জয়নাল আবেদীন মাযহারী, অ্যাডভোকেট

আইনাঙ্গনে টাউট দালাল যেভাবে চিহ্নিত করা যাবে…

জয়নাল আবেদীন মাযহারী :

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ ও ৩১ তম অনুচ্ছেদ দেশের সকল নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমানভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রদান করেছে। মানুষ যখন তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা অন্যের দ্বারা অত্যাচারের শিকার হয় তখন আবশ্যিকভাবে আইনের আশ্রয় লাভ করা ব্যতিত তার জন্য আর কোন রাস্তা খোলা থাকে না। এমতাবস্থায় আপনি আইনের আশ্রয় লাভ করে আইনী প্রতিকার পাওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্ত হবেন। আদালতে আপনাকে আইনী প্রতিকার দেওয়ার জন্য একমাত্র যিনি লড়াই করবেন তিনি হচ্ছেন আইনজীবী বা উকিল।

তাহলে আপনি আপনার কাঙ্খিত প্রতিকারের জন্য সরাসরি একজন ন্যায়পর আইনজীবীর শরণাপন্ন হওয়াই আপনার ন্যায় বিচার প্রাপ্তির প্রথম ধাপ ধরে নিতে পারেন। আইন পেশার অতীত ইতহাস যেহেতু অনেক সমৃদ্ধ সেহেতু আইনজীবিদের অতিত ইতহাস আরও উজ্জল। বর্তমানে আইনাঙ্গনে ন্যায়পর আইনজীবী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কেন না এই পেশায় অন্যায়ভাবে সাধারন মানুষের রক্ত চুষে টাকা কামাই করার ভাব এসেছে, এসেছে সহজ সরল মানুষের সাথে প্রতারনা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কায়দা কানুন। ভালো আইনজীবী যে নাই তা নয়। অবশ্যই আছে, কিন্তু আপনাকে কষ্ট করে খুঁজে নিতে হবে। আপনার এই কষ্টটাই আপনাকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে সহায়তা করবে বৈ কি। মনে রাখবেন আইনজানা ভালো আইনজীবীগণ কখনও টাউট দালাল লালন করেন না।

আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাক্টিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ এর ৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলকে বার কাউন্সিল কতৃক সনদপ্রাপ্ত হতে হবে। আইনজীবী ব্যাতিত অন্য কেহ অর্থাৎ কোন দালাল, টাউট, কোর্টের ষ্টাফ এমনকি মুহুরীও কোন মামলা গ্রহন করতে পারবে না। কেহ এর ব্যত্যয় ঘটালে তার ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অপর দিকে কোন অসৎ আইনজীবি কোন দালাল বা টাউট নিয়োগ করে তার পেশা পরিচালনা করলে তার সনদ বাতিল হওয়ার বিধান পর্যন্ত রয়েছে।

আপনি জেনে আশ্চর্য্য হবেন যে, আমাদের কিছু অপেশাদার অসাধূ বেশী মুনাফাখোর আইনজীবী মামলা পাওয়ার এবং তার পক্ষে সাফাই গাইবার জন্য সর্বত্র দালাল নিয়োগ করে রেখেছেন। উক্ত আইনজীবী ওই টাউট দালালের মাধ্যমে অসহায় মানুষকে বিভিন্নভাবে ফাঁন্দে ফেলে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়ে দালাল এবং আইনজীবী উভয়ে ভাগ বাটোয়ারা করে আত্মসাৎ করে । আবার অনেক ক্ষেত্রে দালাল বা টাউট আপনার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আপনার নিকট থেকে বিপূল পরিমান টাকা হাতিয়ে নেয় আপনাকে আইনী সুবিধার বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই আপনার প্রদত্ত উক্ত টাকা আইনজীবীর পকেট পর্যন্ত পৌঁছে না এবং আপনি কোন আইনী সুবিধা না পেয়ে প্রতারিত হয়ে আইনজীবীকে দোষারোপ করে থাকেন। তাদের এমন অসৎ কার্য্য কলাপের জন্য আজ গোটা আইনজীবী সমাজ সাধারন মানুষের দৃষ্টিতে ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে আছেন। অথচ এই আইনজীবী সমাজ ব্যতিত আপনি ভুক্তভোগী নিজেকে কল্পনাও করতে পারার কথা নয়।

আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি, মহামান্য হাইকোর্ট সম্প্রতি সারা দেশের সব আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ভুয়া আইনজীবী, টাউট, দালাল, ভুয়া মুহুরি, যে মুহুরী নিজেই মামলা রিসিভ করে তাকে, ভূয়া ক্লার্ক শনাক্ত করে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বার কাউন্সিলকে নির্দেশ দিয়েছেন। সে জন্য প্রত্যেকটি বারের টাউট দালাল নির্মূল কমিটি টাউট দালাল পাকড়াও করার ব্যাপারে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।

আপনি যাদের দ্বারা প্রতারিত হন-

১) আপনি আপনার এলাকার কিছু মাতব্বর শ্রেনীর মানুষের মুখে বিশেষ কোন আইনজীবীর পক্ষে সাফাই শুনবেন। এমতাবস্থায় আপনি ধরে নিতে পারেন ওই মাতব্বর সাহেব একজন টাউট কিসিমের লোক। আপনি আইনী কোন জটিলতায় পড়লে তার কাছে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কেন না সে অসৎ আইনজীবী মারফত আপনার নিকট থেকে কৌশলে তার দালালীর টাকা নিয়ে আপনাকে প্রতারিত করবে। আপনি বুজতেও পারবেন না। এতে আপনার বিপুল টাকা গচ্ছা যাওয়ার পাশাপাশি মামলা হেরে যাওয়ার বিজও বপন হতে পারে।

২) আপনি দেখবেন আপনার এলকার চিহ্নিত কোন ব্যক্তি হরহামেশা আদালতে আসা যাওয়া করে। আপনি ধরেই নিতে পারেন, সে আদালতের একজন বড় মাপের দালাল। সে আপনার কাছের কোন আত্মীয় হলেও আপনি তার কাছে আপনার সমস্যা নিয়ে গেলে আপনি প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। বাকি সিদ্ধান্ত আপনার।

৩) আপনার এলাকায় মুহুরী নামীয় একটি প্রানিকে আইনী বিষয়ে অনেক ব্রিফ দিতে শুনবেন।বুজতে হবে এই মুহুরী সাহেব আপনাকে ঘায়েল করার চেষ্টায় লিপ্ত আছেন। কোন মুহুরীর কাজ এটা নয় যে, সে এলাকায় মানুষকে আইনী বিষয়ে বিভ্রান্ত করবে। গ্রামে মুহুরীর কোন ফাংশন নেই। কোন মুহুরী আইনী বিষয়ে কথা বলা কিংবা আইনী বিষয়ে কোন সুযোগ ‍সুবিধার আশ্বাস দেওয়া চরম বে-আদবী এবং অন্যায়। আপনাকে বুজতে হবে মুহুরীকে কোন আইনজীবি নিয়োগ দেন শুধু মাত্র তার নির্ধারিত মামলায় অফিসিয়াল কাজে সহযোগীতা করার জন্য। এ ক্ষেত্রে তার কাজের পরিধি হলো নির্দিষ্ট মামলার তারিখ আপডেট করা, মামলার ফাইলপত্র এগিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। কোন মুহুরী নিজে কোন মামলা গ্রহন বা পরিচালনা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেন না কোন ব্যক্তি ডাক্তারি না পড়ে অপারেশন করতে গেলে যেমন রোগী মারা যাবে, ঠিক তেমনি মুহুরী দিয়ে আইনী কাজ পরিচালনা করলে আপনার মামলায় আপনি চরমভাবে পরাজিত হবেন এবং এটা ন্যায় বিচারের অন্তরায় বলে বিবেচিত।

৪) আপনার এলাকায় কোন ব্যক্তি নিজেকে আইনজীবি পরিচয় দিলে তার সনদ নাম্বার নিশ্চিত না হয়ে তার সাথে আইনী ব্যাপারে কোন লেনদেন করলে বুজতে হবে আপনি প্রতারিত হতে যাচ্ছেন। কেন না তিনি একজন ধূর্ত দালাল। আপনাকে ফাঁদে ফেলার জন্য সে আপনার নিকট আইনজীবী পরিচয় দিয়েছে। আপনি চাইলে এমন ব্যক্তিকে পুলিশে দিতে পারবেন।

৫) কোর্টের কোন স্টাফ আপনার মামলায় ন্যায় বিচায় পেতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। কেন না অনেক অসৎ স্টাফ দালালের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। সেও আপনাকে বিভিন্ন কৌশলে তার ফাঁদে ফেলে মামলা বাগিয়ে তারই কোন অসৎ অপদার্থ আইনজীবীকে রেফার করে মামলার বারটা বাজিয়ে দিতে পারে। প্রসঙ্গত কোর্টের কোন স্টাফ মামলা পরিচালনায় বিন্দু মাত্র ভুমিকা রাখার ক্ষমতা নাই। তাই তার মিষ্টি কথায় আপনি প্রতারিত হবেন না।

৬) বর্তমানে বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং সম্পূর্ন ঘুষ মুক্ত। তাই কোন রাজনৈতিক নেতা, উপনেতা, আমলা, কামলা, কোন নেতা, কোর্টের ষ্টাফ বা জজ সাহেবের মামু খালু পরিচয় দিয়ে ঘুষের অফার দিয়ে মামলায় সুবিধার আশ্বাস দিলে আপনি তাকে প্রতারক ভেবে তাড়িয়ে দিলে ভূল হবে না। আজকের এ যুগে কোন জুডিশিয়াল অফিসার ঘুষ খাওয়ার কথা কল্পনাতিত। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে বিচার বিভাগের উপর আস্থা রাখতে পারেন।

উপরোক্ত ব্যাক্তিদের সাথে আইনি জটিলতা নিরসনের ব্যাপারে সহযোগীতার আশ্বাসে আপনি কোন আর্থিক লেনদেন করবেন না। তাহলে আপনি প্রতারনার শিকার হতে পারেন। আর আপনি প্রতারনার শিকার মানে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত এবং আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হওয়া।

ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আরও কিছু কারণ-

ক) প্রচলিত শালিশ ব্যবস্থাঃ শালিশের অতিত ইতিহাস অনেক উজ্জল। অথচ বর্তমানে শালিশের নামে ভুক্তভোগীকে ন্যায় বিচারের আশ্বাসে বিভিন্নভাবে হয়রানী করা হয়। পেশী শক্তির বলে দূর্বল ভিক্টিম শালিশের জালে আটকা পড়ে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে অনেক বিলম্ব করে যখন আইনের আশ্রয় নিতে আসে তখন বিভিন্ন কারনে উক্ত মামলা ত্রুটি যুক্ত হয়ে যায়। তার একটি বিলম্বে আইনের আশ্রয় নিতে আসা, কেননা আইনের নিয়ম হচ্ছে justice is delyed justice is denied অর্থাৎ বিলম্ব ন্যায় বিচারে বিঘ্ন ঘটায়। এর ফলে ভুক্ত ভোগী ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।এক্ষেত্রে আপনি শালিসে ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশংকা থাকলে গ্রাম্য অসৎ শালিশদারদের ফাঁদে পা দেওয়ার পূর্বেই অনতিবিলম্বে আইনের আশ্রয় নিন।

খ) আদালতের দীর্ঘ সুত্রিতাঃ আদালতে মামলা দায়ের করার পর বিদ্যমান প্রকৃয়া অনুসরন করে মামলা নিষ্পত্তি হইতে যে দীর্ঘ সুত্রিতা চলমান আছে তার কারনে বিচার প্রার্থীর মধ্যে অনীহা ও বিরক্তিকর ভাব আসে। এক সময় তারা বিচারিক সিস্টেমের উপর আস্থা হারিয়ে মামলার তদ্বীরে অবেহলা করতে থাকে এর ফলে ওই মামলায় বিচার প্রার্থী ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়।

গ) ফৌজদারী মামলার রাষ্ট্র পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবির নিষ্কৃয়তাঃ সরকারী ভাবে উকিল নিয়োগের ব্যাপারটি স্বচ্ছ নয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত। যার কারনে অধিকাংশ সময় রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় আনাড়ি আইনজীবী নিয়োগ প্রাপ্ত হন।এর ফলে মামলা পরিচালনায় ত্রুটি হয়ে থাকে। আর এর সুবিধা নেয় আসামী পক্ষ। এতে করে বাদী পক্ষ চরমভাবে ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়। এ ক্ষেত্রে স্বাধীন প্রসিকিউশন সিস্টেম গঠন করে রাজনৈতিকভাবে নয় বরং মেধার ভিত্তিতে সরকারি ল’ অফিসার নিয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে আপনার করনীয়ঃ আপনি আইনী কোন জটিলতায় পড়লে সরাসরি একজন ন্যায় পরায়ন সৎ আইনজীবীর শরণাপন্ন হবেন। একজন ভালো সৎ আইনজীবি সব সময় আপনাকে সঠিক পথ দেখাবে। আপনি বিপদে পতিত হওয়ার পূর্বেই নিজে সব সময় আইনজীবীর নাম্বার সাথে রাখুন। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সবই আপনার হাতের নাগালে। আপনি চাইলেই ফেইসবুক বা গুগলে ভালোমানের আইনজীবীর তথ্য খুব সহজেই পেতে পারেন।

আর হ্যাঁ মনে রাখবেন।আপনি ধোকার সম্মুখিন হলে দালালের কারনেই পড়বেন। সুতরাং আপনি টাউট, দালাল, মুহুরী কিংবা মিডেল ম্যান অথবা কোন ক্লার্ক এর মাধ্যম ব্যতিত সরাসরি আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করার চর্চা করুন। আপনার ন্যায় সঙ্গত কোন সীমাবদ্ধতা থাকলে আপনার আইনজীবীকে খুলে বলুন। এতে আপনার আইনজীবী অবশ্যই আপনার সমস্যা সমাধান করে দেবেন। কোন দালাল ব্যাতিত আইনজীবীর সাথে আপনি স্বয়ং সম্পৃক্ত থাকুন। আপনার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আপনার আইনজীবীকে সহযোগীতা করুন। এতে আপনি ও সকল বিচার প্রার্থীর ন্যায় বিচার প্রাপ্তী নিশ্চিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

জয়নাল আবেদীন মাযহারী : অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট কুমিল্লা

ই-মেইলঃ joinalmajhari@gmail.com