দিদার আহমেদ:
শহরের ব্যস্ত সড়ক কিংবা হোক কোন মহাসড়ক, আর যদি রাজধানী হয় তবে তো কথাই নেই। পতাকাবাহী গাড়ী বা পতাকার স্ট্যান্ডযুক্ত গাড়ীর দ্রুত গতিতে হাকিয়ে যাওয়া নিত্যদিনের ব্যাপার। তাছাড়া মোটরসাইকেলের সাইরেন বা ইমারজেন্সি লাইটযুক্ত গাড়ীতো আছেই। এই গাড়ীগুলো দেখেই যে কারোও বুঝতে দেরী হয়না যে গাড়ীটি সরকারী। গাড়ীতে আছেন গুতুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিআইপি) বা সরকারের উচ্চ পদস্থ কোন কর্মকর্তা। যেই হোক না কেন, ক্ষমতাধর তো নিশ্চয়ই? নতুবা এমন দাপুটে বিচরন কে-ই বা করতে সক্ষম? অতি গুতুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) বেলায় ভিন্ন। উনাদের প্রটোকল আর পূর্বসতর্কতায় নিয়োজিত বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় আগে থেকেই বুঝা যায় ভিভিআইপির আগমন। ভিভিআইপিরা নিঃসন্দেহে এসবের সর্বাবস্থায় যোগ্য এবং সম্মানিত।
কিন্তু ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড বা ফ্লাগ কি যে কোনো গাড়ীতে লাগানো যায় বা যে কেঊ ইচ্ছা করলেই এ স্ট্যান্ড বা পতাকাযুক্ত স্ট্যান্ড ব্যবহার করতে পারেন? ফ্ল্যাগ ব্যবহার করার অধিকার আছে কার? আইন কি বলে? এমন অনেক অজানা প্রশ্ন উঁকি দেয় অনেকের মনে। অনেকে স্বপ্নও দেখেন একদিন আমিও হাঁকাবো ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড বা ফ্লাগযুক্ত গাড়ি। কিন্তু ইদানিংকালে দেখা যায়, এই বেশকিছু প্রাইভেট কার ও জিপ গাড়ীর বাঁ পাশে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগানো। সরকারী গাড়ীর বাইরে একই ব্যক্তি বা তার পরিবার কিংবা যে কেউ কি ব্যক্তিগত গাড়ীতেও তা ব্যবহার করার ক্ষমতা রয়েছে? না থাকলেও এমন অপব্যবহার সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। তবে আসুন জেনে নেই আইন কি বলে।
প্রাইভেট কার ও জিপ গাড়ীর বাঁ পাশে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগানো এসব গাড়ীর কোনো কোনোটিতে আবার জাতীয় পতাকাও থাকে যা সাদা বা কালো রঙের কাভারে আবৃত। এর সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়না অনেক সময় প্রশাসনের কাছ থেকে। এই ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড বা ফ্লাগযুক্ত গাড়ী দেখে রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ থেকে জনগণ সবাই ভিআইপি ও ক্ষমতাধর ভেবে স্যালুট আর অগ্রাধিকার দেন। এর ফলে সঠিক ব্যক্তি ব্যতীত অন্য যারা এর অপব্যবহার করে তারা ট্রাফিক আইন ভঙ্গসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কাজও করে থাকে।
এই গাড়ীগুলো বেশ দাপুট দেখিয়ে নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলাচল করে। তারা যে দিক দিয়েই যান বেশ দাপটের সাথে হাকিয়ে চলেন শখের গাড়ীটি। কোন ক্ষেত্রে তা সরকারি গাড়ী, কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ী। তবে সরকারী গাড়ী যার নামে বরাদ্দ কেবল তার ব্যবহারের জন্য এমনকি সরকারি কাজের জন্য। তা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য নয় বা অন্য কারও ব্যবহারের জন্য নয়। আবার নিজের কেনা ব্যক্তিগত গাড়ীতে বাঁ পাশে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগানো বা জাতীয় পতাকা সাদা বা কালো রঙের কাভারে আবৃত রাখা কি কেবল ইচ্ছাধীন নাকি তা ব্যবহারের আইনের কিছু গণ্ডিও থাকে ?
একটি জাতীয় পতাকা বিশ্বের সব স্বাধীন দেশেরই থাকে। পতাকা উত্তোলন বা লাগানোর জন্য একটি নির্দিস্ট দণ্ড বা স্ট্যান্ডও রাখা হয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ। জাতীয় পতাকা ব্যবহারের আইনগত নিয়মাবলি এদেশেও রয়েছে। Bangladesh Flag Rules 1972 বর্তমানে যা Bangladesh National Anthem, Flag and Emblem (Amendment) Act 2010 নামে পরিচিত। পতাকা সংক্রান্ত সমূদয় বিষয় নিয়ে বিশদ বর্ননা করে। ১৯৭২ সালে প্রনয়নের পর মহান জাতীয় সংসদ এর অনুমোদন করে এবং সবশেষ ২০১০ সালে সংশোধিত হয়। একটি কথা প্রায় সবারই জানা, আমাদের বিজয় দিবস ১৬ ই ডিসেম্বরে যে কেউই জাতীয় পতাকা গাড়ীতে ব্যবহার করতে পারেন। তবে গাড়ীতে ব্যবহারের জন্য পতাকার নির্দিস্ট মাপ অনুসরন করা আবশ্যক।
Bangladesh National Anthem, Flag and Emblem (Amendment) Act 2010 দ্বারা প্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ কেবল তার গাড়ীতে নিজে থাকাকালে পতাকাদণ্ড হতে জাতীয় পতাকা উন্মুক্ত করতে হয় এবং গাড়ী থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে পতাকা গুটিয়ে ওপরের কভার আবৃত করতে হয়। কেবলমাত্র প্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণই থাকাকালীন তা ব্যবহৃত হতে হবে। এই গাড়ীতে অন্য কেউ থাকলে তা ব্যবহৃত হবেনা।
গাড়ীতে কেবল ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগানোর জন্য একটা অলিখিত বিধান আছে। সরকারি পরিবহন পুলের সুনির্দিষ্ট কিছু গাড়ীতে পতাকা ব্যবহারের জন্য স্ট্যান্ড লাগানো যায়। এই অধিক্ষেত্রের বাইরে জেলা শহরগুলোয় ডিসি পুলের একাধিক গাড়ীতেও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগানো হয়। যার কারণ হল ঐ জেলায় একই দিনে একাধিক ভিআইপি উপস্থিত হলে তখন ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড-সজ্জিত এসব গাড়ী ভিআইপিগণ ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু দেখা যায় বাস্তবে এসবের বাইরেও প্রচুর গাড়ীতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের সচিবালয়ের কর্মকর্তারা যারা গাড়ী বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের প্রায় সব গাড়ীতেই ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড রয়েছে। পুলিশের ও অন্যান্য বাহিনীর কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়ী, বিভিন্ন সংস্থার, প্রকল্পের ও দাতা সংস্থার অনেক গাড়ীতেও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড পরিলক্ষিত। অনেক সংসদ সদস্য তাদের পরিবারের ব্যক্তিগত গাড়ী এমনকি থানা, উপজেলা পর্যায়েও এমন গাড়ীর বিচরন চোখে পড়ার মতো ।
মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার জন্য বরাদ্ধকৃত গাড়ীতে পতাকা স্ট্যান্ড এবং সরকারের স্টিকার ব্যবহারের অধিকার আছে। পরবর্তীতে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচের কর্মকর্তা স্টিকার ব্যবহারের সুযোগ পেলেও অধিকারী হননি পতাকা স্ট্যান্ড ব্যবহারের। জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) পদমর্যাদার ক্ষেত্রে উপ-সচিব পদমর্যাদার হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা ঐ জেলায় সফরকালে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে’ তাদের গাড়ীতে পতাকা স্ট্যান্ড ব্যবহার করতে পারবেন।
সাম্প্রতিককালে অতিশয় ক্ষমতাধর কতিপয় ব্যক্তি কোন যোগ্যতা ছাড়াই তাদের ব্যক্তিগত গাড়ীতে ব্যবহার করছেন পতাকা স্ট্যান্ড এমনটিও শোনা যায়। তাছাড়া কিছু ভুয়া ও অতিউৎসাহী ব্যক্তি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই ব্যবহার করছেন পতাকা স্ট্যান্ড। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত সমালোচিত দুর্নীতি ও প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতারকৃত একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তির একটি গাড়ীতেও পাওয়া গেছে পতাকা স্ট্যান্ড এর ব্যবহার। যদিও তার কোন যোগ্যতা নেই পতাকা স্ট্যান্ড ব্যবহারের ।
গাড়ীতে পতাকা ব্যবহারের বিষয়ে বর্নিত আইনের ৬ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, ইচ্ছা করলেই যে কেউ তার গাড়ীতে পতাকা ব্যবহার করতে পারেন না।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সড়কপথে গাড়ীতে, জলপথে জলযানে এবং আকাশপথে বিমানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকারপ্রাপ্ত। আকাশপথে তাহাদের ব্যতীত অন্য কারও বেলায় এ অধিকার নেই।
সকল পূর্ণমন্ত্রী এবং তাদের সমপদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা, জাতীয় সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীর সমমর্যাদায় আসীন ব্যক্তি এবং বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন/কনস্যুলার মিশনের প্রধানগণ সড়কপথে গাড়ীতে ও জলপথে জলযানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকারপ্রাপ্ত।
ব্যতিক্রম শুধু প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সমমর্যাদায় আসীন ব্যক্তিদের বেলায়। রাজধানী ঢাকা শহরে গাড়ীতে (কার/জিপ) তারা জাতীয় পতাকা ব্যবহারের অধিকারপ্রাপ্ত নন। তবে রাজধানীর বাইরে সফরে গেলে বা অবস্থান হলে তারা গাড়ীতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারেন। আবার ২০১৬ সালে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় নীতিগত সম্মতির পর রাজধানীর ভিতরেও প্রতিমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় আসীন ব্যক্তিরা গাড়ীতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারার বিষয়টি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। উপরে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিদের গাড়ীতেই কেবল পতাকার জন্য দন্ড লাগানো থাকবে।
কোন সিটি মেয়র যদি সরকার দ্বারা প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় আসীন হন তবে তিনিও গাড়ীতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারেন। এমনকি প্রতিমন্ত্রীর অনুরূপ সকল সুযোগ সুবিধা লাভ করবেন। অর্থাৎ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সমমর্যাদায় আসীন ব্যক্তিগন গাড়ীতে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারেন। এযাবৎকালে ঢাকা থেকে নিয়ে দেশের প্রায় সকল বিভাগ, জেলা এমনকি উপজেলা ও পৌর শহরে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রাইভেট গাড়ীতেও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড এর অবাধ ব্যবহার দেখা যায়। পৌরসভার মেয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির গাড়ীতেও এ স্ট্যান্ড লাগানো রয়েছে। কিন্তু স্ট্যান্ড ব্যবহারে তারা কোনোভাবেই অনুমোদনপ্রাপ্ত নন।
অবৈধ ও ভুয়া স্টিকার ও পতাকা এবং স্ট্যান্ড ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। এদের অবাধ বিচরন এখনই থামানো প্রয়োজন। অনেক সময় প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে এরা স্টিকার, পতাকা এবং স্ট্যান্ড ব্যবহারকার করে নানা সুবিধা নিয়ে অনেক বড় অপরাধ ঘটায়। যার ফলে দুর্নাম হয় শুধু ব্যক্তি বা সরকারের নয় বরং পতাকার তথা দেশের। পতাকাবাহী গাড়ী বা স্ট্যান্ডযুক্ত গাড়ী কেবল যারা ব্যবহারের অধিকার রাখেন তাদের জন্যই হোক সংরক্ষিত। এই গাড়ীগুলোর ব্যবহারকারীগণ সম্মান পাওয়ার যোগ্য। সম্মানির সম্মান থাকুক চির অটুট।
২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে গাড়িতে পতাকা ও স্টিকার লাগানো সংক্রান্ত একটা গাইডলাইন প্রস্তুতের বিষয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। আশা রাখি এ বিষয়ে একটি সুন্দর নির্দেশনা আমরা পাবো। প্রতারনাকারী, অবৈধ ও ভুয়া ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে নেয়া হোক কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। পতাকার সম্মান রক্ষা করা হোক।
দিদার আহমেদ: আইনজীবী; জজ কোর্ট, সিলেট।