মাতৃছায়া, মাগুরা

এক নারী লিগ্যাল এইড অফিসারের ‘মাতৃকথন’

নুসরাত জাবীন নিম্মী :

আজ বেশ পুরানো কথা মনে পড়ছে। একটানা সাড়ে ছয় বছর দুটি স্টেশনে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস করা দিনগুলো স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠছে। বাসায় রেখে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় দুটি বাচ্চাকে অফিসে নিয়ে যেতাম। ঝামেলা এড়ানোর জন্য ছেলেটাকে তিন বছর আট মাস বয়সেই স্কুলে দিতে হলো। আর ছয় মাস বয়সি মেয়েকে চেম্বারের মেঝেতে ছোট বিছানা পেতে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এজলাস করতাম। কগনিজেন্স, ট্রায়াল করে নামতে নামতে দুপুর গড়িয়ে যেত। এর পর নথি স্বাক্ষর, আদেশ প্রস্তুত করণ, ভিকটিমের জবানবন্দি এবং আসামীর দোষ স্বীকারোক্তি শেষ করতে করতে সন্ধ্যা গড়াতো। এরই ফাকে বাচ্চাদের খাইয়ে, খেলতে দিয়ে চলতে থাকতো কাজ। কিন্তু বাচ্চাদের স্বস্তিদায়ক সুরক্ষা, স্থান বা খেলধুলার কোন জায়গা দিতে না পারায় তারা রুমেই বদ্ধ থেকে কখনো ভিকটিমের সাথে পরিচিত হয়েছে, কখনও বা নথির উপর চালিয়েছে শিল্পকর্ম, আবার কখনো দুটোয় মিলে চিৎকার করে অফিস মাথায় তুলেছে। রাতটুকু শুধু বাসায়। সকালে আবার একই রুটিন। এই কঠিন জীবন বিচারঙ্গনের প্রতিটি নারীরই চিত্র।

মাঝে মধ্যে খুব আফসোস হতো নিশ্চিন্তে বাচ্চাদের সময় কাটানোর একটি জায়গায় রেখে যদি অফিস করতে পারতাম! নিজের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হয়নি, কিন্তু এই আফসোস ঘোচানোর একটি সুযোগ কর্মজীবনে পেয়েছি। আদালতে আগত মা যখন কোলে বাচ্চা শিশু নিয়ে লিগ্যাল এইড অফিসে আপোস করতে আসে, বাচ্চার অবিরত কান্না, দুষ্টুমি, তাদের মনোসংযোগ ব্যহত করে। অনেক সময় বাচ্চা কোলে করে মা, আসামী হিসাবে হাজির করা তার স্বামীকে দেখতে আদালতে আসেন। বাবা হয়তো তার বাচ্চাটার চেহারা দেখে ভবিষ্যতের অগণিত কষ্টটাকে সামলে নেন। কিন্তু এই বাচ্চাটিকে মা যখন আদালতে আনেন তখন পুলিশ, পেশকার, শত মানুষের ভিড়ে এজলাস, গারোদখানা হতে প্রিজন ভ্যান শিশুটিকে কোলে করে মাকে দৌঁড়াতে হয়। সৃষ্টি হয় এক ভয়ার্ত পরিবেশের। মা কি একটু নিশ্চিন্ত হতে পারেন না?

জানি না, আইন আদালতের মাধ্যমে প্রদত্ত সেবা তাদের কতটুকু কাজে লাগছে। কিন্তু স্বপ্ন দেখতাম চাক্ষুস কিছু ভালোলাগা প্রত্যক্ষ করতে। যদি এমন হতো- বাচ্চাটি একটি শান্তিময় পরিবেশে খেলাধূলা করছে, স্বপ্ন আকঁছে ভবিষ্যত বাংলাদেশের রূপকার হওয়ার। যদি পারতেন বাচ্চার মা টি পরম নিশ্চিন্তে বাচ্চাকে দুধ পান করিয়ে ব্যস্ততা সারতে! হ্যাঁ ‘যদি’ আজ সত্য হয়েছে। স্বপ্নও সত্যি হয়। জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, মাগুরা সর্বদাই অভাবি, দুঃখি, অসহায় জনগণের সেবাদানে বদ্ধ পরিকর। আর সেই পরিকল্পনাকেই বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে জেলা পরিষদ, মাগুরা আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।

উক্ত বরাদ্দকৃত অর্থ কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে একটি সিপিপিসি গঠন করা হয়। সেখানে প্রথমে মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ মহোদয় সভাপতি হিসাবে এবং পরবর্তীতে বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সভাপতি হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পথিক যখন প্রখর রোদে পথ চলতে চলতে ক্লান্ত তখন ছায়াঘন বটবৃক্ষের সারি, শীতল হাওয়া পথিকের ক্লান্তিকে দুর করে আর বন্ধুর পথ যখন ক্রমেই মসৃন হয় তখন পথ চলার কষ্টটা আর থাকে না। আমি এবং আমরা সৌভাগ্যবান যে, মাগুরা জেলা জজশীপে এমন একজন বটবৃক্ষ পেয়েছি যিনি ছায়া দিয়ে আমাদের চলার পথে শ্রান্তি যোগাচ্ছেন।

শুধু ছায়া নয়, মাঠ পেরোনো শীতল বাতাস, কখনও বা তৃষ্ণার্ত পথিকের জন্য এক আধলা ঠান্ডা জল হয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে চলেছেন। তিনি আমাদের সুযোগ্য মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ জনাব মোঃ কামরুল হাসান। তারই সাথে আমাদের চলার পথের নকশা করে, বন্ধুর পথকে মসৃণ করে চলতে সাহায্য যিনি করছেন, তিনি বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মোঃ জিয়াউর রহমান। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এই দুইজন পথ প্রদর্শককে শুধু ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা নয় অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিলেও যেন কার্পণ্য করা হয়। স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপকল্প তৈরী হয় মা ও শিশু কর্ণার “মাতৃছায়া” গঠনের মাধ্যমে।

আজ কাঠখোট্টা আদালতের বারান্দায় ক্রন্দনরত শিশুকে কোলে নিয়ে মা কে ছুটতে হবে না এঘর হতে ওঘর। শিশু থাকবে মায়ের পরশে মাতৃছায়ায়। খেলনা ঘোড়ায় ছুটতে ছুটতে হয়তো শিশুটি পৌঁছাবে স্বপ্নের দেশে। এরই ফাঁকে মা আদায় করবেন নামাজ। মহিয়সী ব্যক্তিদের ছবি দেখে জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা পাবে শিশুরা। হয়তো ছবিতে বনের রাজ্য দেখে হারিয়ে যাবে রূপকথায়। এমনই একটি ‘মাতৃছায়া’ আজ বাস্তব হলো।

লিগ্যাল এইড অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা চলা আপোষ-মীমাংসার বৈঠকে মা আর উদ্বিগ্ন হবেন না। আদালতে আগত প্রত্যেকটি নারী, শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে হবেন আশ্বস্ত। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সকল নির্দেশনা, পথপ্রদর্শক শুধু নয় ব্যক্তিগত ভাবে শ্রম দিয়ে মাতৃছায়াকে সার্থক করার জন্য আমার স্যারদের জন্য রইল প্রাণঢালা অভিনন্দন। এমন সুন্দর স্বপ্নের অংশিদার হতে পেরে সত্যিই আত্মতৃপ্তি বোধ করছি। মা ও শিশুকে নিয়ে অসম্ভব সুন্দর কবিতা দেয়ার জন্য মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ স্যারকে এবং সুন্দর নামকরণ এর জন্য বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা। তাদের জন্যই মাতৃছায়া আজ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ভালোবাসাময় হয়ে উঠুক পৃথিবী, এটাই প্রত্যাশা।

(বিঃ দ্রঃ- লেখাটি একজন মায়ের দৃষ্টিকোণে আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা।)

নুসরাত জাবীন নিম্মী : জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার, মাগুরা