শহিদুল ইসলাম সজীব: শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছানোর আগে একটু পেছনে ফিরতে হবে। তারা কি হঠাৎ করেই অনশনের মত চূড়ান্ত অবস্থায় চলে এসেছে? বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা নতুন কিছু নয়। এই অর্জনে বার কাউন্সিল দেশের অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানকে বিনাতর্কে পরাজিত করবে। আমার মনে পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় পরীক্ষার তারিখ পেছানোর জন্য বন্ধুরা মিলে এমন কোন পরিকল্পনা নেই যা করতাম না। কিন্তু ল’ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা ছিলেন নাছোড়বান্দা। যেকোন উপায়ে সময়মতো পরীক্ষা তারা নিবেনই। কোনভাবেই তারা পরীক্ষা পেছাবেন না। হরতাল কিংবা অবরোধ শুনলেই আমরা জয়োল্লাস করতাম। কিন্তু এমনো হয়েছে অবরোধের মধ্যেও আইন অনুষদে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে! গোলাবারুদ হারিয়ে চুপসে যাওয়া সৈনিকের মত পরীক্ষার হলে ঢুকতাম। কি যে যন্ত্রণা! প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি এমনকি আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিপদ সংকেত চলমান অবস্থায় মোমবাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষা নেয়ার নজিরও আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছিলো। অথচ কি আশ্চর্যের ব্যাপার, গত দুই তিন বছর থেকে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা পরীক্ষা পেছানোর জন্য না, দেয়ার জন্য রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করছে! আন্দোলন সংগ্রাম করছে! কেন জানেন? কারণ এখানে ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার প্রশ্ন জড়িত আছে, নিজের একটা আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন জড়িত আছে। যেই পরীক্ষা আইন অনুযায়ী বছরে দুইবার হওয়ার কথা। সম্ভব না হলে অন্তত একবারের ব্যাপারে তো সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনাই আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকদের মত নিষ্ঠুর বার কাউন্সিল হতে পারে নি। বার কাউন্সিল এখানে সীমাহীন উদারতা দেখিয়েছে! পরীক্ষা নেয়ার কথা তো মনে হয় তারা মাঝেমাঝে ভুলেই যায়। এক পরীক্ষা থেকে আরেক পরীক্ষার ব্যবধান বাড়ানোর যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এবার দেড় বছর দেরি তো পরের বার দুই বছর। এখন তো সেটা তিন বছরে গিয়ে ঠেকেছে!
নিয়মিত পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হলে আন্দোলনকারীদের বেশিরভাগই এখন আইনজীবী হিসেবে তিন কিংবা চার বছর পূর্তী উদযাপন করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পারতো। যারা ৪-৫ বছর আইন পড়ে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন বিষফোঁড়া বাদে) আরো তিন-চার বছর ধরে কোর্টে সিনিয়রের ফাইল টানছে তারা কেউ মেধাহীন হতে পারে না। বছরের পর বছর পরীক্ষার জন্য আন্দোলন করে যারা এবার প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পাশ করেছে কিংবা যারা ২০১৭ তে পাশ করে রিটেনের আশায় তীর্থের কাকের মত বসে আছে তাদের আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা হয় নি, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আর করোনার এই বৈশ্বিক মহামারীতে পরবর্তী পরীক্ষা কবে নাগাদ নেয়া সম্ভব হবে সেটাও অনিশ্চিত। শিক্ষাজীবন শেষ করেও ৪-৫ বছর পরিবারের বোঝা হয়ে থাকার জন্য মোটেই শিক্ষার্থীরা দায়ী না। তারা নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে না। বার কাউন্সিলের পরীক্ষা পদ্ধতির স্বচ্ছতা আর তাতে কতটুকু মেধা যাচাই হয় সেই বিতর্কে নাই গেলাম।
তাই বলে পরীক্ষা না দিয়েই সনদ চাইবে? এমন প্রশ্নে আপনি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন, এখানে কেউ পরীক্ষা না দিয়ে আসে নি। সবাই প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পাশ করেই এসেছে। আগে তো দুই ধাপে পরীক্ষা নিয়েই সনদ দেয়া হতো। সেই সময়ের সনদধারী আইনজীবীরা এখন সফলতার সাথে আদালত দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আন্দোলনকে ব্যাঙ্গ করে অনেকে বিসিএস কিংবা বিজেএস প্রিলিমিনারি পাশ করা পরীক্ষার্থীদের সরাসরি গেজেট করে নিয়োগের কথা বলছেন। অথচ দুটো দু’মেরুর বিষয়। প্রথমটার সাথে সরকারী বেতন-ভাতাসহ নানান সুযোগ সুবিধা জড়িত। আর পরেরটা শুধু পেশাগত কাজ চালিয়ে নেয়ার অনুমতিপত্র মাত্র। অন্য সেক্টর যেমন ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারদের যেটা দরকারই হয় না। তার মানে আমি পরীক্ষার বিপক্ষে না। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আইন শিক্ষার মান যেহেতু এখনো সন্তোষজনক না সেহেতু বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতি পেশাগত মান নিয়ন্ত্রণের খাতিরে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা অবশ্যই নিয়মিত বিরতিতে নিতে হবে। একটা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতার জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন থমকে থাকতে পারে না। এটা শুধু অন্যায়ই না, অবিচার।
বিগত তিন-চার মাসে বৈশ্বিক মহামারীতে অন্য সব পেশার মানুষের মতো আইনজীবীদেরও চরম দৈন্যদশা স্পষ্ট হয়েছে। সাহায্যের জন্য আইনজীবীদের সরকারের কাছে হাত পাততেও দেখা গেছে। আইনজীবী হয়েও যেখানে আমরা চরম আর্থিক সমস্যায় পরেছি, সেখানে একজন শিক্ষানবিশ বেঁচে আছে কিভাবে? আমাদের তো অভিভাবক না হোক অন্তত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে, তাদের কি আছে? তারা কিভাবে চলছে? হাজার হাজার তরুণ শিক্ষানবিশ দু’বেলা খেতে পারছে কিনা সেটা ভাবার কোন সময় কি কারো হয়েছে?
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তায় নামা শিক্ষানবিশদের দাবির প্রতি সম্মান এবং সমর্থন জানাচ্ছি। তবে সবাইকে সরাসরি গেজেটভূক্ত করে আইনজীবী ঘোষণা করার সাথে আমি একমত না। যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে যোগ্যদের সনদ প্রদান করা যেতে পারে। এটা কোনভাবেই অযৌক্তিক হতে পারে না। শক্তভাবে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে যোগ্য আইনজীবী বের করা কঠিন কিছু হবে না। এক্ষেত্রে শুধু লিখিত পরীক্ষা বাদ পরবে, তিনটা পরীক্ষার মধ্যে দু’টোই নেয়া হবে। ‘পরীক্ষা ছাড়াই সনদ’ বলে ব্যাঙ্গ করার সুযোগ থাকবে না। দেশের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এইটুকু বিবেচনা বার কাউন্সিল মানবিক কারণে হলেও করতে পারে। বিশাল এক তরুণ মেধাশক্তির চলমান আন্দোলন আর অনশনে যদি একটা প্রদীপ নিভে যায়, তার দায় বার কাউন্সিল কিংবা রাষ্ট্র কেউ এড়াতে পারবে না।
শহিদুল ইসলাম সজীব: আইনজীবী; জজ কোর্ট, শরীয়তপুর। ই-মেইল: mdshahidulislam0038@gmail.com