সিরাজ প্রামাণিক:
আইনজীবী ও বিচারকরা হচ্ছে একটি পাখির দুটি পাখার মতো। বাম হাত ও ডান হাতের মতো। তাদের পরস্পরের প্রতি আস্থার সম্পর্ক বিচার ব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি করে। পৃথিবীর সর্বত্রই আইন পেশা একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে স্বীকৃত। একে ‘অভিজাত পেশা’ বলা হয়। এই আইন পেশার মানুষকে ‘সমাজ কৌশলী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, সমাজের নানা বিষয়ে অসংগতি ও বৈষম্য দূর করতে একজন আইন পেশাজীবীকে রাখতে হয় অগ্রগামী ভূমিকা। অতি সম্মানের নিদর্শন স্বরূপ একমাত্র ‘অ্যাডভোকেট’ ও ‘বিচারক’ শব্দের পূর্বে ‘লার্নেড’ বা ‘বিজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
লর্ড ম্যাকমিলানের মতে “অন্য কোন পেশা মানবজীবনকে এত স্পর্শ করে না।” একজন অ্যাডভোকেট তার অবস্থানের প্রেক্ষিতে আদালতে অফিসার এবং বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ও তার মক্কেলকে পেশাগত উপদেশ প্রদানের জন্য জনসাধারণের ওপর তার প্রভাব অত্যন্ত প্রখর। আর এ প্রভাবের কারণেই ভালো হোক অথবা মন্দ হোক যে কোন কাজই সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির চেয়ে একজন আইনজীবীর কর্মকাণ্ড, দৃষ্টান্ত ও আর্দশ সমাজের ওপর অনেক বেশি কার্যকর।
অ্যাডভোকেটগণ আদালতে বিনীতভাবে সততার সাথে তার মক্কেলের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিচারককে সরাসরি সহায়তা প্রদান করেন বিধায় অ্যাডভোকেটগণ আইন আদালতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
অসংখ্য মৌলিক আইন গ্রন্থের প্রণেতা মরহুম গাজী শামসুর রহমান বলেছিলেন, কোন মানুষ ভ্রমের ঊর্ধ্বে নয়, সম্ভবত বিচারকও নয়। বিচারকের ভ্রম ধরিয়ে দিতে পারে শুধু সেই ব্যক্তি যিনি জ্ঞানে, গুণে, মর্যাদায় এবং অবস্থানে বিচারকের সমকক্ষ। সেই ব্যক্তিই অ্যাডভোকেট।
আদালতের ক্ষমতা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে বিচারকগণ যেমন কতিপয় বিশেষাধিকার ভোগ করেন, আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্যগণও তেমনি কতিপয় বিশেষ অধিকার ভোগ করার অধিকারী।
প্রচলিত আইনে এবং বিভিন্ন নজিরসমূহ থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটগণ আদালত অঙ্গনে যেসব বিশেষাধিকার ভোগ করেন তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলোঃ
বিচারক কর্তৃক অ্যাডভোকেট এর অবমাননা আদালত অবমাননার শামিল। আইন অ্যাডভোকেট এর সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে কতটুকু সচেষ্ট তা নিম্নের নজিরসমূহ থেকে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করা যাবে।
একজন অ্যাডভোকেট যখন তার মক্কেলের মামলা পরিচালনা করেন, তখন যদি আদালত অর্থাৎ বিচারক তার আচরণ নিয়ে মন্তব্য করেন, তবে আদালত অবমাননার অপরাধ হতে পারে। (৩৫সি, ডব্লিউ, এন ১৮৯)
যদি আদালত কোন মোকদ্দমা শুনানিকালে পুলিশ গার্ড ডাকেন এবং কোন যথার্থতা ছাড়াই আইনজীবীকে আদালত কক্ষ হতে বের করে দেন তবে তা আদালত অবমাননার শামিল। (Prag Das Advocate V.Sir P.C. Agrwal’1975 ALI .L.J.41; 1975 Cr. L. J. 659)
উচ্চ আদালতের স্থগিত আদেশের বিষয়ে অ্যাডভোকেট কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র কোন আদালতে দায়ের হলে সে আদালতের উচিত উক্ত প্রত্যয়নপত্র অনুযায়ী মোকদ্দমা স্থগিত করা। কারণ অ্যাডভোকেট আদালতের একজন অফিসার এবং ঐ প্রত্যয়নপত্রের দায়-দায়িত্ব তিনি বহন করেন। অ্যাডভোকেটের প্রত্যয়নপত্রে প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা নিরূপণের চেষ্টা না করে তাকে অবিশ্বাস বা নাকচ করে দেয়া আদালত অবমাননার অপরাধ হবে|(Harikishan Sing V. Chhotan Mahton AIR 1951 Pat. 490; 1951 (Vol. 52) Cr. LJ, 638]
অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নাম রটানো, অপমান করা যাবে না
অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে তার মোকদ্দমা পরিচালনার ব্যাপারে মিথ্যা দুর্নাম রটানো যা তাকে এ মোকদ্দমা পরবর্তী পরিচালনা করতে বিব্রত করে তা আদালত অবমাননা হিসেবে চিহ্নিত হবে। (Anantalal Singha V. Alfred Henry Watson (1930) 58 Cal. 884)
বিচারাধীন মামলায় আইনজীবী যাতে তার দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তজ্জন্যে অ্যাডভোকেটকে অপমান করা আদালত অবমাননা। (Thirumalaippa V. Kumaraswami, AIR 1956, Mad. 621 (1956) I. L.R. Mad. 1239)
অ্যাডভোকেটগণ যে সকল বিচার বিভাগীয় বিশেষ সুবিধা ভোগ করার অধিকারী
মামলা চলাকালীন সময় অ্যাডভোকেটগণ বিবৃতি বিশেষ সুবিধার অন্তর্গত। তার এ অধিকার নিম্নবর্ণিত নীতিমালা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১। কোন আইনজীবী যখন কোন মামলা পরিচালনা করেন তখন তিনি নিরংকুশ বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন।
২। যদি কোন অ্যাডভোকেট বিশ্বস্ততার সাথে মামলা চলাকালে মানহানিকর বিবৃতি দেন তার জন্য তিনি দায়ী হবেন না।
৩। তার বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা যাবে না।
৪। মামলা চলাকালে অ্যাডভোকেট যদি বাদীকে মিথ্যাবাদী ও ধাপ্পাবাজ বলেন তাহলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
৫। যদি কোন অ্যাডভোকেট মামলা চলাকালে সাক্ষীকে বদমাশ বা লম্পট বলে, তাহলেও তার বিবৃতিটিকে বিশেষ সুবিধার অধীন বলে ধরে নেয়া হবে।
অতএব কোন অ্যাডভোকেটকে তার আইনবিষয়ক কাজে বা মামলা চলাকালে প্রাসঙ্গিকভাবে মানহানিজনক বিবৃতি প্রদানের জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। তিনি যাই বলুন না কেন, তা প্রকৃত সত্য নাও হতে পারে বা অতিরঞ্জন হতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সুবিধা ভোগ করবেন।
আদালতে অ্যাডভোকেটের অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এক্সপাঞ্জ (expunge) করতে হবে
বিচারাধীন মামলায় একজন আইনজীবী তার মক্কেলের পক্ষে আইনের যুক্তিতর্ক পেশ করার প্রাক্কালে সম্পূর্ণভাবে আইনের স্বাধীনতা পেয়ে থাকেন এবং এজন্যে ঐ সময় যদি সংশ্লিষ্ট মামলাটির “merit” বা গুণাগুণের সাথে সম্পর্কহীন এমন কোন মন্তব্য করা হয় যা ঐ মামলা সংক্রান্ত নহে বরং সম্পূণরুপে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর পেশাগত চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কিত, তাহলে ঐ জাতীয় মন্তব্য আদালত প্রদত্ত রায়ের অংশ হিসেবে রেকর্ডে রাখা যাবে না এবং তা রেকর্ড হতে মুছে ফেলতে হবে। ৩১ ডি, এল,আর (এ.ডি) ১৬৩ (১৯৭৯)।
সিরাজ প্রামাণিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com