে বসবাস করেন তার কাছ থেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা আশা করা অবাস্তব ও হাস্যকর।
যে শিক্ষক ক্লাসে নিয়মিত না এসে শিক্ষক রাজনীতি ও দলের দালালি করে দিন ব্যয় করছেন তিনি কীভাবে ভালো শিক্ষক হন তা আমার বিবেচনাতেই আসেনা। শিক্ষকের মূল কাজ পড়ানো, গবেষণা করা কিংবা প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় শিষ্যের আত্নাকে উদ্বোধিত করা। শিক্ষক যদি ক্লাসেই না আসেন তিনি এ কাজগুলো করবেন কীভাবে? সুতরাং অসৎ শিক্ষক থাকার চেয়ে না থাকাই উত্তম।
আমাদের ঘরের নারীরা যে যাই ভালো রান্না করুক তাকে তা দক্ষতার সাথেই করতে হয়। কিন্তু তিনি যদি তার এ দক্ষতাকে ঘরের অন্য সদস্যদের উপর ছড়ি ঘোরানোর কাজে ব্যয় করেন তাহলে তার উদ্দেশ্য অসৎ। যে কাজের উদ্দেশ্যই অসৎ আখেরে তার ফল ভালো হয়না!
একজন দক্ষ চোরের কাছ থেকে চুরি ছাড়া কিছু আশা করা যায়না। কিন্তু একজন সৎ মানুষ সততার সাথে পরিশ্রম করলে সংশ্লিষ্ট কাজে তার দক্ষতা আসবেই। দক্ষ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আসুন আমরা সৎ হই। সততার সাথে নিজ পেশাকে ভালোবাসি। পেশার মর্যাদা রক্ষা করি। একজন দুজনের জন্য পুরো পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করি। সৎভাবে চেষ্টা করলে দক্ষ আমরা হবোই! সৎ ও দক্ষ পেশাজীবীদের দ্বারাই বদলে যাবে আপনার আমার বাংলাদেশ।
কাজী শরীফ : সহকারী জজ, নোয়াখালী