এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম:
করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে গবেষণা, টিকা তৈরি ও চিকিৎসায় বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। তবে তিনি বলেছেন, ‘আমরা কত দ্রুত ও কত কার্যকর এ ব্যবস্থা করতে পারব, সেটা বিষয় নয়। বিষয় হলো, কতটা সুষমভাবে আমরা তা বণ্টন করতে পারব। আমরা কেউ এমন পৃথিবী মেনে নিতে পারি না, যেখানে কিছু মানুষ সুরক্ষিত, সবাই নয়। সবাই সুরক্ষিত না হলে কেউই নিরাপদ নয়।’
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান। কথা আলবত ঠিক কেননা বৈশ্বিক এ মহামারীর হাত থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছেন না এবং বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। করোনাভাইরাস বিস্তারের মুখে উঁচু পদের নীতিনির্ধারকরাও নিরাপদ নন বরং নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে করোনাভাইরাস ঢুকে পড়ছে তাদের সুরক্ষা অট্টালিকায় এবং গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সাধারণের মতো তারাও বৈশ্বিক এ মহামারীর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
চলমান বিশ্বনেতাদের আত্মকেন্দ্রিক বৃত্তের বাইরে এসে উদারতার চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছানো অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জীবনের মূল্য কমপক্ষে তার নিজের জীবনের সমান কিংবা তারও বেশি এমন অনুভূতিকে স্পষ্ট করবে। কেননা চলমান করোনা সংকটকে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে না দেখে কেউ যদি একা কিংবা তার দেশের মানুষের শুধু মুক্তির ভাবনায় পরিকল্পনা স্থির করে, কোন সন্দেহ নাই সময়ের ব্যাপ্তিতে তা বুমেরাং হবে! কেননা ডব্লিউএইচও মহাপরিচালক বলেন, ‘কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে যে, সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়। রাজনীতিকে এক পাশে রেখে সত্যিকারের সহযোগিতার মাধ্যমেই পরিবর্তন সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনও টিকা নেই। যদি কোনও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়, তবে সেটিই হবে করোনা মোকাবিলায় প্রথম টিকা।’ সূত্র: রয়টার্স, সিএনবিসি।
অর্থাৎ সারাবিশ্বের মানুষের কথা একযোগে ভাবতে হবে। অন্যথায় ধরুন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সারা বিশ্বের সকলেই একযোগে নির্দিষ্ট সময়ে এসে ওষুধটি সেবন করবে করোনা কে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে – এমন ক্ষেত্রেও যদি বিশ্বের কোন একজন করোনা জীবাণু বহন করা মানুষ হয়ত সে জানেও না যে তার শরীরে এমন ভাইরাস আছে সে যদি কোন কারনে সেই সেবাটি গ্রহণ না করে থাকে তবে সেই একজনের কাছ থেকেই আবার পুরো পৃথিবী ছড়িয়ে পড়বে। কাজেই যে সকল বিশ্বনেতারা নিজ কেন্দ্রিক ভাবনায় এখনো অন্ধ হয়ে আছেন তারা শুধু ভুলই করছেন না নিজের জীবনকে ও অনিরাপদ করছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই। খুব বেশি ক্রেডিট কিংবা বাহাদুরি করার মত একক শক্তি যে কোন দেশের নাই তাও ইতোমধ্যে বিশ্ববাসী টের পেয়ে গেছে। কাজেই বংশীয় খোনকার গিরি বাদ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিশ্বনেতাদের একটি ভার্চ্যুয়াল প্লাটফর্ম তৈরি করে আশু সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ গাইডলাইন বিশ্ব মানবতার পক্ষে উঠে আসা জরুরি দরকার! যাদের গবেষণা করার মত এক্সপার্ট আছে তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যেমন সেটি অব্যাহত রাখবে সেই সাথে বিশ্বের সকলের জন্য আলাদা একটি দৃশ্যমান প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানো অনিবার্য কারনেই জরুরি। যেখানে সকল দেশের সমান অধিকার থাকবে এবং সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে।
এটি কোনভাবেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি হবে না বরং গবেষণা থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন তৈরি হওয়া পর্যন্ত এবং তৎপরবর্তীতে ডিস্ট্রিবিউশন এবং সেটির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরন পর্যন্ত যাবতীয় কাজের ব্যবস্থাপনা করবে এই প্ল্যাটফর্ম। অবশ্যই বিনামূল্যে সকল নাগরিক পাবে এই ভ্যাকসিন সেটিরও নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। গবেষণা ও ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত আর্থিক যোগান বিশ্বের সকল দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কোন দেশ কতটুকু কন্ট্রিবিউশন করবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। যেখানে যাদের সামর্থ্য কম বা সামর্থ্য নাই সেও যেন সমঅধিকার ভোগ করতে পারে মানবিক কারণেই সেটিও বিবেচনা করতে হবে। এপর্যন্ত করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বের শতাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে তা আমাদের জন্য আশার আলো বয়ে আনতে পারে। এর মধ্যে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এগিয়ে আছে বলে জানিয়েছ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
কিন্তু আশার কথা শুনছি চীন তাদের ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। তবে আপাতত দেশটির সেনাবাহিনীর গবেষণা শাখা এবং স্যানসিনো বায়োলজিকসের (৬১৮৫.এইচকে) তৈরি একটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন মানব শরীরে প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে। চীনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশন এডি৫-এনকোভ ভ্যাকসিনটি সৈন্যদের দেহে এক বছরের জন্য প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। স্যানসিনো বায়োলজিকস এবং একাডেমি অফ মিলিটারির একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট যৌথভাবে ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ভ্যাকসিনটি চীনের বাইরেও পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হচ্ছে। ইতিমধ্যে কানাডায় পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে চীনের লজিস্টিক সাপোর্ট বিভাগের অনুমোদনের আগে এটি ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হবে না। তবে আমরা আশা রাখছি পরিক্ষামূলক হলেও প্রতিটা রাষ্ট্রের মানুষের দেহে এর প্রয়োগ করে দ্রত ফলাফল নিশ্চিত করা দরকার কারন সব দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সমান নয়। বিশ্ব নেতাদের সামগ্রিক ভাবনার বরই প্রয়েজন। বুঝতে কষ্ট হয় আর কত প্রাণ ঝরে গেলে বিশ্বনেতারা এমন সামগ্রিক ভাববেন । কিন্তু মনে রাখা জরুরী বিশেষ করে শুধু বাজারজাত করে পয়সা কামানোর মত হীনমানসিকতার কারণেই যেন সকল সফলতা বিফলে না যায় ভাবনার বিষয় সেখানেই। তবে
এ কথাও সত্য যে, এ বিষয়ে ঘুরেফিরে সবাইকে ঐকমতে আসতে হবে তারও কোন বিকল্প নাই। দুর্ভাগ্যক্রমে যতটা দেরিতে গিয়ে উপলব্ধি হবে ততদিনে বিশ্ব আরও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে এবং অনেক অনেক বেশি প্রাণ হারাবে আর বেঁচে থাকা মানুষের বড় একটা অংশ হয়তো মানসিকভাবে ভারসাম্য হারাবে কিংবা মানুষিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বে বিশেষ করে নারী শিশু বৃদ্ধ মানুষেরা। সেই সাথে যত দেরি করে এটা হবে ততবেশি দুঃখকে আলিঙ্গন করতে হবে এ বিশ্বকে।
বিশেষ করে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা বাজার অর্থনীতি, গগনচুম্বী বেকারত্ব, আইন -শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে আর দুর্ভিক্ষের আকার হবে এতটাই ভয়ানক যা পৃথিবী পূর্বে কখনোই পরখ করেনি! সেই সাথে রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব শুরু হবে মানুষে মানুষে বাড়বে অবিশ্বাস দেখা দেবে হতাশা নৈরাজ্য এবং এর পরিণতি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে যে রাষ্ট্র বা সমাজের কোন স্তরেই চলমান নেতৃত্ব দিয়ে সেটি সমাধান করা যাবে না অর্থাৎ নেতৃত্ব তার কার্যকারিতা হারাবে। পরিশেষে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা জি২০ দেশগুলো তারা বিষয় সংক্রান্তে ভিডিও কনফারেন্স করলেও যে সকল দেশ জিডিপির আশি শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের উদাসীনতা কিংবা কাঙ্ক্ষিত আগ্রহ পরিলক্ষিত না হওয়ার বিষয়টিও উদ্বেকজনক। চাই কল্যানমূখী মানবিক বিশ্ব তাই খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি সাধারন প্লাটফর্ম যদি আশার আলো না জাগায় কিংবা কার্যকরি না হয় তবে আজকের একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক সভ্যতার অহংকার রীতিমত অসভ্যতার চিত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা অমূলক হবে না।
লেখক: পুলিশ সুপার, গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও কন্ঠ শিল্পী।