মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন :
ট্রানজিশন এবং জাস্টিস এই দুইটি শব্দ মিলেই ট্রানজিশনাল জাস্টিস টার্মটি গঠিত। ট্রানজিশনাল শব্দের অর্থ পরিবর্তনশীল অর্থাৎ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর বা পরিবর্তন আর জাস্টিস শব্দের অর্থ ন্যায় বিচার। নব্বই এর দশকের প্রাক্কালে আমেরিকান শিক্ষাবিদরা ট্রানজিশনাল-জাস্টিস টার্মটির সৃষ্টি করেন। ট্রানজিশনাল জাস্টিস হল আন্তর্জাতিক আইনের একটা অধিক্ষেত্র। এটা একটা ভিন্ন ধরণের বিচার ব্যবস্থা। ট্রানজিশনাল জাস্টিসের সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে মূল বিষয় টা হল:
পোষ্ট-কনফ্লিক্ট সোসাইটিতে মূলত ট্রানজিশনাল জাস্টিস প্রয়োগ করা হয়। কোন দেশে যখন যুদ্ধ-বিগ্রহের কারনে ব্যাপক নৃশংসতা চালানো হয়, গণহত্যা সংঘটিত হয়, মারাত্মক ভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটানো হয়, মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয় অথবা কোন দেশ যখন স্বৈরাচারী সরকার ব্যবস্থা বা একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়, অথবা কোন সিভিল ওয়্যার থেকে শান্তি প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হয়, তখন নরমাল জাস্টিস সেখানে পর্যাপ্ত প্রতিকার প্রদান করতে পারেনা এবং ট্রানজিশনাল জাস্টিস প্রয়োগ করা হয়। ট্রানজিশনাল জাস্টিসে কিছু জুডিশিয়াল এবং নন-জুডিশিয়াল পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিচার-কার্য সম্পন্ন করা হয়। ট্রানজিশনাল জাস্টিস ইমপিউনিটি এবং এ্যামনেষ্টি প্রদানের বিপক্ষে অবস্থান করে আইনের শাসন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করে। যখন কোন একজন বা গুটিকয়েক ব্যক্তি ভিকটিম হয় তখন আমরা নরমাল জাস্টিস প্রয়োগ করতে পারি, কিন্তু যখন পুরো সোসাইটি বা দেশ বা জাতি ভিকটিম হয়, তখন ট্রানজিশনাল জাস্টিসের প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
ট্রানজিশনাল জাস্টিস মেকানিজম যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে তা হল- ক্রিমিনাল প্রসিকিউশন, ট্রুথ কমিশন, রেপারেশন, ইনস্টিটিউশনাল রিফর্মস্ এবং মেমরালাইজেশন।
ক্রিমিনাল প্রসিকিউশন
যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধি তাদের তদন্ত করাই ক্রিমিনাল প্রসিকিউশনের উদ্দেশ্য। প্রসিকিউশন চেষ্টা করে অপরাধের মূল-নায়কদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার ব্যাপারে, যারা কিনা ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ এবং সিস্টেমিক ক্রাইমের করার জন্য দায়ী।
ট্রুথ কমিশন
সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত নৃশংসতার তদন্ত এবং রিপোর্ট করাই এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য। প্রায়শই সরকারী সংস্থা এই কাজ করে থাকে, এই ঘটনার প্রতিকার এবং ভবিষ্যতে এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর পরামর্শ দেয়। ট্রুথ কমিশনের কয়েকটি উদাহরণ হল- ইউএন ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন, সাউথ আফ্রিকান ট্রুথ এন্ড রি-কনসিলিয়েশন প্রোগ্রাম, কমিশন অন দ্যা ট্রুথ ফর এল-স্যালভেডর, ট্রুথ এন্ড রি-কনসিলিয়েশন কমিশন (পেরু), ইত্যাদি। ১৯৭০ থেকে এই পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৩৫ টি ট্রুথ কমিশন গঠিত হয়েছে।
রেপারেশন প্রোগ্রাম
রেপারেশন প্রোগ্রাম হল রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ব্যবস্থা যা অতিতে ঘটে যাওয়া নির্মমতার জন্য বস্তুগত এবং নৈতিক ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করে।
জেন্ডার জাস্টিস
যৌন অপরাধ এবং লিঙ্গ ভিত্তিক অপরাধকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান করা এবং তারা যাতে বিচার থেকে অব্যাহতি না পায়, সে ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করাই জেন্ডার জাস্টিসের প্রধান কাজ। এছাড়াও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নারীরাও যাতে সমান প্রতিকার পায়, তা নিশ্চিত করা জেন্ডার জাস্টিসের উদ্দেশ্য।
সিকিউরিটি সিস্টেম রিফর্ম
ট্রানজিশনাল জাস্টিসের এই প্রচেষ্টাটি হল পুলিশ, মিলিটারি এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিপীড়নের হাতিয়ার হওয়ার পরিবর্তে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করা।
মেমরালাইজেশন ইফোর্টস্
ভিকটিমদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জাদুঘর, স্মৃতি স্তম্ভ ইত্যাদি নির্মাণ করা, যা পূর্বের নির্মম অভিজ্ঞতার বিপক্ষে নৈতিক সচেতনাবোধ জাগ্রত করে এবং ভবিষ্যততে এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ভূমিকা পালন করে।
এ হলিস্টিক এপ্রোচ
হলিস্টিক শব্দটির অর্থ হল সম্পূর্ণভাবে বা পরিপূর্ণভাবে। উদাহরণ স্বরূপ; হলিস্টিক ট্রিটমেন্ট অফ পেশেন্ট বলতে বোঝায়- কোন রোগীর শরীর, মন এবং আত্মার চিকিৎসা। আইনের ভাষায় ট্রানজিশনাল জাস্টিসও তেমন একটা হলিস্টিক এপ্রোচ বা পরিপূর্ণ বিচার ব্যবস্থা। মানবাধিকারের বিস্তৃত লঙ্ঘন বড় ধরণের জটিলতা সৃষ্টি করে। একটা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভারসম্য ভঙ্গুর থাকতে পারে, সরকার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, অথবা নিতে গেলে রাষ্ট্রের নিজের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। অতীতের বিভিন্ন ধরণের নৃশংসতার বিচার করা অনেক সময়ই চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায়। হাজার হাজার অপরাধী, হাজার হাজার ভিকটিম, নানান ধরণের অপরাধ, এদের প্রত্যেকের ন্যায় বিচার প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় কি ভাবে করা সম্ভব, আবার যদি আদালত ব্যবস্থা হয় দুর্বল এবং দুর্নীতিগ্রস্থ। এই ধরণের ক্ষতিগ্রস্থ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের জন্যই ট্রানজিশনাল জাস্টিস ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করা দরকার। ট্রুথ টেলিং (সত্য স্বীকার করা), রেপারেশন (ভিক-টিমদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা), ক্রিমিনাল প্রসিকিউশন, ইনস্টিটিশনাল রিফর্ম (প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার) এবং মেমোরালাইজেশন বা স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেই একটা পরিপূর্ণ বা হলিস্টিক বিচার করা সম্ভব।
বাংলাদেশে ট্রানজিশনাল জাস্টিসের সূচনা:
একটা যুদ্ধ-পরবর্তী দেশ বা জাতির শান্তির পথে ধাবিত হওয়ার অনুঘটক হিসাবে ট্রানজিশনাল জাস্টিস কাজ করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী ট্রানজিশনাল জাস্টিস প্রয়োগের বেশকিছু নজির লক্ষ করা যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, নুরেম্বার্গ ট্রায়াল, টোকিয়ো ট্রায়াল, যূগোশ্লোভিয়া, রুয়ান্ডা, ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্গত পূর্ব তিমুর, চিলি, সিয়েরা-লিয়োন ইত্যাদি।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নিদৃষ্ট কিছু মানবাতাবিরোধী অপরাধের পৃষ্ঠপোষকদের বিচার ট্রানজিশনাল জাস্টিস প্রয়োগের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এই যুদ্ধাপরাধীরা এযাবৎ কাল ধরে ইমপিউনিটি ভোগ করে আসছিল। এই ট্রায়াল বাংলাদেশের ভায়োলেন্ট পাস্ট বা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অতীত থেকে যুদ্ধপরবর্তী বা শান্তিপূর্ণ পোস্ট কনফ্লিক্ট সমাজের রূপান্তর। দেশীয় ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতির কোন অপরাধের বিচার করার ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশে এটাই প্রথম। আইসিটি বিডি এ্যাক্ট প্রণয়ন এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ট্রানজিশনাল জাস্টিসের সূত্রপাত ঘটে।
ট্রানজিশনাল জাস্টিসের লক্ষ্য
ট্রানজিশনাল জাস্টিসের মূল লক্ষ্য হল স্বৈরাচারী শাসন, একনায়কতন্ত্র, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অবস্থা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ কে সুগম করা এবং ভিকটিমদের স্বীকৃতি দেওয়া। ট্রানজিশনাল জাস্টিস সর্বোত্তম ভাবে অনুধাবন করা যায় এটি যে লক্ষ নিয়ে সামনে আগায় সেদিকে দৃষ্টিপাত করলেঃ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জবাবদিহিতা, ভিকটিমদের জন্য মর্যাদা, সত্য প্রতিষ্ঠা, স্বীকৃতি এবং সংশোধন বা সংস্কারসাধন। ট্রানজিশনাল জাস্টিসের এর লক্ষ অর্জনে অতীত এবং বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত কিছু উপায় হল সত্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা, ক্ষতিপূরণ প্রকল্প, ক্রিমিনাল ট্রায়ালস্, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন, স্মৃতি সংরক্ষণ এবং অন্যান্য অফিসিয়াল স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা। সমাজে বিভিন্নভাবে শিল্প-সাহিত্য, গল্প-বলা, শিক্ষা ব্যবস্থা, মঞ্চ নাটক ইত্যাদি সৃষ্টিশীল উপায়ে পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘৃণ্য কার্যক্রমের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা ট্রানজিশনাল জাস্টিসের অন্যতম লক্ষ্য।
ট্রানজিশনাল জাস্টিসের উদ্দেশ্য সাধন দুরূহ কারন, যে সকল সমাজে ট্রানজিশনাল জাস্টিস কাজ করে, নির্মম হিংস্রতা, নির্যাতন, নিপীড়ন আর দমনের ফলে তা প্রায়শই বিভক্ত। এ কারনেই টানজিশনাল জাস্টিসের লক্ষে পৌঁছানের রাস্তা হয়তো অনেক দীর্ঘ হবে এবং বিচার ব্যবস্থা বিভিন্ন রূপে যুগ যুগ ধরে আবর্তিত হবে। ভিকটিমদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি ভঙ্গুর বিশ্বাসকে জোড়া লাগানোর প্রচেষ্টায় অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, কৌশলগত পক্ষ-সমর্থন এবং আদর্শগত ভাবে দৃঢ় রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা থাকা অনিবার্য।
মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন : শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট