নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধনের আইন (২০২০) বিষয়ক যে প্রস্তাবনা করেছে তা স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মহিলা পরিষদ। নতুন প্রস্তাবিত আইনটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ও নারীর ক্ষমতায়নের পরিপন্থী বলেও দাবি তুলে আইনটির বিরোধিতা করেছেন তারা।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন-২০২০ (প্রস্তাবিত) বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে অনলাইনে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি।
গতকাল শনিবার (৪ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টায় শুরু হওয়া এই সভায় স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী। কিন্তু নারীর কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জোরালো তেমন নয়। পূর্বের আইনটি একটি যৌক্তিক আইন ছিল যা সকল রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে গৃহীত হয়। কিন্তু আইনটি বাতিলের জন্য সম্প্রতি সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী যা নারীর ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। এই অবস্থায় আগের আইনটি বলবৎ রাখার দাবি জানাই।
সভার শুরুতে বক্তারা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধনের আইনটি চলমান কোভিড-১৯ মহামারির পরিস্থিতিতে স্থগিত রাখার পক্ষে মতামত দেন এবং আইনটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ও নারীর ক্ষমতায়নের পরিপন্থী হওয়ায় উপস্থিত সকলে আইনটির বিরোধিতা করেন।
সভায় মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, গত কয়েক দশক ধরে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অর্জন হলো রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর ৩৩ শতাংশ অংশগ্রহণের দাবি নিশ্চিত করা। নারী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই সক্ষমতা এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশনের বর্তমান সিদ্ধান্তে নারীর মতামত নেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সূচকে এগিয়েছে কিন্তু নারীর সার্বিক ক্ষেত্রে অবস্থান সুদৃঢ় করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও কাজ করতে হবে।
সমতাভিত্তিক ও জেন্ডারসমতাপূর্ণ সমাজ গড়তে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সকলকে কাজ করার কথা বলেন এবং সকল রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গ্রহণে নারীর দিকগুলোকে বিবেচনা করার আহ্বান তিনি।
ঐক্য ন্যাপের সভাপতি রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংশোধনের বিষয়টি বেশ রহস্যময়। কেননা অতীতের নানা রাজনৈতিক অবস্থায়ও আরপিও নিয়ে কাজের বিষয়টি আসেনি। এখনও নারীর অধিকার সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারী সংগঠনগুলোকে এখনও আন্দোলন করতে হয়।
সভায় সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল মহামারির সংকটের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে আরপিও সংশোধনের বিষয়টি স্থগিত রেখে বরং করোনা সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতামূলক কাজ করে সরকারকে সহায়তা করার আহ্বান জানান।
পাশাপাশি নারীদের সমঅধিকারের কথা উল্লেখ করে বলেন, যার যতটুকু যোগ্যতা আছে সে ততটুকু নিয়ে এগিয়ে যাবে। সে জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আরোমা দত্ত বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি জেন্ডারবান্ধব নয়। অথচ দেশের স্বাধীনতা রক্ষাসহ সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে, নারীরা গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশননের আইন সংস্কারের প্রস্তাবের বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাঝে একটি গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এটি কীভাবে কোন কোন দলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে হলো সকলকে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাই।
তিনি দলগুলোর মতামত ছাড়া প্রস্তাবিত আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উল্টে দেয়ার একটা বড় ষড়যন্ত্র।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ করে চিঠি দেয়ার পাশাপাশি সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সচেতন থেকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের ৩৩% অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করে বলেন, এটি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন ছিল। তিনি আরপিও পরিবর্তনের চেয়ে সংস্কারের পক্ষে নিজের মতপ্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, এই সংস্কার করার আগে নির্বাচন কমিশন পলিটিক্যাল পার্টির জন্য রোডম্যাপ তৈরি করতে পারত, প্রগ্রেস রিপোর্ট নিতে পারত। তিনি নির্বাচন কমিশনকে এর জন্য জবাবদিহিতা করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, নারীদের ৩৩% রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ কেবল একটি সংখ্যা নয়। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারীদের যে অবস্থান অর্জিত হয়েছে তা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে খুব বেশি হয়েছে সেটি বলা যাবে না। সহিংসতা বর্তমান সময়ে থেমে নেই। প্রায় ১১২৫টি পারিবারিক নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুধু পদায়ন দিয়ে ক্ষমতায়ন হয় না। এর জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। বাধা কীভাবে দূর করা যায় সেসব বিষয়ে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নির্বাচন কমিশনকে আইন সংস্কারের প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, নারীদের অবদান সম্পর্কে অপপ্রচার চালানো হয়, তাদের ঘরের কাজের মধ্যে আবদ্ধ রাখার প্রচার চালানো হচ্ছে। এসব অপপ্রচার বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ণের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আরপিওর মেয়াদ ছয় মাস থাকা সত্ত্বেও এই দুর্যোগকালে নির্বাচন কমিশনের আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করে। রাজনীতিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীর প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। আইনের রোডম্যাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে এর কার্যকারিতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। পূর্বের আইন বহাল রাখার জন্য তিনি নারী সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি আদায়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের শম্পা বসু বলেন, নির্বাচন কমিশন শর্তপূরণের যে সময়সীমা তুলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে তা যৌক্তিক নয়, নারীর অগ্রগতিতে বাধাগ্রস্ত করবে, মৌলবাদ বৃদ্ধি করবে। বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়া নারীবান্ধব নয়। রাজনীতি মানুষের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার না হওয়া পর্যন্ত এর মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে না। আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে অবিলম্বে রাজনৈতিক দল এবং নারী সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা করার আহ্বান জানান তিনি।
মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ঝর্ণা বাড়ই বলেন, আওয়ামী লীগ নারীর ক্ষমতায়নে সবসময়ই কাজ করে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের পূর্বে বা সংস্কারের আগে সকল দলের মতামত গ্রহণ করবে। নারীরা কিন্তু তাদের কাজের জায়গায় স্বচ্ছ এবং দক্ষ। ৩৩% থেকে বৃদ্ধি করে ৪৫% বা ৫০% করা যেতে পারে।
সভায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং সম্পাদকমণ্ডলীসহ ২৭ জন উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত আন্দোলন সম্পাদক রেখা চৌধুরী।
শনিবার (৪ জুলাই) মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।