কাজী ফয়েজুর রহমান:
বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক এক সময় পার করছে সকলে। অপ্রত্যাশিত এ সময়ের আঁচর লেগেছে আদালত অঙ্গনেও। নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ প্রায় সাড়ে তিন মাস। ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে আদালতের কার্যক্রম চালু থাকলেও সাময়িক এই ব্যবস্থা যে নিয়মিত আদালতের বিকল্প হতে পারে না সেটা সংশ্লিষ্টরাও জানেন এবং মানেন বলে বিশ্বাস করি। তবে এই লেখায় আলোচনার বিষয় ভার্চ্যুয়াল আদালত নয়। আইন বিষয়ক সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত থাকায় আইনাঙ্গনে সাম্প্রতিক যে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে তার একটি হচ্ছে নিয়মিত আদালত খুলে দেওয়া, না দেওয়া এবং অপরটি হচ্ছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সনদ সংক্রান্ত দাবী। নিয়মিত আদালত কবে খুলবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রধান বিচারপতির একারপক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। সরকারের সবুজ বাতির জন্যও অপেক্ষা করতে হবে। কারণটা পরিস্থিতি। এখানে আবার কেউ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন টেনে অরুচিতে ভুগবেন না আশা করি।
এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। ২০১৭ ও ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রিলিমিনারি (এমসিকিউ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রায় তেরো হাজার (১২৮৭৮ জন) শিক্ষার্থীকে কোনো লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ব্যতীত গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে আইনজীবী সনদ দেওয়ার দাবীতে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা। তাদের এই দাবীর নৈতিকতা কিংবা যৌক্তিকতা নিরূপণে যেতে চাই না। কেননা প্রয়োজন ছাড়া দাবীর প্রশ্ন আসেনা, আবার সব দাবীর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি কিংবা মতামত থাকবেই। তবে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের এই দাবী যে শেষমেশ পূরণ হবে না সেটা তারাও জানেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে এসব কর্মসূচি পালন করে লাভটা কি? লাভ আছে, সহজ কথায় লাভটা হলো করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বার কাউন্সিল যেন ঘুমিয়ে না যায়। অর্থাৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর যৌক্তিক সময়ের মধ্যে লিখিত পরীক্ষার আয়োজন করা। বার কাউন্সিলকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এসব কর্মসূচি জরুরী কারণ কয়েকবছর যাবত তালিকাভুক্তি পরীক্ষা নিয়ে সংস্থাটির গড়িমসি কিংবা দীর্ঘসূত্রিতা যা-ই বলি না কেন তা সহনীয় পর্যায়ের বাহিরে চলে যাচ্ছে। প্রতি বছর দুইবার তালিকাভুক্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করা কথা থাকলেও বার কাউন্সিল বছরে একটি তো দূরের কথা দুই বছরেও একবার করে তালিকাভুক্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ।
একথা অনস্বীকার্য যে বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা বছরব্যাপী নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া পরিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং জনবল স্বল্পতার কারণে তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়া যথোপযুক্ত সময়ে সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব। তবে নিয়মিত পরীক্ষা না নেওয়ার কারণেই পরিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে এবং এই দায় বার কাউন্সিলকেই নিতে হবে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে না চাপিয়ে বার কাউন্সিল লিখিত পরীক্ষা আয়োজনের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। কেননা এই মূহুর্তে এনরোলোমেন্ট কমিটির প্রায় সকল সদস্য অবকাশে আছেন। ভার্চ্যুয়াল মিটিং করে পরীক্ষার প্রশ্ন, হল নির্ধারণসহ অফিশিয়াল চিঠি চালাচালির কাজগুলো সেরে নিতে পারেন। পাশাপাশি যদি এমন ঘোষণাও দেওয়া যায় যে করোনা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নতি করলে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে তাহলেও কিন্তু শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অনিশ্চয়তা ভরা জীবনে কিছুটা আশার আলো আসবে।
পরিশেষে বলতে চাই, দেশের সামাজিক বাস্তবতায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে আইনজীবী সনদ দিলে আন্দোলনরত শিক্ষানবিশদের পেশাদার জীবনে ‘করোনা আইনজীবী’ নামক ট্যাগ লেগে যাবে না সে নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারে? আমি বিশ্বাস করি শিক্ষানবিশ আইনজীবীরাও এভাবে সনদ চান না। তারা শুধু চান বার কাউন্সিল ঘুম থেকে জেগে উঠুক, আইনজীবীদের সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও আইন পেশার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি অনাগত আইনজীবীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুক।
কাজী ফয়েজুর রহমান: বার্তা সম্পাদক; ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম