মোঃ জুয়েল রানা: দেশে প্রচলিত আইন ব্যবস্থার মধ্যেই দ্রুত নিষ্পত্তির নিমিত্তে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে মামলা জট কমানো সম্ভব। আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য প্রত্যেক জেলায় একজন ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার থাকেন। যিনি বর্তমানে সিনিয়র সহকারী জজ বা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর পদমর্যাদার। তারা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি-তে খুবই কার্যকর ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছেন। এই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি-ই হবে দ্রুত মামলা জট কমানোর সফলতম পদক্ষেপ। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি-তে কোন ঝামেলা ছাড়াই উভয় পক্ষের পূর্ণ সন্তুষ্টিতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। যার ফলে আপীলসহ অন্য আর কোন নতুন মামলার উদ্ভব হয়না। এখানে সময়, শ্রম ও অর্থের খরচ কমে যায় বিধায় উভয় পক্ষই জিতে যায়।
আমরা জানি, ফৌজদারী মামলার বড় অংশ উদ্ভব হয় জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে। সুতরাং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি হলে ফৌজদারী মামলা ও কমে যাবে যা গোটা বিচার ব্যবস্থায় মামলার সংখ্যার উপর প্রভাব ফেলবে। ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসারের মাধ্যমে এই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যক্রম সফলভাবে কার্যকর করতে পারলে মামলা জট সহজেই কমানো সম্ভব।
আমাদের আদালতে বিচারাধীন মামলার বেশ বড় অংশই মিথ্যা বা ফলহীন মামলা। আমরা যদি এইসব মামলা গ্রহণ করার সময়ই ভালোভাবে দেখে নিতে পারি তবেই মামলা কমানো সম্ভব। আর যদি এই সময় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা যায় তবে মামলা আরো কমে যাবে।
আমার অভিমত, মামলা বিচার নিষ্পত্তি করে কমানো সম্ভব নয়, দরকার মামলাকে প্রবেশ পথে আটকানো। মামলা করা প্রত্যেকের অধিকার। আমি সেই অধিকার হতে বঞ্চিত করতে বলছিনা, তবে এই সুযোগের যেন কেউ অপব্যবহার না করতে পারে সেদিকে নজর দিতে বলছি।
বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় সিনিয়র সহকারী জজ বা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর পদমর্যাদার একজন ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার থাকেন। তিনি দেওয়ানি ও ফৌজদারী উভয় মামলা দায়েরের পূর্ব ও পরবর্তী আইনগত সহায়তার পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করেন। এই ভালো উদ্যোগের সহিত আরো কিছু যোগ করলে আমরা বৃহৎ সুফল পেতে পারি। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ বা সম পদমর্যাদার অফিসার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে বিচার ও আপীল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি।
আমার অভিমত প্রত্যেকটি জেলায় ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে দেওয়ানি ও ফৌজদারী আলাদা করে দুই জন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ বা সম পদমর্যাদার অফিসার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। একজন ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার যিনি দেওয়ানি মামলা সংক্রান্ত বিরোধ অন্যজন সেসনস লিগ্যাল এইড অফিসার যিনি ফৌজদারী মামলা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন। যারা দেওয়ানি মামলা করতে ইচ্ছুক তারা প্রথমে ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার এর নিকট সকল কাগজপত্র সহ মামলা ফাইলিং করবেন। ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার সকল কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্ট হলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবেন। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে তিনি মামলার নথিতে মামলা হিসেবে গ্রহণ করার উপযুক্ত মর্মে প্রত্যয়ন করবেন। শুধুমাত্র এই প্রত্যয়ন প্রাপ্ত মামলাটি সংশ্লিষ্ট সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ তার আদালতে বিচারের জন্য মামলা হিসেবে এন্ট্রি করে নাম্বার দিবেন। তবে বাদী তার আরজির কোনো মিথ্যা বা ভুল অংশ থাকলে তা সংশোধন করতে পারবেন। ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার যদি মনে করেন কাগজপত্র নাই তবে সেই মর্মে নোট দিয়ে বা যদি মামলা করার উপযুক্ত কারণ না থাকে তবে সেই মর্মে মামলাটি খারিজ করে নিষ্পত্তি করবেন।
ফৌজদারী মামলায় জি.আর মামলার ক্ষেত্রে যেসব মামলা গুলো আপোষযোগ্য সেক্ষেত্রে থানায় মামলা করলে অভিযোগকারীসহ এফ.আই.আর, এজাহার ও অন্যান্য কাগজপত্রসহ সেশনস লিগ্যাল এইড অফিসার এর নিকট প্রেরণ করবেন। তিনি সকল কাগজ দেখে প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্ট হলে আপোষ মিমাংসার ব্যবস্থা করবেন। যদি আপোষ মিমাংসা না হয় তবে প্রত্যয়ন পত্র প্রদান করবেন যা মূল মামলার সহিত সংযুক্ত থাকবে। সেশনস লিগ্যাল এইড অফিসার এর নিকট সন্তোষজনক না হলে তিনি মামলাটি খারিজ করে দিবেন। তবে অভিযোগকারী তার অভিযোগে কোনো মিথ্যা বা ভুল অংশ থাকলে তা সংশোধন করতে পারবেন।
ফৌজদারী মামালায় সি.আর মামলার ক্ষেত্রে প্রথমেই সেশনস লিগ্যাল এইড অফিসার এর নিকট অভিযোগ করতে হবে। যদি অভিযোগে অপরাধের সুস্পষ্ট উপাদান বিদ্যমান থাকে তবে প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্টি সাপেক্ষে আপোষযোগ্য মামলার ক্ষেত্রে আপোষ মীমাংসার ব্যবস্থা করবেন। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে বা আপোষযোগ্য না হলে তিনি মামলার নথিতে মামলা হিসেবে গ্রহণ করার উপযুক্ত মর্মে প্রত্যয়ন করবেন। শুধুমাত্র তখনই সংশ্লিষ্ট আমলী আদালত সি.আর মামলা গ্রহণ করে নাম্বার দিবেন। সেশনস লিগ্যাল এইড অফিসার এর নিকট সন্তোষজনক না হলে তিনি মামলাটি খারিজ করে দিবেন। তবে ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার বা সেশনস লিগ্যাল এইড অফিসার কোন মামলা প্রাথমিকভাবে সন্তোষজনক নয় মর্মে খারিজ করে দিলে তার বিরুদ্ধে ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড চেয়ারম্যান ও মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ এর নিকট রিভিশন করার বিধান সংযোজন করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে রিভিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত মর্মে গণ্য করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে প্রত্যেক জেলায় ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড অফিসার এর সহিত একজন করে সেসনস লিগ্যাল এইড অফিসার বৃদ্ধি করলে মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে। এইভাবে মামলার প্রবেশপথে সঠিক ও সত্য মামলা গুলো গ্রহন করে মিথ্যা ও ফলহীন মামলা গুলো আটকে দিতে পারলেই বাংলাদেশে মামলা জট কমানো সম্ভব বলে আমি মনে করি।
এসব নিতান্তই একটি ধারণামাত্র যেখানে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। এই ধারণাটি বাস্তবায়ন করতে গেলে সি.পি.সি, সি.আর.ও, সি.আর.পি.সি, সি.আর.আর.ও, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে। আর একবার এই ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ হতে মামলা জট চিরতরে নিম্নগামী করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী।
মোঃ জুয়েল রানা: জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট; কুষ্টিয়া।