কাজী শরীফ:
শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা আগামীকাল (৭ জুলাই) ঢাকায় আন্দোলন কর্মসূচি আহ্বান করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে জানলাম। তাদের দাবি সর্বশেষ প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা ছাড়াই আইনজীবী সনদ দেয়া হোক।
আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে মত দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার লেখার উদ্দেশ্য আন্দোলন বিষয়ে আমার ভাবনার প্রকাশ।
আপাতদৃষ্টে লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষাবিহীন এ সনদ প্রাপ্তির দাবি অযৌক্তিক বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে এ দাবি একদম তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার মত বলে আপনারও মনে হবে না। ২০১৭ সালে সর্বশেষ আইনজীবী নিয়োগ পরীক্ষা সমাপ্ত হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে তিন বছর। তিন বছরে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আইনে পড়ে শিক্ষানবিশ হিসেবে দিন পার করছেন।
একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর জীবন কেমন সেটা আসলে এ পরিস্থিতিতে না পড়লে বোঝানো মুশকিল। বাংলাদেশের অন্য কোন বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করে সে বিষয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে প্রিলিমিনারি, লিখিত বা ভাইভা পরীক্ষা দিতে হয় না। একমাত্র আইনেই তা করতে হয়। শুধু এ যুক্তিতে কেউ কেউ পরীক্ষা তুলে দেয়ার কথা বললেও আমি এর পক্ষে নই। কারণ অন্য কোন বিশেষায়িত বিষয়েই শুধু দুই বছর পড়ে সে বিষয়ে সনদ পাওয়া যায় না। ডাক্তার হতে গেলে পাঁচ বছর পড়তে হয় এবং এরপর এক বছর ইন্টার্ন ডাক্তার হিসেবে কাজ করতে হয়। প্রকৌশলী হতে গেলেও চার বছর সম্মান পর্যায়ে পড়তে হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দুই বছরের কোর্স থাকায় এবং এতে বয়সের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় যে কোন ব্যক্তি সম্মান বা পাশ কোর্স থেকে পাশ করলেই আইনে পড়তে পারেন। তাদের কোর্সের মেয়াদকাল মাত্র দুই বছরের। চার বছর সম্মান পর্যায়ে পড়লে যতগুলো বিষয় পড়তে হয় স্বাভাবিকভাবেই দুই বছরে এর চেয়ে কম বিষয় পড়তে হয়। সুতরাং যতদিন দুই বছরের পাশ কোর্স বন্ধ হচ্ছে না ততদিন পরীক্ষা নেয়ার বিকল্প নেই।
আইনজীবীরা যেহেতু প্রথম শ্রেণির নাগরিক সেহেতু একজন ব্যক্তিকে আইনজীবী হতে হলে বিদ্যাবুদ্ধিতেও প্রথম শ্রেণির হওয়া আবশ্যক। কম বিষয় পড়ে মাত্র দুই বছরের কোর্স করে কোনরকম পরীক্ষা ছাড়া আইনজীবী সনদ দেয়া হলে আইনাঙ্গনে ভয়াবহ অবস্থা হবে। মানহীন অনেকেই আইনপেশায় প্রবেশ করবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ল’ কলেজে সন্ধ্যার পর যে ক্লাস হয় তাতে আইন শেখাটা যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুই বছরের কোর্স বন্ধ করে দিলে ও চার বছরের সম্মান কোর্স চালু থাকলে সনদ প্রদানের পরীক্ষা না নিলেও চলবে। কিন্তু সেটা করতে হলে আরও কিছু বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সে বিষয়ে অন্য কোন লেখায় আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমসাময়িক প্রসঙ্গে আসি।
শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা যে মানবেতর জীবনযাপন করেন তা অবর্ণনীয়। সারাদিন কাজ করার পর সিনিয়র যে অর্থ প্রদান করেন তা দিয়ে তারই একদিনের খরচ হয় না! ফলে পরিবারে অবদান রাখার সুযোগই থাকে না। পরিবারে নিজের অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। এদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হিসেবে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা আইন পাশ করার পর পরিবারে আর্থিক অবদান রাখার প্রত্যাশায় তীর্থেরকাক হয়ে বসে থাকে অভিভাবকরা। পরিবারে সামান্যতম অবদানও রাখতে না পারার মানসিক পীড়নে সে দগ্ধ হতে থাকে প্রতিনিয়ত।
অত্যন্ত দু:খজনক হলেও সত্য আদালতপাড়ায়ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা পান না উপযুক্ত সম্মান। গলায় ঝোলানো লাল টাই দিয়ে তাকে আগেই আলাদাভাবে চিহ্নিত রাখা হয়। তার উপর আইনজীবী সমিতিগুলোর একের এক নোটিশে তাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত দেয়া হয়। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। একদিন আমি এজলাসে বসে একটি মোকদ্দমার জেরা শুনছিলাম। একজন বিজ্ঞ আইনজীবী খুবই সুন্দরভাবে জেরা করছিলেন। দুপুরের পর বলে আদালতে একদমই ভীড় নেই। একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে দেখছি বেশ পেছনের বেঞ্চে বসে কান খাড়া করে জেরা শোনার চেষ্টা করছেন। আমি বললাম আপনি সামনে আসুন। লার্নেডের জেরা শুনুন। শিখুন। শিক্ষানবিশ আইনজীবী আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানান তাদের সামনের দিকে এসে দাঁড়ানোর ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে!
এক আইনজীবী সমিতিতে বারের বাৎসরিক ভোজে ও ইফতার মাহফিলে শিক্ষানবিশদের আসতে মানা করা হয়েছে ঘোষণা দিয়ে! যে ব্যক্তি আজ বাদে কাল আইনজীবী হবেন, যিনি ইতোমধ্যে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছেন তার প্রতি এমন নির্দেশ শুধু দৃষ্টিকটুই নয় অমানবিকও!
বার কাউন্সিল একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তারা কী করবে, কীভাবে করবে এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করবো না। আমি যে পদে আছি সে পদে থেকে এ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত হবে বলেও মনে হয় না। তবে এটুকু বলতে পারি প্রতিবছর পরীক্ষা নেয়ার যে দায়িত্ব তাদের সে দায়িত্ব অবশ্যই পালন করা উচিত। ২০১৭ সাল থেকে যারা আইন বিষয়ে পাশ করে এখনো কালো গাউন গায়ে জড়াতে পারেনি তাদের একটি দিনও যেহেতু কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না সেহেতু সে মূল্যবান নষ্ট করার অধিকারও কারো নেই।
এবার লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা করোনার কারণে না নেয়ার যে দাবি উঠেছে তা নিয়ে বার কাউন্সিল যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিক। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের মানবেতর দিনের অবসান হোক। নিয়মিত পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্ব বার কাউন্সিল পালন করুক।
কাজী শরীফ: সহকারী জজ, নোয়াখালী।