তামান্না ফেরদৌস:
বৈশ্বিক মহামারীতে বিপর্যস্ত পৃথিবী, চারিদিকে এমন অনিশ্চয়তার মাঝে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকাটাই এখন সবার একমাত্র স্বপ্ন। সর্বপ্রথম চীনে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৯ কোভিড-১৯ সম্পর্কে সরকারী প্রজ্ঞাপন জারী করে আর বাংলাদেশে ৮ই মার্চ, ২০২০। ৮ই মার্চের পরে অবরুদ্ধ জীবনে সবাই। প্রতিনিয়ত এক অদেখা শত্রুর ভয়ে শঙ্কিত মানুষ। ২৬শে মার্চ থেকে সবার জীবনের সব আয়োজন ভুলে গিয়ে একমাত্র স্বপ্ন বেঁচে থাকার সাধ নিয়ে পরিবারসহ গৃহবন্দি। বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়েও নিজের জীবনের শেষ সঞ্চয়কে সম্বল করেই জীবিকা নয় জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে ঘরে থাকছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার Stay Home; Stay safe শ্লোগানকে পুঁজি করে।
এমন রুদ্ধ জীবনেই হঠাৎ করে বজ্রাঘাত হয়ে আসে যখন পরিবারের কোনো সদস্যের মাঝে একটু জ্বর-কাশি বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) স্বীকৃত কোভিডের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেখানে গত প্রায় চার মাসে কোন নাগরিকই তার নিত্য চিকিৎসার প্রয়োজনেও প্রাণঘাতি ভাইরাসের ভয়ে হাসপাতালমুখো হচ্ছেনা সেখানে কোভিডের লক্ষণ পেলেই জীবনকে হাতের মুঠোয় করে ছুটছে হাসপাতাল পানে।
খাদ্যের পরে জীবনের অন্য সকল মৌলিক চাহিদাকে ঝেড়ে ফেলে শুধু চিকিৎসাই মানুষের কাছে এখন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা। এই করোনা যুদ্ধে চিকিৎসকদের সম্মুখ যোদ্ধা মেনে সর্বসম্মান ও ভক্তি দিয়ে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবন সঁপে দেয় মানুষ তাদের হাতে। তারা যা নির্দেশ করেন তাই মেনে চলে নিষ্ঠার সাথে শুধু বেঁচে থাকার নিমিত্তে। চিকিৎসকগণ ও চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত সকলেই মানুষের জীবনে এখন দেবদূত। তাদের প্রতি বিশ্বাস-ভক্তি আর তাদের দেয়া নির্দেশনা যখন জীবনের একমাত্র পাথেয় তখন আবার সেই সব চিকিৎসক আর চিকিৎসা সেবা কর্মিদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত অবহেলাই মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে বা জীবনকে করছে চরম ঝুঁকির সম্মুখীন। পরম আপনজন হারিয়ে কেউ হন সর্বশান্ত অথবা স্বীকার হন নির্বাক নীরব মানসিক রোগের। এমন অবহেলা বা চিকিৎসাজনিত অবহেলা (Medical Negligence) বা অসদাচরণের (Malpractice) এর প্রতিকার চাইতে গিয়ে মানুষ হচ্ছে আরও হেনস্থা বা আশাহত কেননা অদ্যাবধী দেশে প্রচলিত আইন ও তার প্রয়োগ পন্থা এই অপরাধের প্রতিকারের বিবেচনায় যথাযথ নয়।
একজন চিকিৎসাজনিত অবহেলার (Medical Negligence) শিকার বিচারপ্রার্থীর আইনজীবী যখন কোর্টের সামনে এই অপরাধ প্রমাণ করতে সচেষ্ট হবে তখন তার হাতে আছে শুধু দণ্ডবিধির ধারা ৩০৪এ কিংবা ধারা ৩৩৬, ৩৩৭ এবং ৩৩৮। যা কিনা অভিযুক্তের অপরাধের তুলনায় নামমাত্র শাস্তি। অপরদিকে বিবাদীর পক্ষে ঢাল হিসেবে আছে দণ্ডবিধির ৮০ ও ৮৮ ধারা। অথচ দেশের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৩২ তথা জীবনের অধিকারকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলা হয়েছে এবং ৪৪ অনুচ্ছেদে এই অধিকার বলবৎ করার পথ দেখানো হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী একজন নাগরিকের যে সকল মৌলিক অধিকারকে নির্দেশ করে স্বাস্থ্য সেবা তার অন্যতম। আবার ১৮ অনুচ্ছেদ স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন নির্দেশ করে। আর উল্লেখিত এই সকল অধিকারকে প্রয়োগের বাধ্যবাধকতার জন্য আদালতের সামনে রিট আবেদন উপস্থাপনের হাতিয়ার ১০২ অনুচ্ছেদ। যার কারণে প্রজাতন্ত্রের একজন নাগরিক তার অধিকার আদায়ে সংক্ষুব্ধ হলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।
একই সাথে একজন রোগিকে যখন চিকিৎসার প্রয়োজনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অধীনে আনা হয় তখন রোগী-ডাক্তারের মাঝে যে চুক্তি হয় বিচারপ্রার্থী রোগী তখন চুক্তি আইনের অধীনেও বিচার প্রার্থনা করে তার ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তিসহ সংশিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দাবি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেওয়ানী দায় পরিশোধে বাধ্য করতে পারেন।
অপরাধ প্রমাণের জন্য আদালতের সামনে প্রথমেই প্রমাণ করতে হয় দায়ভার কার। মেডিক্যাল নেগলিজেন্স বা ম্যালপ্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে দায়ভার প্রমাণ করতে গেলে শুধু ডাক্তার নয় কন্ট্রিবিউটরি নেগলিজেন্স (Contributory Negligence) এর আওতায় এই দায়ভার ডাক্তার সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারীর উপরেও বর্তায়। তাই বিচারপ্রার্থীর ক্ষতিপূরণ চাওয়া এবং তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রমাণিত না হলে মামলার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। আর এই বিষয়গুলো আদালতের সামনে সাক্ষী প্রমাণসহ উপস্থাপন করা গেলেও আদালত সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে দায়ী করে বিচার শেষে দেশে প্রচলিত যে আইনের আলোকে আদেশ প্রদান করেন সে আইন বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোটেই যথাযথ নয়।
ইদানিং কালে উচ্চ আদালতের বিচারকগণ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বলে অনেক রায় প্রদান করছেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তারপরে; কেননা এই আদেশের কার্যকারীতা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রচলিত আইনে নেই কোন বাধ্যকর নীতিমালা বা মনিটরিং সেল এবং স্বাস্থ্য বিভাগেও নেই এমন কোন কর্তা ব্যক্তি যাকে আদালতের আদেশ সঠিক বাস্তবায়ন না হবার জন্য সরাসরি দায়ী করা যায়। যেমনটা আছে অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩-এ ব্যাড লোনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা দায়ী হবেন।
এত সকল প্রতিকূলতার মাঝেও উচ্চ আদালত গত ৩০ জুন ভার্চ্যুয়াল আদালতে চিকিৎসা অবহেলার কারণে যেসকল আদেশ প্রদান করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার জবাবে জানিয়েছে তারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কোনো অভিযোগ পায়নি বিধায় তাদের করার কিছু নেই এবং লোকাল থানার পক্ষ থেকে এই অভিযোগ গ্রহণে অনিচ্ছার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট থানা সমূহের জবাব হচ্ছে তাদের উপরে এই বিষয়ে কোনো নির্দেশন নেই।
বৈশ্বিক মহামারীর এমন কঠিন সময়ে এসে গত চারমাসে স্বাস্থ্যখাতের এহেন পরিস্থিতি প্রতিটি নাগরিকের মর্মে আঘাত হেনেছে; করেছে ভীষণভাবে শঙ্কিত। সবার মাঝেই প্রশ্ন, এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? কীভাবে নিশ্চিত হবে দেশের স্বাস্থ্য সুরক্ষা? এর সমাধান একটিই আর তা হল দেশে প্রচলিত চিকিৎসা জনিত অবহেলা বা Medical Negligence আইনকে আরও অধীকতর সুসংগঠিত করা, আইনের শাস্তি ও জরিমানার মাত্রা বৃদ্ধি করা এবং সে আইন মানতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে যতদিনে আইন মানতে বাধ্যকর করা না যাবে ততদিনে দেশে স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান কোনো ভাবেই উন্নয়ন সম্ভব হয়ে উঠবেনা। মনে রাখতে হবে যতদিনে মানুষের পকেট থেকে জরিমানা প্রদানে বাধ্য ও নির্দেশিত শাস্তি পালন বাস্তবায়িত না করা হবে ততদিনে কোনো জাতিকেই আইন মানতে বাধ্যকর করা যাবেনা।
উন্নত বিশ্বে নাগরিকগণ প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য বলেই তাদের কাছে আইন মানার বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে যুগে যুগে মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই সংঘবদ্ধ থেকেছে এবং সেই সংঘবদ্ধ জীবনে নিজের স্বার্থেই আইন ভেঙেছে ও ভাঙবে এটা জেনেই আইন প্রণেতাগণ আইন তৈরী বা আইনকে অধীকতর কঠিন করে প্রণয়ন করেন।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্কটি গড়ে ওঠে শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। এই বিশ্বাস রাখতে গিয়ে সব রোগীই যেমন অবহেলার কারণে ক্ষতির শিকার হন সেটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি যিনি এই বৈশ্বিক মহামারি কালীন শুধু অবহেলার কারনে ক্ষতির শিকার হন তার ক্ষতিপূরণ বা ক্ষত লাঘবের প্রয়োজনে Medical Negligence আইনের কার্যকারিতা ও স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করে দিনে দিনে তার মান উন্নয়নের সাংবিধানিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার এখনই সময়।
তামান্না ফেরদৌস: সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।