অদৃশ্য বৈশ্বিক কোভিড–১৯ সমস্ত বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। পৃথিবীর সকল দেশ এই মহামারী থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামরত। মুক্তির আলোর পথ এখনও দৃশ্যমান নয়। সত্বর পরিস্থিতির অবসান হউক বা না হউক অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধির মত কোভিড–১৯ কে ধারণ করেই কোভিডকে পরাজিত করতে হবে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জীবন চলমান। বদ্ধপুকুরের পানির মত স্থবির নয়।কঠিন বাস্তবতা আর প্রয়োজন দূরদৃষ্টি এবং চিন্তার দ্বোর খুলে দেয় এবং নুতন কিছুর উদ্ভাবন হয়।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রারম্ভিকে অপ্রস্তুতি ও সিদ্ধান্তের সমন্বয়হীনতার কারণে সুব্যবস্থাপনার ঘাটতি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। এখনও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না। কোভিড–১৯ এর কারণে ২৬ মার্চ থেকে সরকারী ছুটি (?) (লক-ডাউন) ঘোষনার পর পর্যায়ক্রমে তা ৩০’ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এতে করে রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ ‘বিচার বিভাগ’ সম্পূর্ণ রূপে অচল হয়ে পরে। জনগণের বিচার পাওয়ার মৌলিক আর সাংবিধানিক অধিকার স্তব্ধ হয়ে যায়। আইনের শাসন ব্যাহত হয় এবং আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ দেখা দেয়। সরকার রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হয়। এরূপ পরিস্থিতে Supreme Court Special Committee for Judicial Reforms (SCSCFJR) এর বিগত ২০ এপ্রিল ২০২০ তারিখের ৬৮তম সভায় হাইকোর্টসহ দেশের অধস্তন আদালত সমূহে Video/Audio-Conferencing এর মাধ্যমে সীমিত আকারে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে অনুরোধ জানানো হয়। UNDP-Bangladesh এবং SCSCFJR কে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা ও সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বলা হয়, এবং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ছুটিকালীন সময়ে অধস্তন আদালত সমূহকে সপ্তাহে দুই দিন স্বাস্থ্য বিধি মেনে জামিন শুনানীর জন্য সীমিত আকারে আদালতের কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। মাননীয় প্রধান বিচারপতি ২৬’এপ্রিল ভার্চুয়াল মিটিং এর মাধ্যমে অন্যান্য বিচারপতিগণের সাথে মিলিত হয়ে স্থবির অবস্থা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং মাননীয় প্রধান বিচারপতি High Court Rules 1973 এর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদানে বা প্রাকটিস নির্দেশনা জারির করে, এমনকি স্বপ্রণোদিত (suo moto) হয়ে Video/Audio-Conferencing এর মাধ্যমে সীমিত আকারে আদালতের কার্যক্রম চালানোর নির্দেশদিতে পারতেন। যা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আমাদের দুই মাস আগেই গ্রহণ করেছেন। কোন বিশেষ বা পুর্ণাঙ্গ আইনের অপেক্ষা করেন নি।
নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের শুনানির জন্য সীমিত আকারে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে তাৎক্ষনিক ভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ আইনের প্রয়োজন ছিলনা। High Court Rules 1973 এর প্রদত্ত ক্ষমতাই যথেষ্ট ছিল। যদিও সকল আদালত সুপ্রীম কোর্টের আদেশ মানতে বাধ্য, তবুও High Court Rules 1973 এ সংশোধনীর মাধ্যমে Virtual Court System অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন আছে কিনা এ নিয়ে দ্বিমত থাকায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহাবুবকে প্রধান করে পাঁচ জনের একটি কমিটি করে দেন। অবশ্য ইতিমধ্যে সরকার ৯ মে ২০২০ ইংরেজি একটি প্রজ্ঞাপন দ্বারা “আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০” নামে তথ্য-প্রযুক্তির নির্ভর পক্ষগণের ভার্চুয়্যাল উপস্থিতির মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম চালানোর জন্য সংসদ আধিবেশন না থাকায় অধ্যাদেশ জারি করেন। যা বর্তমানে Virtual Court System নামে অধিকভাবে পরিচিত। উক্ত আধ্যাদেশটি সংবিধানের ১৫২ ধারায় সংজ্ঞায়িত মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান, দরখাস্ত, আপিল শুনানি, স্বাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তিতর্ক গ্রহণ, আদেশ বা রায় অর্থাৎ একটি মোকদ্দমা রুজু থেকে চূড়ান্ত রায় অব্দি প্রক্রিয়াগত সকল কার্যধারা সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদান সম্বলিত একটি পুর্ণাঙ্গ আইন”। এই আইনের কারণে ভার্চুয়্যাল কোর্ট চালনোর আরও কোন বাধা থাকলোনা বরঞ্চ দেশের বিচার ব্যবস্থা কে e-judiciary তে রুপান্তর করার একটা প্রয়াস। মাননীয় আইনমন্ত্রী এই আইনকে “যুগান্তকারী পদক্ষেপ” হিসাবে চিহ্নিত করাছেন।
গত ১০’মে থেকে Virtual Court এর কার্যক্রম শুরু হয়। ভার্চুয়্যাল উপস্থিতির মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম চালানোর জন্য অধ্যাদেশ জারী করে Virtual Court System চালু করা হয়েছে বটে কিন্তু উদ্দেশ্য শতভাগ সফল হয়েছে তা হলফ করে বলা যাবে না। শুরু থেকেই Virtual Court আর Traditional Court এর কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক চলে আসছিল। অনেক জেলা Virtual Court বর্জনও করেছে। তার প্রধান কারণ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর বিচারিক কার্যক্রম চালানোর জন্য অবকাঠামো এবং পরিকাঠামোগতভাবে প্রস্তুত ছিলনা বা করা হয়নি। বিরোধের সকল পক্ষের নিকট Virtual Court এর জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক e-technology বা digital technology এর সহজপ্রাপ্যতা বিংবা ব্যবহারে অভ্যস্ত কিনা তা আমলে আনা হয়নি।
Virtual Court একই ছাদের নীচে বসে আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়না। এখানে দুইটি স্থান থাকে যেমন ‘Court Point’ এবং ‘Remote Points’। মাননীয় বিচারকবৃন্দ তাঁদের চেম্বারে সুরক্ষিত ভাবে বসে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন তা ‘Court Point’ এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ যেখান থেকে তাদের স্বস্ব মক্কেলের প্রতিনিধিত্ব বা বিচার কাজে সহায়তা করেন তা ‘Remote Points’ যা এক বা একাধিক স্থানে হতে পারে। এ ব্যাপারে অধ্যাদেশে বা সুপ্রীম কোর্টের প্র্যাকটিস নির্দেশনায় সুনির্দ্দিষ্ট উল্লেখ না থাকায় এবং Virtual Court এর জন্য অধিকাংশ বিজ্ঞ আইনজীবীগণের প্রয়োজনীয় আধুনিক e-technology বা digital technology-এর সহজপ্রাপ্যতা কিংবা ব্যবহারে অনভ্যস্ততার কারণে Remote Points এখন বিজ্ঞ আইনজীবীদের চেম্বার ছাড়াও কম্পিউটারের দোকান, কম্পিউটার টাইপিষ্টের টেবিল এমনকি অসম্মানজনক স্থানে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। যা কখনও কাম্য হতে পারেনা। যার কারণে দালাল ও টাউটের দৌরাত্ম বেড়ে গিয়েছে। এমনকি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন “এখান থেকে Virtual Court” পরিচালনা করা হয়। যা Code of Conduct বিরোধী। ই-দালাল বা ই-টাউট চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। ই-ফাইলিং এর ক্ষেত্রে ‘বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ এর নির্দেশিত নিয়মাবলি এবং স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছেনা। সর্বোপরি মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞ আইনজীবী এর সুফল ভোগ করছেন। Traditional Court (নিয়মিত আদালত চালু) না থাকায় সিংহভাগ বিজ্ঞ আইনজীবী এখন কর্মহীন। দেশে আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০ হাজারের মত।
“আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০” এর প্রস্তাবনা ও ভূমিকাতে উল্লেখ করা হয়েছে “মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান, বা দরখাস্ত বা আপীল শুনানি, বা সাক্ষ্য গ্রহণ, বা যুক্তিতর্ক গ্রহণ, বা আদেশ বা রায় প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চুয়্যাল উপস্থিতি নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্তে বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রণীত”। লক্ষণীয়, আইনের মুখবন্ধে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে করোনা জনিত পরিস্থিতি বা বিশেষ জরুরি কোন কারণে সাময়িক ভাবে এই আইন প্রণীত হলো। অর্থাৎ এই আইন প্রণয়ন সরকারের সুদূরপ্রসারী একটা পরিকল্পনা। এই সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি Digital Bangladesh, Vision 21. রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখার মত দেশের বিচার বিভাগকে ই-জুডিশিয়ারি (e-judiciary বা digitization) এর আওতায় নিয়ে আনার পদক্ষেপ, তারই ফলশ্রুতি “আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০”। বাজেট প্রস্তাবে মাননীয় অর্থ মন্ত্রী ই-জুডিশিয়ারি (e-judiciary) প্রবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং ১৭৩৯ কোটি টাকা বরাদ্ধও রেখেছেন।
এটা মানতেই হবে এখন অব্দি বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ ও তথ্য-প্রযুক্তির প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এমন কি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহ থেকেও পিছিয়ে আছি। বলা যায় “আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০” দ্বারা আমরা পরিবর্তনের নতুন যুগের দিকে পদার্পণ করলাম। তবে বড় প্রশ্ন এর জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত। একটু পিছন থেকে আলোচনা করতে চাই। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং UNDP-Bangladesh যৌথ ভাবে বাংলাদেশের আইনের জঠিল পদ্ধতিগত ব্যবস্থাকে সহজতর করা, মামলার জট, দীর্ঘসূত্রিতার অবসান, কার্যকর বিচারিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির দ্বারা আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং বিচার ব্যবস্থাকে আরো সহজ ও অধিকতর কার্যকর এবং Court System কে Digitization এর মাধ্যমে e-judiciary প্রতিষ্ঠা করে জনগণের দোর গোঁড়ায় পৌছে দেয়ার লক্ষে “Judicial Strengthening (JUST) Project নামে কাজ করে আসছেন। অগ্রগতি মন্তর হলেও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু ইতি মধ্যে রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখায় ICT-এর ক্ষেত্রে যত অগ্রগতি হয়েছে বিচার বিভাগ সে তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। কিন্তু কোভিড-১৯ যেন বিচার বিভাগের অপ্রস্তুত অবস্থায় e-judiciary এর প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বিচার বিভাগে e-judiciary প্রবর্তন করা একটা মহাযজ্ঞ কাজ। রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখা থেকে বিচার বিভাগের কাজ অনেক কঠিন অনেক দুরূহ। এর ব্যাপ্তি তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। সুপ্রীম কোর্টের দুইটি শাখা, জেলা ও মহানগর দায়রা, চীফ জুডিশিয়াল হাকিম, মূখ্য মহানগর হাকিম পর্যায়ে তাদের অধস্তন আদালত সমূহ এবং শ্রম আদালত, বিশেষ আদালত ও বিভিন্ন ট্রাইবুন্যাল সমূহ ইত্যাদিসহ প্রায় ৪০ টির মত আদালতের স্তর আছে যা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশে মহানগর দায়রা ও মূখ্য মহানগর হাকিমের বিচারিক সীমারেখা ছাড়াও ৬৪টি জেলা ৪৯৪টি উপজেলা এবং ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ১৪০০ টা আদালত কক্ষ বিদ্যমান। তাই স্তরবিন্যাস ব্যতীত এক সাথে এত বড় যজ্ঞ কাজ ICT’র আওতায় আনা বা Digitized করা সম্ভব না হলেও দুরূহ তো বটে। ভারতীয় বিচার বিভাগ ২০০৫ সাল থেকে e-judiciary নিয়ে কাজ করছে এখনও পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। আমাদের বিচার বিভাগ কতটুকু প্রস্তুত?
মাননীয় আইনমন্ত্রী ৬ সেপ্টম্বর ২০১৯ তারিখে বার্তা সংস্থাকে জানান যে, Digital Bangladesh বা Vision 21 বাস্তবায়নণের লক্ষে বিচার বিভাগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) প্রয়োগের আইনি পরিসেবাগুলির আরও উন্নয়নের জন্য e-judiciary তে রুপান্তর করার লক্ষে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণ, ই-কোর্ট প্রতিষ্ঠা এবং বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ICT জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে ২,৬৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি e-judiciary প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যা জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, e-judiciary প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে জুডিশিয়াল সার্ভিসের জন্য এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচার বিকাশ; এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ERP) সফটওয়্যার বিকাশ; ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সাক্ষ্য দান রেকর্ডিং এবং ডিজিটাল প্রমাণ রেকর্ডিং; বিচার বিভাগের অধীনে সমস্ত অফিসের জন্য ভার্চুয়্যাল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (VPN) স্থাপন; আইন ও বিচার বিভাগে এবং সুপ্রীম কোর্টের তথ্য উপাত্ত ভান্ডার এবং একটি নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার স্থাপন করা। সারাদেশে মোট ১,৪০০ কোর্টরুমকে ই-কোর্টরুমে পরিণত করা হবে। জেলাগুলোতে মাইক্রো ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হবে এবং সকল ডাটা সেন্টারগুলির মধ্যে একটি আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা হবে। আদালতের রেকর্ড রুমগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা হবে, মামলার রেকর্ড ও রায়গুলি ডিজিটালি সংরক্ষণ করা হবে এবং একটি বায়োমেট্রিক উপস্থিতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। জেল ব্যবস্থাপনাও এর আওতায় থাকবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের আওতায় ই-কোর্ট রুম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইন সংশোধন করার প্রস্তাব রাখা হবে। বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। (৭ সেপ্টেম্বর’১৯ ডেইলি স্টার)
উপরের বর্ণীত কাজগুলো অবশ্যই একটা কম্পিউটার সিস্টেমের “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮” ধারা ২(ঙ) আওতায় আসবে। অর্থাৎ ভার্চুয়াল কোর্টের ধরণটাই হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা সম্পর্কিত সংবেদনশীল ব্যক্তিগত এবং জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত গোপনীয় সরকারী তথ্য সম্বলিত যা উক্ত আইনের ধারা ২(ছ) “গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো” (Critical Information Infrastructure) তথ্য অবকাঠামোর ক্যাটাগরিতে চলে আসে এবং এ জাতীয় তথ্য পরিকাঠামোর সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। “উক্ত আইনের ধারা ১৫ অনুযায়ী সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে যে কোন কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক বা তথ্য পরিকাঠামোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসাবে ঘোষণা দিতে পারেন।
এখানে প্রশ্ন এসে যায় আমাদের সুপ্রীম কোর্ট ভার্চুয়্যাল কোর্টকে নিজের আওতাধীন “গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো” হিসাবে ঘোষণা করার বিবেচনা করবেন নাকি সকারের উপর নির্ভরশীল হবে। “গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো”এর সাইবার হুমকি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি (D.S.Act-2018ধারা ৫) এবং “কম্পিউটার ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম (CERT)” গঠন (৯ধারা) এবং “জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল (ধারা-১২)” The Bangladesh National Digital Architecture (BNDA) Guideline 2019 এবং National Cyber security Strategy 2014 এইসব আইন, গাইডলাইন, বিধি ও নীতিমালা ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট Stakeholder এর মধ্যে সমন্বিত করার জন্য একক কর্তৃত্ব সরকারের। প্রশ্ন হচ্ছে সুপ্রীমকোর্ট রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র একটি শাখা। তার নিজস্ব “গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো” ও উপাত্ত ভান্ডার [২(খ)] নিজের কর্তৃত্বাধীন থাকবে নাকি সরকারের সহযোগী হয়ে কাজ করবে? যদি তাই হয় তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে।
জাতীয় ICT নীতিমালা ২০১৮ অনুযায়ী কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে উদ্ভূত সকল “তথ্য-উপাত্ত” অবশ্যই বাংলাদেশের ভৌগলিক অঞ্চলে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু ভার্চুয়্যাল শুনানির জন্য যদি “মাইক্রোসফ্ট টিম” “যুম” অথবা “গুগল ডু” তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা হলে তথ্য আদান– প্রদানের বিষয়টি তাদের হাতেই থেকে যাচ্ছে যা তারা বিশ্বের যে কোনও জায়গায় থেকে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রক্রিয়াজাত করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে এই সব সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সাথে সুপ্রীম কোর্টের “Data Processing Agreement (DPA)” এবং “Non-disclosure Agreement (NDA)” অপরিহার্য। তবুও শত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা স্বত্ত্বেও সাইবার আক্রমন থেকে পৃথিবীর উন্নত দেশের আইন বিভাগ ও Law firms এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষা পায়নি। “Panama Papers”কেলেঙ্কারি একটা বড় উদাহরণ। হেগে স্থায়ী আন্তর্জাতিক সালিশী আদালতে “দক্ষিন চীন সাগর” বিরোধ নিয়ে শুনানিকালে সাইবার আক্রমনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সুতারাং virtual বা e-judiciary কে কার্যকর করতে হলে এর অবশ্যই সুদৃঢ় নিরাপত্তার ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এরসাথে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যা আমাদের সংবিধানের ৪৩ ধারা মোতাবেক সুরক্ষিত সেই প্রশ্নটিও জড়িত। e-judiciary এর বিকাশ ও ফলপ্রসূ করার লক্ষে তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮, ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮, সাক্ষ্য আইন তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬, ডিজিটাল সুরক্ষা আইন ২০১৮ ইত্যাদির প্রয়োজনীয় সংশোধন পরিবর্তনের করতে হবে।
অধিকন্তু, প্রসিকিউশন এবং আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলির সাথে সমন্বয় না করে e-judiciary সফল হতে পারবেনা। জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি নীতিমালা ২০১৪ অনুসারে ভার্চুয়্যাল সিস্টেমের মাধ্যমে অপরাধের আরও ভাল তদন্ত, প্রতিরোধ ও বিচারের জন্য বিচার বিভাগকে বাংলাদেশ পুলিশের Crime Data Management System (CDMS) এর সাথে সহযোগিতা প্রয়োজন। e-judiciary এর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য উপরোক্ত জাতীয় আইন ও নীতিগুলি অনুসরণ করে একটি সুরক্ষিত জাতীয় সার্ভার, নেটওয়ার্ক এবং Management Information System (MIS) এরউপর a2i, ICT এবং UNDP কাজ করে যাচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর কারণে একটি ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হতে যাচ্ছে। অনেকে বলছেন আরও একটি শিল্প বিপ্লব আগত। ক্রমান্বয়ে প্রযুক্তি নির্ভর কর্মের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছি। যেমনঃ অফিসের পরিবর্তে Home Office, স্বাভাবিক স্কুলের পরিবর্তে Home School, E-Marketing, E- Business, E- Conferencing, Virtual Medical Consulting, ড্রোনের মাধ্যমে ঔষধ সরবরাহ, রোবটের মাধ্যমে হাসপাতালে সেবা প্রদান, করোনাকে tracing ও tracking করার জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহারও করছি। Necessity is the mother of invention. তবে এটা অনস্বীকার্য যে virtual court system কখনও traditional court system এর বিকল্প হতে পারেনা, তবে একটি আর একটির পরিপূরক হতে কোন আপত্তি থাকা উচিৎ হবেনা। Traditional court এবং virtual court system নিয়ে ভারতের প্রধান বিচারপতির ব্ক্তব্য প্রণিধানযোগ্য “… the traditional Open Court System, in its physical manifestation, and new age Virtual Court System are not antithetical to each other; on the contrary, both systems could definitely co-exist, delivering qualitative justice, wherever deployed in light of extant circumstances,”
এ.এস.এম. বদরুল আনোয়ার: অ্যাডভোকেট; সাবেক সভাপতি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। ই-মেইল: dharma_pur4@yahoo.com
[দ্রষ্টব্য: আমার এই লিখা তৈরী করতে, (১) জনাব মোঃ সাইমুম রেজা তালুকদার senior lecturer of Cyber Law at Brac University এর লেখা Cyber security of virtual court: Where does Bangladesh stand? (২) জনাব মোঃ সামীর ছাত্তার ও মোঃ খাদেমুল ইছলাম চয়ন এর লেখা Covid-19 and virtual courts: Are we ready? (৩) জনাব জাকির হোসেন Senior Judicial Magistrate, Feni এর লেখা Is virtual Court towards Digitization of Judiciary in Bangladesh? এইসব নিবন্ধের সাহায্য নিয়েছি। আমি তাঁদের নিকট কৃতজ্ঞ।]