ব্যারিস্টার চৌ: মুর্শেদ কামাল টিপু :
বর্তমানে বাংলাদেশে আইন পেশা একটি খুবই জনপ্রিয় পেশা। নিকট অতীতে আমাদের দেশে আইন পেশাকে অনেকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। এ পেশাকে নিয়ে আমাদের দেশে কয়েকটি মিথ প্রচলিত ছিল, যেমন- (১) যার নাই কোন গতি সে করে ওকালতি, (২) উকিলরা ঘুষ খায়, (৩) a good lawyer is a great lier, (৪) উকিলদের রোজগার হালাল নয় ইত্যাদি।
আমার পিতা আইনজীবী ছিলেন বলে স্কুলে সহপাঠীদের সাথে ঝগড়া লাগলে অবুঝ সহপাঠিদের কাছ থেকে উপরে বর্ণিত ২ নাম্বার ও ৩ নাম্বার অপবাদ অহরহ শুনতে হতো। তবে অনেক শিক্ষিত, এমনকি সুশিক্ষিত মানুষরা উপরে বর্ণিত ৩ ও ৪ নাম্বার মিথে বিশ্বাসী। এমনকি অনেক আইনজীবীরা ও তা বিশ্বাস করেন।
আমার এক আইনজীবী আত্বীয় হজ্ব করতে মনস্থির করার পর উনি আর কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলে উনি হেসে হেসে বলেছিলেন হজ্বে যাওয়ার আগে নিজেকে পিউরিফাই করার চেষ্টা করছি। তা শুনে যতটা না আহত হয়েছিলাম তারচেয়েও অবাক হয়েছিলাম উনার জ্ঞানের স্তর কতটুকু তা উপলব্ধি করতে পেরে, যদিও দেশের একটা বার সমিতির বিজ্ঞ সদস্যরা তাকে দুইবার ওই সমিতিতে সম্পাদক নির্বাচিত করেছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে আইনপেশা জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে এ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন সাবজেক্ট চালু করায় এবং তাদের বাহারি বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে মেধাবী ছাত্রদের সাথে মেধাহীন ছাত্ররাও আইন পড়া শুরু করলো। আবার বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। তাদের সংবাদ বুলেটিনে প্রতিদিনই ৩/৪ মিনিট সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ন নিউজ প্রতিবেদন সম্প্রচার করে থাকে। শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ করে তা নয় অনেক নবীন আইনজীবীর পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (PIL) এর সংবাদ প্রচার করে নিজেদের পাবলিসিটি ইন্টারেস্ট লিটিগেশনে রূপান্তরিত করে। ওই সব সম্প্রচারে Writ , Quashing, Rule Nisi ইত্যাদি শব্দগুলো খুবই শ্রুতি মধুর, ফলে সবারই একটা আকর্ষন থাকে।
১/১১ রেজিমে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা সমূহে টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ পরিবেশনা বাংলাদেশে আইন পেশাকে অতি জনপ্রিয় করে তোলে। ওই সময় লন্ডন থেকে বার কম্প্লিট করার পর দেশে এসে একটি অতি জনপ্রিয় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলাম। একবার চতুর্থ বর্ষের ভাইবা পরীক্ষায় এক সুদর্শনা ছাত্রীকে কেন সে আইনজীবী হতে চায় জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিল সে সেলিব্রেটি হতে চায়। জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় ল’ পাশ করে বিশাল সংখ্যক ছাত্র প্রথমেই ধাক্কা খায় এনরোলমেন্ট প্রসিডিওরের সময় ক্ষেপনে। দ্বিতীয় দফা ধাক্কা খায় কোর্টে শিক্ষানবীশ হিসেবে জয়েন করার পর। নিম্ন আদালতে প্রতিদিন সামান্য হলেও কিছু টাকা সিনিয়র আইনজীবীদের দেয়ার সুযোগ থাকে। কারণ সেখানে হাজিরা সাবকাশ ইত্যাদি ব্যাপার আছে। কিন্তু উচ্চ আদালতে সেই সুযোগ নাই। তাই যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্ররা আইন বিষয়ে পড়ালেখা করে সেই স্বপ্ন বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রে এসে ভেংগে যায়।
ব্যাপারটা এরকম যে , প্লেইনে যাত্রীর সিটে বসে ককপিটের আসনটিকে খুবই রোমাঞ্চকর ও আনন্দদায়ক মনে হয়। কিন্তু যখন ওই যাত্রীকে ককপিটের আসনে বসিয়ে প্লেইনের নিয়ন্ত্রন দেয়া হয় তখন সে বুঝতে পারে ককপিটের আসনটা কতোটা ঝুকিপূর্ণ এবং তাও বুঝতে পারে পূর্বের উপলব্ধি ছিল সমপূর্ন উল্টো। আইনপেশায় একজন নবীন আইনজীবীর স্বাবলম্বি হতে হলে তাকে কমপক্ষে পাচ বছর অপেক্ষা করতে হয় – তা না বুঝেই ছাত্ররা আইন বিষয়ে পড়া শুরু করে।
আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে সংসারের বড় ছেলে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন না দেখে। যে পরিবার সন্তানের পড়ালেখা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার আয়ের উপর সেই সংসার নির্ভর করতে হবে তার আইনজীবী হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সংসারের অন্য সদস্যের বেকআপ ছাড়া একজন আইনজীবী কখনোই দাঁড়াতে পারবে না। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম – বিষয়টা এরকম নয়। নবীন আইনজীবীরা এই বাস্তবতা যারা মেনে নিতে পারবে তারাই আসুক এ মহান পেশায়। নতুবা এ পেশায় হতাশা বাড়তেই থাকবে।
হতাশা দূর করতে বার কউন্সিলের বিরাট ভূমিকা আছে। আইন পেশার বাস্তবতা তুলে ধরতে বার কাউন্সিলকে ভূমিকা রাখতে হবে এবং আইনজীবী সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। লাইসেন্স দিবেন কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ইনকামের ব্যবস্থা নাই তা কেমনে মেনে নিবে লাইসেন্সধারীরা? দেশে আইনজীবীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সময় এসেছে। বিগত বছরগুলোতে বার কাউন্সিল যে অধিক সংখ্যক আইনজীবীদের সনদ দিয়েছে তার ফল হচ্ছে নবীন আইনজীবীদের মধ্যে চরম হতাশা। অবস্থা এমন যেন মক্কেল থেকে উকিলের সংখ্যা বেশী হয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে কোর্ট বন্ধ থাকায় জীবিকার অভাবে সোশাল মিডিয়ায় নবীন – প্রবীন আইনজীবীরা যে ভাবে হা-হুতাশ করছেন তাতে আমার মনে হয় বার কাউন্সিল অচিরেই উপলব্ধি করবে যে, অতীতে আইনজীবী সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করাটা বিরাট ভুল হয়েছে।
ইন্ডিয়ায় আইনজীবী সংখ্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য সাত বছর আগে অগ্রীম ঘোষনা দিয়ে পাচ বছরের জন্য এনরোলমেন্ট পরীক্ষা স্থগিত করে আশানুরুপ ফল পেয়েছিল। পেশা ও পেশাজীবীদের হতাশা থেকে বাঁচাতে ও ডিগনিটি রক্ষা করতে অবিলম্বে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল একি রকম গুরুত্বপূর্ন সিদ্বান্ত নিবে বলে আশা রাখি।
ব্যারিস্টার চৌ: মুর্শেদ কামাল টিপু : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট