শ্রীকান্ত দেবনাথ:
আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি যে, ২০১৭ ও ২০২০ সালে এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা সনদ প্রাপ্তির জন্য আন্দোলন করছে। ইতোমধ্যে তারা স্বারকলিপি প্রদানসহ গত ৩০ জুন দেশব্যাপী মানববন্ধন পালন করেছে।
প্রথমে তাদের দাবির বিষয়ে একটু স্পষ্ট ধারণা নেওয়া দরকার। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এমসিকিউ পরীক্ষায় পাশ করা শিক্ষানবিশ আইনজীবীগণ যারা এখনো লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষা না হওয়ার কারণে বার কাউন্সিল সনদ পায়নি তারা সরাসরি গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে আইনজীবী হিসেবে সনদ প্রদানের দাবি করছেন।
এখন প্রশ্ন হলো তারা এমন দাবি কেন করছেন? তাদের এই দাবির সমর্থনে কি যুক্তি রয়েছে?
আমরা এটা জানি, প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। ঠিক তেমনি অনিয়মই আন্দোলনকে অত্যাবশ্যক করে তোলে। এখানে অনিয়ম বলতে নিয়ম সঠিকভাবে পালন হয়নি বোঝানো হয়েছে। এখন দেখার বিষয় কি কারণে শিক্ষানবিশরা লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষা ছাড়া সরাসরি সনদের দাবি করছে। এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখা দরকার, বিভিন্ন মত বা দাবি ব্যক্তিভেদে আলাদা হতে পারে। তবে যখন উক্ত দাবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তার গ্রহনযোগ্যতা পরিবর্তিত হয়। কখনো তা ইতিবাচক কখনো তা নেতিবাচক।
শিক্ষানবিশদের দাবির বিষয়ে তাদের প্রথম যুক্তি ছিল পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা। দীর্ঘদিন যাবত পরীক্ষা না হওয়ায় এবং পাশাপাশি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আরো দীর্ঘদিন যাবত পরীক্ষা না হওয়ার আশঙ্কা তৈরী হওয়ায় তারা এমন দাবি করছেন বলে জানা গেছে।
এখন দেখি পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা কতো বছরের? পূর্বে প্রতি ১ বছরে বার কাউন্সিল থেকে ২টি সম্পূর্ণ পরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সনদ প্রদান করা হতো। কিন্তু ২০১৭ সালের জুলাই মাসে একটি এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তারপর যথাক্রমে লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সকল পরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সনদ প্রদান করা হয়। তারপর দীর্ঘ ১৫ মাস পর ২০২০ সালের ফেব্রয়ারী মাসে আরেকটি এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে ১ বছরে ২ বার পরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সনদ প্রদান করা হতো। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, একটি এমসিকিউ পরীক্ষা থেকে আরেকটি এমসিকিউ পরীক্ষার সময়ের ব্যবধান ৩১ মাস (জুলাই, ২০১৭ থেকে ফেব্রয়ারী, ২০২০)। অর্থাৎ যে সময়ে শিক্ষানবিশরা বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিতে পারতো বা বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের পরীক্ষা নেওয়া উচিত ছিল, সেখানে মাত্র একটি পরীক্ষা হয়েছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো ৩ ধাপের পরীক্ষার মধ্যে সবে মাত্র একটি ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। আরো ২টি ধাপের পরীক্ষা বাকি রয়েছে। যথাক্রমে লিখিত ও ভাইবা।
এখন দেখার বিষয় এমসিকিউ পরীক্ষা শুরু করে ভাইবা শেষ করে সনদ প্রদান করা পর্যন্ত কতো দিন সময় লাগে। গত এমসিকিউ পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। আর বাকি পরীক্ষা সম্পন্ন করে সেই ব্যাচকে সনদ দিয়েছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। অর্থাৎ পরীক্ষা প্রক্রিয়ার ব্যপ্তি হলো ১৭ মাস। অর্থাৎ যদি করোনা পরিস্থিতি না থাকতো তবে বর্তমান এমসিকিউ উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশরা ২০২১ সালের জুলাই মাসে নাগাদ সনদ পেতে পারতো, শর্ত হলো যদি গত বছরের ন্যায় একই সময় ব্যয় করা হয়। কারণ প্রত্যেকবার দেখা গেছে পূর্বের বছর পরীক্ষা সম্পন্ন হতে যে সময় লেগেছিল পরের বছর তার চেয়ে বেশি সময় লাগে। এ যেন একটা বিলম্ব আরেকটি বিলম্বকে অতিক্রম করার প্রতিযোগীতা। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের এমসিকিউ পরীক্ষায় যে অংশগ্রহণ করতে পারেনি সে পরবর্তী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সনদ পেতে পারে সম্ভাব্য ২০২১ সালের জুলাই মাসে। অর্থাৎ ৪ বছর পর! বর্তমান করোনা পরিস্তিতিতে বলা হচ্ছে করোনা সংকট অতিক্রম করতে ২/৩ বছর সময় লাগতে পারে। তাহলে সনদ পেতে মোট সময় লাগবে ৬/৭ বছর! অর্থাৎ যেখানে প্রয়োজন সর্বোচ্চ ১ বছর। তা হতে চলেছে ৬/৭ বছর!
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় ৮০ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। পরীক্ষায় পাশ করে ৮৭৬৪ জন। এছাড়া ২০১৭ সালের এমসিকিউ পরীক্ষায় প্রায় ৩৪ হাজারের বেশি অংশগ্রহণ করে পাশ করেছে ১১ হাজার ৮৪৬ জনের মতো। কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫৯০ জন। যারা এবার লিখিত পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। অর্থাৎ মোট অপেক্ষমাণ লিখিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হল প্রায় ১২৩৫৪ জন। গত পরীক্ষায় ভাইবায় অকৃতকার্য হয়েছে প্রায় ৫০৪ জন। অর্থাৎ আন্দোলনকারী সনদ প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় ১২৮৫৮ জন।
গতবার লিখিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১১৮৪৬ জন। সেখান থেকে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয় প্রায় ৭৭৫২ জন। অর্থাৎ প্রায় ৬৫ শতাংশ। এর অর্থ এটা নয় যে প্রত্যেকবার একই হারে উত্তীর্ণ হবে তবে যদি আনুপাতিক হারে সেটা ধরেও নিই তবে এবারের ১২৮৫৮ জন অপেক্ষমাণ পরীক্ষার্থী থেকে প্রায় ৮৪০০ জনের মতো শিক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার মতো যোগ্য হতে পারে। অনুপাত একই হবে তা বলা হচ্ছে না। কিন্তু কাছাকাছি হতে পারে এটা অনুমান করাটা খুব বেশি অযৌক্তিক হবে না। হয়তো আরো কম বা বেশি হতে পারে। এবার একটা কথা প্রচলিত আছে যে এবার এমসিকিউ পরীক্ষা অন্য যে কোন পরীক্ষার কঠিন হয়েছিল। যেখানে গতবার এসসিকিউ পরীক্ষায় প্রায় ৩৫% পাশ করেছিল সেখানে এবার পাশের হার ২২% এরও কম।
এখন প্রশ্ন হলো নিয়মিত প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা হলেও ১২৮৫৮ জনের মধ্যে প্রায় ৮ হাজার ৪০০ জন সনদ পেতে পারতো (অনুমানিক অর্থে)। সেক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা না নিয়ে শুধুমাত্র ভাইবা নিয়েও বর্তমান পরিস্থিতিতে সনদ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মতো সিদ্ধান্ত বার কাউন্সিল নিতে পারে। কিন্তু কেন লিখিত পরীক্ষা বাদ দিয়ে শুধু ভাইবা প্রক্রিয়া সনদ দেওয়ার কথা বলছি। কারণ লিখিত পরীক্ষা এমন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হয় যেখানে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু সেই মতে ভাইবা প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে এবং ঝুঁকি অনেক কম। তাই ভাইবা নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করছি। এছাড়াও আরেকটি কারণ হলো যেহেতু মোট ৩টি ধাপে পরীক্ষা ছিল। সেখানে মাত্র ১টি ধাপে পরীক্ষা নিয়ে সনদ প্রদানে প্রকৃতযোগ্য ব্যক্তি সনদ পাবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বিধায় অন্তত যেন ভাইবা পরীক্ষা নিয়ে মোট ২টি ধাপের মাধ্যমে পরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এর কারণ হলো এটা এমন নয় যে, তাদের কোন মতেই মেধা যাচাই হচ্ছে না। কারণ তারা ৩টি ধাপের মধ্যে ২টি ধাপের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। আবার এটা এমন নয় যে, এর আগে তা কখনো হয় নি। কারণ পূর্বে ৩ ধাপে পরীক্ষা হতো না। তার মানে এই নয় যে, পরীক্ষা পদ্ধতিকে স্থায়ীভাবে ২ ধাপে করা হোক। বরং বর্তমান সংকটকে মোকাবেলা করার জন্য এমনটা করা যেতেই পারে। (বার কাউন্সিল পরীক্ষার ৩ ধাপ, যথাক্রমে- এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক)
এখন বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিবে যে, সরাসরি সনদ প্রদান করবে নাকি ভাইবা নিয়ে সনদ প্রদান করবে। তবে বার কাউন্সিল সমীপে অনুরোধ থাকবে যেন পরিস্থিতির আলোকে ন্যায় ও সংকট মোচক সিদ্ধান্ত যেন গ্রহণ করেন।
এখন অনেকেই আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা করতে চায়। যখন ১ ধাপে পরীক্ষা নেওয়া হতো তখন কিন্তু ৩ ধাপে পরীক্ষা নেওয়া আইনে ছিল না। কিন্তু প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে আইন সংশোধন করে ৩ ধাপে পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছিল। তাহলে প্রয়োজনই আইন প্রণয়নের প্রসূতি। তাহলে কেন বর্তমান সংকটে শুধুমাত্র সংকট কালীন সময়ের জন্য আইন সংশোধন উচিৎ হবে না?
আবার এটা বলা হচ্ছে যে, বর্তমান সংকট কেটে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। কিন্তু তারা কেন অপেক্ষা করবে? বা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে অপেক্ষা করার মতো পরিস্থিতি তাদের আছে কি? যদি তাদের পূর্বে থেকে কোন সময়ক্ষেপণ না হতো তাহলে এটা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া যেত। কিন্তু যেখানে শিক্ষানবিশদের কারণহীন ভাবে ৩ বছর অপেক্ষায় রাখা হলো তাহলে এখন সংকটের অজুহাতে আরো ২/৩ বছর অপেক্ষার কথা বললেও তারা কোন যুক্তিতে সেটা মানবে বা মেনে নেওয়ার সামর্থ্য আছে? ইতোমধ্যে আইনজীবী সনদের আশায় যেকোনো পেশায় প্রবেশের যে সাধারণ সময় থাকে তা বহু আগে অতিক্রম করে ফেলেছে কিছু কিছু শিক্ষানবিশ। বর্তমানে খুবই অর্থনৈতিক সংকটে শিক্ষানবিশরা দিন যাপন করছে।
সনদ প্রদানের অর্থ এই নয় যে, তারা সবাই আদালত প্রাঙ্গনে পেশাগত জীবন অতিবাহিত করবে। এখন যে কোন আইন সম্পর্কিত পেশার ক্ষেত্রে আইনজীবী হিসেবে সনদ চায়, সে ক্ষেত্রে সনদ পেলে আন্দোলনকারী শিক্ষানবিশরা আইন সম্পর্কিত অন্যান্য পেশায় নিজেকে যুক্ত করতে পারবে।
সর্বোপরি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল হলো আইনজীবী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অভিবাবক। অভিবাবক হিসেবে দীর্ঘ সময়, করোনা ঝুঁকি, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি বিবেচনায় বার কাউন্সিল শিক্ষানবিশদের কল্যান হয় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এমন অনুরোধ সকল শিক্ষানবিশ আইনজীবীর।
শ্রীকান্ত দেবনাথ: প্রতিবেদক; ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম