শেখ মোঃ মুহিব্বুল্লাহঃ
একটি পাত্র -পাত্রী চাই (প্রাইভেট গ্রুপ) এ পাত্র চাইয়ের এক পোস্টের একটি লাইন চোখে আটকে গেল – ‘পাত্রীর বাবার পছন্দ ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ’। কোন কোন মেয়ের বাবার মনের ইচ্ছা থাকতে পারে যে তাঁর মেয়েকে ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ এমন কারো কাছে বিয়ে দিবেন। আমি তাঁর এমন চাওয়াকে শ্রদ্ধা করি। এটা মুদ্রার এক পিঠ। আমার আজকের লেখা মুদ্রার অন্য পিঠ নিয়ে। যখন ছেলে দেখার আগেই ছেলের চাকুরীর পদবী নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় তখন বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখা ছাড়া উপায় নেই। আচ্ছা কেউ কি জানেন – পাত্রীর এই বাবার কেন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ জামাই লাগবে। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আলাদা বেতন কাঠামো) যদি বাদ দেই তাহলে সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) এবং পুলিশ ক্যাডারের সহকারী পুলিশ সুপার দের বেতন ৯ম গ্রেডে হয়। মাস শেষে ৩৫ হাজার টাকার এদিক সেদিক হবে। অন্যদিকে একজন শিক্ষা ক্যাডারের বা চিকিৎসকেরও বেতন বা অন্যান্য সব ক্যাডার এর বেতন একই রকম, সব ক্যাডারই একই গ্রেড এর বেতন পান। বরং শিক্ষা ক্যাডারের যিনি তিনি ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে বা পাবলিকেশন করে আরও বেশি আয় করতে পারেন। ডাক্তার সাহেবও প্রাইভেট প্রাকটিস করেও হালাল রাস্তায় অনেক টাকা আয় করতে পারেন। ব্যাংকারদের ও হ্যান্ডসাম বেতন দেওয়া হয়। তাহলে উক্ত ‘পোস্টে’ শিক্ষা ক্যাডার, ব্যাংকার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ব্যবসায়ী- এর নাম নেই কেন? তাহলে পাত্রীর বাবার টাকার দিকে মন নেই? তাহলে কী ‘ক্ষমতা’ তাঁর মাথায় ঘুরছে? আচ্ছা পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট এর কী ক্ষমতা আছে? একজন শিক্ষকের কাজ যেমন ছাত্র ছাত্রী পড়ানো, চিকিৎসকের কাজ যেমন রোগী দেখা, তেমনি পুলিশ এর কাজ আসামী ধরা, আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ আইন অনুযায়ী বিচার করা। তাহলে এখানে ক্ষমতা কোথা থেকে আসলো? এটা কি ‘ক্ষমতা’ নাকি ‘দায়িত্ব’? এই সব দায়িত্বের বাইরে তাঁর আর কী কিছু করার আছে? তাহলে শ্বশুর মশাই কেন এত ‘দায়িত্বের ভারে নুইয়ে পড়া’ ছেলের কাছে মেয়ে দিতে চান? বরং তাঁরতো তাঁর মেয়েকে যে বেশি সময় দিতে পারবে সাথে টাকাও রোজগার করতে পারবে তাঁর কাছে বিয়ে দেয়া উচিত। আচ্ছা তিনি কী মনে মনে ভাবেন – এখন ৩৫ হাজার টাকা; পরে অনেক টাকা হবে! কীভাবে হবে? পরে অনেক টাকা তো সব ‘ক্যাডার’ এরই হবে! তাহলে তিনি কি ঘুষ, দুর্নীতির দিকে ইঙ্গিত করছেন! তাহলে কি তিনি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তাঁর মেয়ের জন্য এমন পাত্র চান? কিন্তু একজন পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট তার অধিক্ষেত্রের বাইরে কী এমন নিরাপত্তা দিতে পারবেন? শ্বশুরের এলাকার কেউ অপরাধ করলে থানায় ফোন করে ওসিকে বলে দিবেন যে – ‘ছেড়ে দিন’ । কোন এসি ল্যান্ড অফিসে ভুয়া নামজারি করতে সহকারী কমিশনার জামাইকে ফোন দিতে বলবেন! আমার জামাই পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট বলে পাশের জমির আল ১ ফুট বেশি কেটে ফেলবেন! শ্যালক রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বাইক নিয়ে ঘুরার সময় ট্রাফিক পুলিশ ধরলে দুলাভাইকে দিয়ে ফোন দিয়ে ছেড়ে দিতে বলবেন! শালীর নন- ক্যাডার স্বামী শালীর সাথে দুর্ব্যবহার করলে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে দেবার ভয় দেখাবেন! ভুয়া বন্দোবস্তের জন্য সহকারী কমিশনার থেকে পদোন্নতি পাওয়া জামাইকে দিয়ে ডিসি’র কাছে তদবিরের জন্য বলবেন! গুরুতর অপরাধের আসামীকে জামিন দিতে ম্যাজিস্ট্রেট জামাইকে তার উপরস্থ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথে তদবির করতে বলবেন! অন্যের জমি দখল করে বিচারক জামাইকে দিয়ে অন্য বিচারক কে ‘নিষেধাজ্ঞা’ র আবেদন মঞ্জুর করতে বলবেন? এগুলো কি তাঁদের দায়িত্ব? এগুলা স্রেফ দায়িত্বের উল্টো, অন্যায় এবং অপরাধ। ক্ষমতাতো নয়ই। কোন সরকারী কর্মচারীর কোন ক্ষমতা থাকেনা, থাকে বিধিবদ্ধ দায়িত্ব, প্রেস্ক্রাইভড কাজের পরিধি। যার যার বিধিবদ্ধ দায়িত্ব থেকে এক চুল পরিমাণও এদিক-সেদিক হবার কোন সুযোগ নেই। যার যার অধিক্ষেত্রের বাইরে অন্য অধিক্ষেত্রে তদবির, জোর জরবরদস্তি, অন্যায় আবদার, স্বজন প্রীতি করার বিন্দুমাত্রও সুযোগ নেই। আমার কর্মক্ষেত্রে একজন এবং সুদূর সিরাজগঞ্জে আছেন একজন যিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচমেট, তাঁরা দুজনেই সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট), তাঁরা সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। আমার আরেকজন সহকারী পুলিশ সুপার বন্ধু বর্তমানে ময়মনসিংহ- সিলেট মহাসড়ক এলাকায় যার কর্মক্ষেত্র, আমার দেখা এখন পর্যন্ত সেরা একজন উদীয়মান পুলিশ অফিসার। আমি হলফ করে বলতে পারি একেও কোন ঘুষ বা দুর্নীতি দিয়ে টলানো যাবেনা। ইনি আবার অবিবাহিত। উক্ত শ্বশুর মশাই যদি আমার এই বন্ধুকে জামাই হিসেবে পান তাহলে তার পুলিশ জামাই পাওয়ার ফ্যান্টাসি ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। কারণ আমার বন্ধু ওসব করবেনা। কিন্তু এর মানে কেউ যে ঘুষ দুর্নীতিতে জড়াবেনা এমনটি নয়। এই ঘুষ দুর্নীতিতে সেই অফিসারের জড়ানোর জন্য তিনি যেমনটা দায়ী তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি দায়ী উক্ত পদগুলোর উপর আমাদের মোরালি করাপ্ট দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজের সিনিয়র নাগরিকগণ যদি এভাবে ‘দায়িত্ব’ কে তথাকথিত ‘ক্ষমতা’র সাথে মিশিয়ে ফেলেন তাহলে সে দেশের মানুষের সামাজিক নিরপত্তা, ঘুষ, দুর্নীতি, উর্দি, বন্দুক নিয়ে কী ধরনের মাইন্ড-সেট আপ কাজ করে তা সহজেই অনুমেয়। সরকারী দায়িত্বে নিয়োজিত গাড়ি নিয়ে আপনার বাসায় বিরিয়ানি খাবার জন্য আপনার জামাইকে ঐ গাড়ী দেয়া হয়নি। ঐ গাড়ীর তেল জনগনের ট্যাক্সের টাকায় কেনা। শুধুমাত্র নিজ নিজ দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিক্ষেত্রে ব্যবহার্য । কখনো কি কোন ‘ক্ষমতাবান’ শ্বশুর তাঁর জামাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে – ‘বাবা , এটাতো তোমার দায়িত্ব প্রাপ্ত এলাকা নয় তাহলে সরকারী গাড়ী নিয়ে কীভাবে আসতে পারেল’! ৩৫ হাজার টাকা বেতনে ২ বছর পরেই কীভাবে ডুপ্লেক্স বাড়ি করার ফাউন্ডেসন করলে, কীভাবে আমার মেয়ের নামে ১ কোটি টাকার এফডিআর করলে! করেননি, করবেনও না। কারণ আপনি তো এসবই চেয়েছেন। বিজ্ঞাপনে এমন জামাই চাওয়ার বদ উদ্দেশ্য আমরা সবাই বুঝি। দায়িত্ব ও নিয়মের বাইরে কিছুই নয়। অনেকে বলেন ক্ষমতার অপব্যহবার। কিন্তু যেখানে ক্ষমতাই নাই সেখানে অপব্যবহার কোথা হতে আসবে! যা আছে সবই দায়িত্ব। শ্বশুরমশাইকে বলব এই ক্ষমতার ফ্যান্টাসি থেকে বের হয়ে আসুন । তাহলে দেখবেন সবই এক।
লেখকঃ বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস