সিরাজ প্রামানিক:
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো কারণেই তালাক হতেই পারে কিংবা দুজনে পৃথকও বসবাস করতে পারে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী যদি চান তাঁরা পুনরায় সংসার করবেন, তাহলে আইনে কোন বাঁধা নেই। তবে কিছু আইন মেনে আবার ভাঙা সংসার জোড়া লাগাতে হয়। এবার জেনে নেয়া যাক এ বিষয়ে আইন কি বলে।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে যে, তালাক যেভাবেই হোক না কেন, তালাক দিতে চাইলে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর অপর পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন সে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি কর্পোরেশন মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সাথে তালাক গ্রহীতাকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে।
চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না। কারন নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। তবে সমঝোতার ৯০ দিন সময় চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে শুরু হয়। তালাক দেয়া বা নোটিশ লেখার তারিখ থেকে শুরু হয় না। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)।
সালিশি পরিষদ ৯০ দিন সময় পেয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি করে মোট তিনটি নোটিশ দেবে। এ সময় যদি স্বামী-স্ত্রী মনে করেন তাঁদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির কারণে তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে তাঁরা সমঝোতা করে তালাক প্রত্যাহার করে নিয়ে পুনরায় সংসার করতে পারেন। এ জন্য নতুন করে বিয়ের প্রয়োজন হবে না। তবে নি¤œবর্ণিত কার্যগুলো করে রাখা ভাল। নতুবা পরবর্তীতে সামাজিক, পারিবারিক ও আইনগত নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
১. সালিশী পরিষদকে তালাক প্রত্যাহারের ঘোষনাটি অবগত করতে হবে এবং তাতে রিসিভ ও সিল স্বাক্ষর করিয়ে নিতে হবে।
২. এই রিসিভ কপি উভয় পক্ষের নিকট সংরক্ষণ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে স্বামী বা স্ত্রী যাতে প্রত্যাহারের বিষয়টি অস্বীকার করতে না পারে।
৩. আবার তালাক প্রত্যাহারের ঘোষনাটি অবগত হওয়ার পর সালিশী পরিষদ তালাক প্রত্যাহারের আদেশ জারী করতে পারেন। সেক্ষেত্রে উক্ত আদেশের সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করে রাখা যেতে পারে।
কিন্তু তালাকের নোটিশ পাঠানোর পর যদি ৯০ দিন পার হয়ে যায় অর্থাৎ তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্বামী বা স্ত্রী যদি অন্যত্র বিয়ে না করেন তাহলে তাঁরা পুনরায় নতুন করে বিয়ে করে নিতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, একই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয়বারের মতো তালাক কার্যকর হলে তাঁদের পুনরায় বিয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইন ১৯৬১-এর ৭ (৬) ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্ট বলা আছে। স্ত্রী যদি তালাকের নোটিশ পাঠানোর সময় গর্ভবতী থাকেন, তাহলে সন্তান প্রসবের আগে যেকোনো সময় তালাক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। আবার সংসার করতে পারেন। সন্তান জন্মদানের পর যদি সংসার করতে চান, তাহলে পুনরায় বিয়ে করতে হবে।
নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী অন্য কারও সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে উক্ত বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে। (সৈয়দ আলী নেওয়াজ বনাম কর্ণেল মোঃ ইউসুফ, ১৫ ডি.এল.আর, আপিল বিভাগ, পৃষ্ঠা-৯। কারণ তালাক সম্পূর্ণ কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগণ আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যায়। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রী কে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।
কেউ যদি আলাদা বসবাস করেন তাহলে তাঁরা নতুন করে একত্রে থাকার ঘোষণা দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই। আবার স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো কারণে সংসার করতে না চান, তাহলে দাম্পত্য অধিকার দাবি করে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ পারিবারিক আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। সেই সময় আদালতে এসেও স্বামী-স্ত্রী দুজনে আপোষ-মীমাংসা করে পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্ক শুরু করতে পারেন। যদি ভাঙা সংসার নতুনভাবে জোড়া লাগে, তাহলে তাঁরা আগের মতোই স্বামী-স্ত্রী পরিচয় পাবেন। তাঁদের আগে যেমন অধিকার ছিল পরস্পরের ওপর, তেমনই অধিকার সংসার জোড়া লাগার পরও থাকবে। সন্তান, ভরণপোষণ দেনমোহর সবকিছুই স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে থাকবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com