করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইদ্রিসুর রহমানের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্মরণসভায় “আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এডভোকেট ইদ্রিসুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়, তিনি মানবাধিকার আইনজীবীদের জন্য একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ” বলে মন্তব্য করেছেন বক্তারা।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ইদ্রিসুর রহমানের স্মরণে শনিবার (১১ জুলাই) অনলাইন স্মরণ সভার আয়োজন করে। বিচারপতি, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, সহকর্মী, সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিসহ প্রায় ৩,০০০ জন অনলাইন স্মরণসভায় অংশগ্রহণ করেন। অনেকেই ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন।
সদ্য প্রয়াত আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমানের সঙ্গে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং অনলাইনে অংশগ্রহণকারীবৃন্দ তাদের কর্মজীবন, শিক্ষাজীবন ও আইনি সহায়তা বিষয়ে কোর্টের মধ্যে, আইনজীবী সমিতি ভবনে এবং বাইরের কাজের স্মৃতিচারণ করেন।
অ্যাডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান ১৯৯৩ সালে ব্লাস্টের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকেই জনস্বার্থে বিভিন্ন ঐতিহাসিক মামলা যেমন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ও পুলিশী রিমান্ড সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারার মামলা, বস্তি উচ্ছেদ মামলা, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদালত স্থাপন মামলা, আদিবাসী অধিকার এবং প্রখ্যাত ১০ জন বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আইনগত সহায়তা প্রদানে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
দীর্ঘ ৩৪ বছর বাংলাদেশের আইনাঙ্গনে সফলতার সাথে একাগ্রচিত্তে কাজ করে অবিস্মরণীয় অবদান রাখা সুপ্রিম কোর্টের এই বিশিষ্ট আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও ব্লাস্টের প্যানেল আইনজীবী গত ২৪ জুন ২০২০, বুধবার ভোর ৪টায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ এবং ব্লাস্ট বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর সম্মানিত সভাপতি ড. কামাল হোসেন এর সভাপতিত্বে উক্ত স্মরণসভায় স্মৃতিচারণ করেন আপীল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী, আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো: নিজামুল হক নাসিম, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস, বিচারপতি আবদুর রব ও বিচারপতি মো: রিয়াজ উদ্দিন খান।
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীদের মধ্যে স্মৃতিচারণ করেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ও ব্লাস্ট বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর সদস্য অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, শাহ্দীন মালিক, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন ও সেক্রেটারী ব্যরিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাবেক অতিরিক্ত এর্টনী জেনারেল এম কে রহমান, অ্যাডভোকেট প্রতিকার চাকমা ও আইনুন নাহার সিদ্দিকা।
ব্লাস্টের অনারারী নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেনের সঞ্চালনায় স্মরণসভায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) -এর সেক্রেটারী জেনারেল তাহমিনা রহমান, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এস এম রেজাউল করিম, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, নিউ এজ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক মোঃ শহীদুজ্জামান এবং বহুল আলোচিত লিমন নির্যাতন ঘটনার লিমন হেসেন আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমানের সাথে তাদের কাজের স্মৃতিচারণ করেন।
স্মরণসভায় এডভোকেট মোহাম্মদ ইদ্রিসুর রহমানের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজের কথা তুলে ধরেন বক্তারা, এরমধ্যে ১৯৯৮ সালে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র রুবেল সন্দেহজনকভাবে পুলিশের হাতে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং পুলিশী নির্যাতনে তার মৃত্যু মামলা; ডিটেনশন মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে বেআইনীভাবে আটকের মামলা; ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক শিশুদের সাজা প্রদানকে চ্যালেঞ্জ করে রায়; ২০০১ সালে জননিরাপত্তা আইনে ৮৭ জন রিকশাচালকের আটককে চ্যালেঞ্জ করে মামলা এবং পরবর্তীতে আইনটি বাতিল; ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে তিনি ভারত, মায়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক যারা বাংলাদেশের কারাগারে আটক ছিলেন তাদের মুক্তি, যথোপোযুক্ত চিকিৎসা ও নিরপাত্তার জন্য মামলা ও নির্দেশনা; কারাবন্দীদের সঠিক ও মান সম্পন্ন খাবার প্রাপ্তির অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার রক্ষায় মামলা; ১৯৯৯ সাল থেকে মৃত্যু অবধি বস্তিবাসী জনগণের বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে সাগরিকা, গুদারাঘাট, আগারগাঁও, বিদ্যুৎ কলোনী বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় উচ্ছেদ স্থগিতসহ পুনর্বাসন আদেশ শুধু তাই নয় পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের অনেক উচ্ছেদের মামলার কথা বলা হয়।
এছাড়া পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য মামলা টুস্ট্রোক চালিত যান বাতিল (২০০০), পাহাড়কাটা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় আদালতের নির্দেশনা পেয়েছেন। ২০০৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত স্থাপনের যুগান্তকারী মামলায় তার অবদান উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে পারিবারিক আদালত স্থাপনের মামলাতেও তিনি নিরলস প্রচেষ্টা করে গেছেন।
তাছাড়া জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন মামলায় যেমন আয়োডিনের স্বল্পতা সংক্রান্ত মামলাসহ কারাগারে কারাবন্দীদের পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিতের লক্ষ্যে মামলা; আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার রক্ষায় তাঁর অবদান শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করা হয়।
স্মরণসভায় অ্যাডভোকেট ইদ্রিসুর রহমানের জীবন ও কর্ম লিপিবদ্ধ করে একটি জীবনী ও স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করা, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাথে যৌথভাবে ফেলোশিপ বা স্কলারশিপ চালু করা, প্রতিবছর স্মরণসভার আয়োজন করাসহ তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার সুপারিশ উঠে আসে।
সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন “সাংবিধানিক শাসনকে মানুষের কাজে লাগিয়ে ছিলেন প্রচার বিমুখ মোহাম্মদ ইদ্রিসুর রহমান, তার কারনে আইনজীবীদের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। তিনি মানুষকে আইনের আশ্রয় দিতে পেরেছিলেন।”