মোকাররামুছ সাকলান:
বেশকদিন ধরে সারাদেশের আইনে শিক্ষানবিশগণকে দেখলাম সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে অনশন পালন করছেন। আন্দোলনের শ্লোগান হচ্ছে “দাবী মোদের একটাই গেজেট করে সনদ চাই”। আজকের লেখায় এই দাবির আইনগত যৌক্তিকতা নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা করছি।
হ্যাঁ, আইনজীবী হতে হলে কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। এই নিয়মের মাঝে প্রথম পর্যায় হল একজন আইনে স্নাতক পাশ করা ছাত্র প্রথমে দশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অন্য যেকোন আইনজীবীর সাথে ন্যূনতম ছয় মাসের শিক্ষানবিশকাল পার করবেন। এরপর বার কাউন্সিল কর্তৃক নির্ধারিত এমসিকিউ (MCQ) পরীক্ষায় পাশ করে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করতে হবে। তারপর নির্ধারিত বোর্ডের সামনে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাশ করলেই বার কাউন্সিল গেজেটের মাধ্যমে একজন শিক্ষানবিশকে আইনজীবী হিসাবে ঘোষণা দেবেন অর্থাৎ সেই শিক্ষানবিশ দেশের সমগ্র জেলা আদালতে আইনজীবী হিসাবে আইন পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারবেন।
কিন্তু হাইকোর্টের সোনালী ব্যাংকের সামনে যেসব শিক্ষানবিশ গেজেট করে সনদ চাইছেন তারা কি আদৌ কোন যৌক্তিক দাবী করছেন? তাদের স্লোগান ও বক্তব্য থেকে যতটুকু জানা যায় তারা বার কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত এমসিকিউ (MCQ) পরীক্ষায় সদ্য পাশ করেছেন মাত্র। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ এর কারনে বার কাউন্সিল এখন পর্যন্ত তাদের লিখিত পরীক্ষা আয়োজন করতে পারে নাই। কবে সেই পরীক্ষা আয়োজন করবে তারও কোন ঠিক সময় বার কাউন্সিল এখন পর্যন্ত ঘোষণা করতে পারে নাই।
The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Rules, 1972 এর বিধি 60A অনুযায়ী একজন শিক্ষানবিশকে অবশ্যই বার কাউন্সিল নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। বর্তমান আইনী কাঠামোতে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনভাবেই সরাসরি বার কাউন্সিল কোন শিক্ষানবিশকে শুধুমাত্র এমসিকিউ (MCQ) পরীক্ষায় পাশ করলে গেজেট করে সনদ প্রদান করতে পারেনা।
শুধু বাংলাদেশই নয় পৃথীবীর বিভিন্ন দেশে আইনে শিক্ষানবিশগণ এমন সমস্যায় পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বার কাউন্সিল সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। প্রথমে সেসব বার কাউন্সিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষার আয়োজন করেছে। তারপরও যদি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব না হয় তবে শিক্ষানবিশগণকে সাময়িক সময়ের জন্য পরীক্ষা নেবার আগ পর্যন্ত একজন সিনিয়র আইনজীবীর সাথে আদালতে মামলা উপস্থাপনের জন্য অনুমতি দেবার চিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন দেশেই এমন সম্পূর্ণ পরীক্ষা দিতে না পারা শিক্ষানবিশদের সরাসরি সনদ দেবার কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে এমনিতেই দেশের সামগ্রিক আদালতের কার্যক্রম খুব স্বল্প পরিসরে চালানো গেলেও পূর্ণ পরিসরে কখন চালানো হবে তা এখনও বেশ অনিশ্চিত। এই অনিশ্চিয়তার মাঝে সদ্য তালিকাভুক্ত আইনজীবী ছাড়াও প্রায় ৩০ হাজার আইনজীবীর জীবীকা নির্বাহ বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সেখানে শিক্ষানবিশদের এমন পরীক্ষা ছাড়া পূর্ণ সনদ পাবার দাবী আইনগতভাবে দেবার কোন সুযোগ একদমই নাই।
সামগ্রিকভাবে পরীক্ষা নেবার সময় বিবেচনা করলে দেখা যায় বার কাউন্সিল তাদের পূর্বের নিয়মে যেখানে প্রতিবছর একটি ব্যাচের পরীক্ষা নিতে পারত সেখানে বর্তমানে প্রায় তিনবছরেও একটি ব্যাচের পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারছেনা। এক্ষেত্রে সুপ্রীমকর্টের নির্দেশনা থাকলেও বার কাউন্সিল সে নিয়মটি অনুসরণ করতে পারছেনা। এক্ষেত্রে যে বাস্তব সমস্যাটি সামনে এসে দাঁড়ায় তা হল আগের চেয়ে বার কাউন্সিলে শিক্ষানবিশের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সর্বশেষ ব্যাচে সনদ পাবার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষানবিশ। এমন পরিস্থিতে বার কাউন্সিলের এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষানবিশদের পরীক্ষা প্রতিবছর নেবার সক্ষমতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন।
গেজেটে নাম না থাকলে কোন শিক্ষানবিশ আজ পর্যন্ত আইনজীবী হতে পারে নাই। তবে সম্পূর্ণ পরীক্ষা সম্পন্ন করেই তা অর্জন করতে হয়েছে। দেশে আইনজীবী সনদ দেবার সময় শিক্ষানবিশদের মান কেমন হবে তা নির্ভর করে বার কাউন্সিল কোন মানদণ্ড অনুসরণ করে তার উপর। এখনো যেদেশে টাউটদের চাপে অনেক আইনজীবী নিজেদের পেশার মান ধরে রাখতে পারছেনা সেখানেসম্পূর্ণ পরীক্ষা না দিয়েই যদি এমন সনদপ্রাপ্তির আন্দোলন দেখি তবে ভবিষ্যতের আইন পেশার জন্য কি শঙ্কা অপেক্ষা করছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আজকে শিক্ষানবিশদের এমন শ্লোগান নিশ্চয় আইন পেশার জন্য সন্মানজনক নয়। বার কাউন্সিল সঠিক সময়ে এধরনের দাবীদাওয়া নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে বর্তমান আইন পেশাজীবীসহ দেশের সামগ্রিক বিচারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আইনজীবীদের সামাজিক অবক্ষয় রোধসহ বার কাউন্সিলের কাছে বিনীত নিবেদন শিক্ষানবিশদের রাস্তা থেকে তুলে এনে তাদের সঠিক সময়ে পরীক্ষায় বসতে দিয়ে তাদের মেধা যাচাই করুন এবং তাদের ভবিষ্যৎ সঠিক সময়ে নির্ধারণের সুযোগ দিন। মেধাবী শিক্ষানবিশদের আইন পেশায় আসার দ্রুত সুযোগ দিন যাতে আমারা সবাই বলতে পারি “যার আছে অনেক গতি সেই করে ওকালতি”।
মোকাররামুছ সাকলান: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।