চন্দন কান্তি নাথ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরে ১৮৪১ সালে জন অগাস্টোস নামের এক জুতা প্রস্তুত কারককে আদালত মদ পানের অভিযোগে সাজা দেয়। সাজাপ্রাপ্ত উক্ত আসামীকে নিজ জামিনে সাময়িক মুক্তির ব্যবস্থা করেন। তাঁর নিয়ন্ত্রণে কিছু দিনের মধ্যেই আসামীর চারিত্রিক উন্নতি দেখা দেয়। পরে বহু আসামীকে এই প্রক্রিয়াতে সংশোধন করা হয়। তখন হতে আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্য দেশে প্রবেশন বিস্তার লাভ করে।
আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে ১৯৫৫ সালে দেশে সমাজকল্যাণ কার্যক্রম শুরু হলেও ১৯৬১ সালে সমাজসেবা পরিদফতরের সৃষ্টি হয়। ষাটের দশকের সৃষ্টিকৃত পরিদফতরটিই আজ সমাজসেবা অধিদফতরে উন্নীত হয়েছে। এই দফতরের প্রবেশন কর্মকর্তাই প্রবেশন এর ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালন করেন। আর প্রবেশন এন্ড অফেন্ডার্স অডিনেন্স ১৯৬০ (সংশোধিত ১৯৬৪) এর ১৪ ধারার অধীনে ২৪ শে নভেম্বর ১৯৭১ সনে রুলস হয় এবং তা ২৫ শে নভেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। প্রবেশন -এ সাধারণত নিম্ন লিখিত শর্ত দেয়া হয় –
১. বিজ্ঞ হাকিম কর্তৃক প্রবেশন কর্মকর্তার নিকট নিজেকে সমর্পণ করবো।
২. আমার বাসস্থান ও এবং জীবিকার উপায় সম্পর্কে প্রবেশন কর্মকর্তাকে অবহিত রাখবো।
৩. সৎ ও শান্তি পূর্ণ জীবন যাপন করবো এবং সৎ উপায়ে জীবিকা অর্জনের জন্যে সচেষ্ট থাকবো।
৪. বিজ্ঞ হাকিম কর্তৃক তলব হলে উপস্থিত হয়ে সাজা ভোগ করতে বাধ্য থাকবো।
৫. সময়ে সময়ে প্রবেশন কর্মকর্তা কর্তৃক আইনানুগ মৌখিক বা লিখিত উপদেশ মেনে চলবো।
৬. আদালতের পূর্বের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ ত্যাগ করে কোথাও যাবো না।
৭. দুষ্চরিত্র লোকের সাথে মেলা মেশা করবো না।
৮. কোনো প্রকার লম্পট কাজে লিপ্ত হবো না।
৯. দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি যোগ্য কোনো অপরাধ কর্মে লিপ্ত হবো না।
১০. স্বেচ্ছায় বা কারো প্ররচনায় শান্তি ভঙ্গের কোনো কাজে লিপ্ত হবো না বা অংশগ্রহণ করবো না। ১১. কোনো প্রকার মাদক সেবন করবো না, বহন করবো না, হেফাজতে রাখবো না, বা বহনকারী, হেফাজতকারী বা মাদক সেবন করে এমন কারো সাথে মেলা মেশা করবো না।
প্রবেশনে আসামীকে কারাগারে সাজা না দিয়ে কারাবদ্ধ না রেখে বা কোন প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ প্রদান করা হয়। বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন নয়। ১৯৬০ সন হতে আইন ছিল যে, প্রথম অপরাধী হলে এবং ছোট খাট অপরাধ হলে, শিশু ও মহিলা হলে ক্ষেত্র বিশেষে শাস্তি দেয়ার আগে শাস্তির পরিবর্তে আসামীকে প্রবেশন দেয়া যায়।
একটি সমাজে সুস্থ ও সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রত্যেক শিশুর একটি মৌলিক অধিকার। কবি বলেন, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। কেউ জন্ম গত অপরাধী হয় না। কোনো সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে একজন অপরাধী হয়। উন্নত বিশ্বে প্রবেশন পদ্ধতি অপরাধ সংশোধনের একটি কার্যকরী মাধ্যম। প্রবেশন এর মাধ্যমে শাস্তি না দিয়ে মানসিক উন্নয়ন, সংশোধন ও সমাজে পুনর্বাসনের সুযোগ দেয়া হয়। কোন ব্যক্তি যখন আইনের দৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্থ হওয়ার উপক্রম হয় কিংবা ব্যক্তি যদি দোষ স্বীকার করে তখন আদালত কিছু ক্ষেত্রে প্রবেশন দেয়। প্রবেশন এন্ড অফেন্ডার্স অডিনেন্স ১৯৬০ (সংশোধিত ১৯৬৪) এর ৪ ও ৫ ধারা এর অধীনে প্রবেশন দেয়া যায়। কোন বয়সের প্রথমবার ও লঘু অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজে দোষ স্বীকার করলে আদালত দন্ড স্থগিত রেখে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিবার বা সমাজে রেখে সংশোধন ও আত্মশুদ্ধির সুযোগ প্রদান করা হয়। এ ব্যবস্থায় প্রথম ও লঘু অপরাধে আইনের সাথে সংঘর্ষে বা সংস্পর্শে আসা শিশু-কিশোরেরা বা অন্য কোন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে প্রথম ও লঘু অপরাধে দায়ে কারাগারে বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে না রেখে আদালতের নির্দেশে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে এবং শর্ত সাপেক্ষে তার পরিবার ও সামাজিক পরিবেশে রেখে কৃত অপরাধের সংশোধন ও তাকে সামাজিকভাবে একীভূত করণের সুযোগ দেয়া হয়।
দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অধ্যাদেশটির ৪ ধারা অনুযায়ী, পূর্বে দণ্ড পাননি কিংবা দুই বছরের বেশি মেয়াদে দণ্ড হবে না এমন অপরাধ ও আসামির ক্ষেত্রে প্রবেশন প্রযোজ্য হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আসামির বয়স, চরিত্র, তার পূর্ব সামাজিক ও পারিবারিক ইতিহাস, দৈহিক কিংবা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরণ বা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বিচারক শর্তসাপেক্ষে এটি প্রয়োগ করবেন।
প্রবেশন অনুযায়ী, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাগারে আবদ্ধ কক্ষে নয়, মুক্ত বাতাসে পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্য পাবেন। শর্ত হিসেবে নতুন করে অপরাধ প্রবণতায় না জড়ানো ও সদাচরণ করতে হবে। এসব শর্ত ভঙ্গ হলে তার বিরুদ্ধে দেওয়া ওই দণ্ড কার্যকর হবে এবং সাজাভোগ করতে হবে।
অধ্যাদেশ ও ২০১৯ সনের সুপ্রিম কোর্টের পরিপত্র অনুযায়ী, এ ধরনের প্রবেশন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রবেশন কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে, তার অধীনে আসামিকে ন্যস্ত করবেন। আসামি ওই কর্মকর্তার অধীনে দণ্ডের মেয়াদ পর্যন্ত তদারকিতে থাকবেন।
তবে এ অধ্যাদেশের ৫ ধারা অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হওয়ার মতো কিংবা গুরুতর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া অধ্যাদেশের ৬ ধারার বিধান অনুযায়ী, আদালত যুক্তিসংগত মনে করলে উক্ত অপরাধী কর্র্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং মামলার খরচ পরিশোধের আদেশও দিতে পারবেন।
আগেই বলা হয়েছে বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোতে দ্বিগুণের বেশি বন্দি, যাদের বেশিরভাগই মাদক মামলার আসামি। লঘুদণ্ডে অনেকেই কারাগারে গিয়ে দাগি আসামির সংস্পর্শে ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। প্রবেশনের মাধ্যমে এ প্রবণতা রোধ করা যাবে। পাশাপাশি অনুশোচনার সুযোগ পেয়ে আদালতের শর্ত মেনে মূল্যবোধ চর্চা ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে সে সুনাগরিক হওয়ার সুযোগ পাবে। এ ধরনের প্রবেশনের ফলে বিচারাঙ্গনের মামলাজট নিরসনেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হয়।
কেউ ছোটখাটো অপরাধ করল, তাকে সাজা দিয়ে দেওয়া হলো। এতে লাভ তো হলো না। কারাগারে দাগি আসামিদের সংস্পর্শে থেকে ওই ব্যক্তি আরও বড় অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। এজন্য ছোট অপরাধে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত। গুরুতর অপরাধ ছাড়া প্রথম ও লঘু অপরাধের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রবেশন খুব ইতিবাচক এবং প্রশংসনীয়। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেকে শুধরে নেওয়া ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পেয়ে পুনরায় অপরাধ করা থেকে নিবৃত্ত করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত করার কথা প্রস্তাবনাতে বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৯ (১) এ সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার কথা আছে। অনুচ্ছেদ ৩২ এ আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না – বলা আছে। ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না-বলা হয়েছে। সেজন্য প্রথম অপরাধী, ছোট খাট অপরাধী, শিশু, নারীর ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে প্রবেশন দেয়া যেতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে আমাদের দেশে কদাচিৎ প্রবেশনে দেয়া হত। অধ্যাদেশটির বয়স কয়েক দশক হলেও, বাংলাদেশে প্রয়োগ ছিল না বললেই চলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর এর ১২ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এক নির্দেশনায় অধস্তন আদালতের বিচারকদের অধ্যাদেশটি অনুসরণের নির্দেশ দেন। এরপর কুমিল্লাতে ২০১৯ সাল থেকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (প্রথম আদালত) হতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে নিয়মিত প্রবেশন দেয়া হয়।
তাছাড়া গত ৯ মার্চ মাগুরার বিচারিক হাকিম মোস্তফা পারভেজ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় তিন মাস কারাদণ্ডের পরিবর্তে তাদের ‘প্রবেশন’ দেন। এর আওতায় আসামিদের সৎ জীবনযাপনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চারটি বই পড়তে, দুটি চলচ্চিত্র দেখতে ও পাঁচটি গাছের চারা রোপণ করতে বলা হয়। রায়টির ছয় দিন আগে একই জেলার মুখ্য বিচারিক হাকিম পারিবারিক বিরোধের মামলায় ছয় মাস কারাভোগের পরিবর্তে একই অপরাধ না করা, মাদক না নেওয়াসহ সাতটি শর্তে এক যুবককে প্রবেশন দেন। আর গত ৬ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে প্রতিবেশীকে মারধরের মামলার রায়ে জেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (প্রথম আদালত) ছয় মাস কারাদণ্ড পাওয়া আসামিকে কারাগারে না পাঠিয়ে ১১টি শর্তে সংশোধনের সুযোগ হিসেবে প্রবেশন দেন।
এতে আদালতের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত আসামিরা সংশ্লিষ্ট সমাজকল্যাণ অফিসের একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে থাকবেন।প্রবেশন বা পরীক্ষাকালের সুযোগ দেওয়ায় প্রথম ও লঘু অপরাধে আসামিদের দণ্ড হলেও, কারাগারে যেতে হয়নি। কারাভোগের পরিবর্তে বই পড়া, গাছ লাগানো, সদাচরণ করাসহ নানা শর্তে আইনিভাবে সংশোধনের সুযোগ পেয়েছে।
আইনের ছাত্র হিসেবে প্রবেশন এর কথা শুনেছিলাম। আইনজীবী হিসেবে ও শুনেছি। প্রয়োগ দেখি নাই। কিন্তু ২০১৯ সনে সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক সার্কুলার হওয়ার পর বিস্তারিত পড়ার পর প্রয়োগ করা শুরু হলে দেখা গেলো অনেক আইনজীবীর জন্য বিষয়টি নতুন। আবার অনেক বিচারক প্রয়োগও করছে না। বিচার অঙ্গনে অধিকাংশই প্রবেশন বিষয়টি কিভাবে প্রয়োগ করবে বা হবে তাতে অভিজ্ঞ নন। সে কারণে শুরুতে ভুল হতে পারে। তবে নিয়মিত প্রয়োগ হলে ভুলের পরিমাণ কমে যাবে।
আমাদের ভাবতে হবে সাজা দেওয়ার চেয়ে সাজা হবে সমাজে এই বিশ্বাস জরুরি। সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে হাজার হাজার অপরাধী। কারাগারগুলো দ্বিগুণ তিন গুণ কোথাও চার গুণ অপরাধী নিয়ে ভারাক্রান্ত। অবশ্যই সেক্ষেত্রে সবাই চাইবে অভ্যাসগত অপরাধী (habitual offender) যারা তারা হাজতে থাকবে। ভুল করে কেউ অপরাধ করলে সে ভুল স্বীকার, সংশোধন এবং অপরাধের অনুশোচনা থেকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসবে। আর সে কারণে প্রবেশন। একই কারণে দেশের আদালতগুলোতে প্রবেশনের চর্চা ব্যাপক হারে হওয়া উচিত।
চন্দন কান্তি নাথ: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।