কাজী ফয়েজুর রহমান: অধস্তন আদালতে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল। ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সনদ প্রত্যাশীদের জন্য এই ঘোষণা ঈদের আগেই আরেক ঈদ হবার কথা ছিল, কিন্তু দুই কারণে তা হয়নি। প্রথমত, ঘোষিত তারিখে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, লিখিত পরীক্ষা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বার কাউন্সিলের স্ববিরোধী বক্তব্য বিপাকে ফেলে দিয়েছে সাড়ে তিন হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবীর ভবিষ্যৎ।
লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বার কাউন্সিলের আজকের বিজ্ঞপ্তিটি একটু দেখে নেয়া যাক। তাহলে উপরোক্ত কারণ দুটির যথার্থতা স্পষ্ট হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেটশিপ তালিকাভুক্তির এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ২২ জুলাই এক পত্রে জানিয়েছে, আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর (শনিবার) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ খোলা সাপেক্ষে কলা অনুষদে পরীক্ষা গ্রহণে সম্মত রয়েছে। সেই মতে পরীক্ষা হল প্রাপ্তি সাপেক্ষে ২৬ সেপ্টেম্বর এনরোলমেন্ট লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ওই পরীক্ষার পরীক্ষার্থীরা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বার কাউন্সিল এনরোলমেন্ট নৈর্ব্যক্তিক (এমসিকিউ) পরীক্ষার জন্য ইস্যুকৃত প্রবেশপত্র দিয়ে আসন্ন লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। রোল নম্বর অনুযায়ী পরীক্ষা- কেন্দ্রের নামসহ বিস্তারিত শিডিউল এবং অন্যান্য নির্দেশনা পরে ঘোষণা করা হবে। যা বার কাউন্সিলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।’
বিজ্ঞপ্তির এই অংশে ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ খোলা সাপেক্ষে’ শব্দগুলোই ঘোষিত সময়ে পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনাকে খানিকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। কারণ খুব দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
নোটিশে আরও বলা হয়, ‘এনরোলমেন্ট এমসিকিউ পরীক্ষায় একবার উত্তীর্ণ হলে পরপর দুবার লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করে জারিকৃত গেজেটে (২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর) প্রকাশিত রুলস সংশোধন করে ‘ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে’ মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এ সংশোধনীটি করা হয় ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর। ফলে ওই তারিখের পূর্বে যারা একবার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে অনুত্তীর্ণ হয়েছেন তারা দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। যদি সরকার ওই সংশোধনীটির প্রয়োগ ভূতাপেক্ষাভাবে প্রয়োগ করার উল্লেখ করে কোনো সংশোধনী প্রদান করে কেবল সে ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বরের পূর্বে যারা একবার লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন তারাও দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষা দিতে পারবেন।’
নোটিশের এই ভাগই ২০১৭ সালে এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশদের ভবিষ্যৎ হন্তারক। ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বরের পূর্বে যারা একবার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে অনুত্তীর্ণ হয়েছেন তারা দ্বিতীয়বার লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। সর্বশেষ লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর। এর মানে হচ্ছে আসন্ন লিখিত পরীক্ষায় ২০১৭ সালে এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষানবিশদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোকাররামুছ সাকলান ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বার কাউন্সিলের যে নোটিশ দিয়েছে তা গোলমেলে। নোটিশে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বরের আগে যারা এমসিকিউ (MCQ) পরীক্ষায় পাশ করেছে তারা আসন্ন ২৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য লিখিত পরীক্ষা দিতে পারবেন না বলে আইনে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা সঠিক নয়।
এই আইনজীবী বলেন, ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৩৬৭ নং এস.আর.ও ‘অবিলম্বে কার্যকর হইবে’ লিখা থাকলেও তা বিধি ৬০(এ) এর কোন অংশ না। আজকের যে নোটিশটি দেওয়া হয়েছে তা আইনের ভুল ব্যাখ্যার কারনে হয়েছে। আবারও বলছি ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বরের সংশোধনী সাধারণ প্রকৃতির। এর ফলে নতুন নিয়ম তৈরি হয়েছে। এর প্রয়োগ ভূতাপেক্ষ (Retrospective) না ভবিষ্যাপেক্ষ (Prospective) তা নির্ভর করবে যদি তা বিধিতেই লিখা থাকত। যেহেতু সংশোধিত বিধির মাঝে এমন কিছু লিখা নাই তাই এটা সাধারণভাবে প্রয়োগ হবে।
এদিকে ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে বার কাউন্সিল জানিয়েছিল, ‘বার কাউন্সিল সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে সকল পরিক্ষার্থী ২০১৭ সালের অনুষ্ঠিত আইনজীবী তালিকাভুক্তির এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে এবং লিখিত পরীক্ষায় অনুউত্তীর্ণ হয়েছে তাদের আসন্ন এমসিকিউ পরীক্ষা দিতে হবে না। তারা শুধুমাত্র আসন্ন লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট সাকলান জানান, ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সার্কুলারের মাধ্যমে ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ এর পূর্বে যারা এমসিকিউ (MCQ) পাশ করেছে তাদের পরবর্তিতে এমসিকিউ (MCQ) না দিতে বলায় সংশোধিত বিধি ৬০এ(৩) এর সাধারণ প্রয়োগ (General Application) হয়ে গেছে। এখানে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বরের আগে এমসিকিউ (MCQ) পাস এবং পরে একবার লিখিততে ফেল করাদের এবসার্ড ইনকনভেনিয়ান্স (Absurd Inconvenience) এ ফেলে দেবার সুযোগ এনরোলমেন্ট কমিটির নাই।
বার কাউন্সিলের এমন আশ্চর্যজনক স্ববিরোধীতা নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত ও হতাশাজনক বলে অভিযোগ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের। ভারতীয় উপমহাদেশের শাসনভার নিজেদের কাছে রাখতে বৃটিশরা যেমন ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’ অনুসরণ করেছে, সম্ভবত শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আন্দোলনে বার কাউন্সিল ‘বিরক্ত’ হয়ে সেই পথই বেছে নিয়েছে। পরীক্ষা দ্রুত নেওয়ার কোন পরিকল্পনা বার কাউন্সিলের নেই। যদি ঘোষিত তারিখে পরীক্ষা নেয়ার স্বদিচ্ছা থাকতো তবে এমন বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তির অবতারণা হত না। এই বিজ্ঞপ্তির ফলে ২০২০ সালে এমসিকিউ উত্তীর্ণরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ঘরে ফিরে যাবে, আর ২০১৭ সালের এমসিকিউ উত্তীর্ণরা যাবেন আদালতে। রিট হবে, রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিতের আবেদনও হয়তো করা হবে। এতে করে পরীক্ষা ঘোষিত সময়ে হবে তো না-ই বরং একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনকারীরা হবে দ্বিধাবিভক্ত। এতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।
আইনজীবী হয়ে যারা ভবিষ্যতে বিচারপ্রার্থীর ন্যায় বিচার নিশ্চিতের জন্য আদালতকে সহযোগিতা করবেন তারাই যদি পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হন তবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে কি? শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা বিশ্বাস করেন বার কাউন্সিলের এই নোটিশ অনিচ্ছাকৃত ভুল। অনতিবিলম্বে বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করে উদ্ভূত সমস্যার আশু যথোপযুক্ত সমাধান তারা দেবেন। যোগ্য অভিভাবকের দায়িত্বপালন করবেন আইনজীবীদের অভিভাবক সংস্থাটি।
বার্তা সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম