বঙ্গবন্ধুর শাসনভার গ্রহণের সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীনতার সনদ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তা হলো ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত স্বপ্ন ছিল একটি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। সেই লক্ষ্যে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারির পর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথমে মুজিব নগর সরকারের ঘোষিত রাষ্ট্রপতির পদে শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন এবং পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবেই ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামল বা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল।
মুক্তিযুদ্ধে সদ্যস্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে পায় নতুন সংবিধান। ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রদত্ত অধিকারসমূহ ছিল মর্যাদা, সুযোগ লাভ ও ধর্মপালনের অধিকারের সমতা; আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের সমতা; ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও বাঁচার অধিকার সুরক্ষা; অযৌক্তিক গ্রেফতার বা আটক, বিচার বা দন্ড থেকে সুরক্ষা; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সেই সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার প্রতিফলন।
১৫ আগস্ট। ইতিহাসের বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় একটি দিন। ১৯৭৫ সালের সেই দিনে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সদস্য। ১৫ আগস্ট নৃশংস হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের, কর্নেল জামিল, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ রিন্টু সহ অনেকে। এ হামলা থেকে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এ সময় স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে সন্তানসহ অবস্থান করেন শেখ হাসিনা। সেখানে বড় বোনের সঙ্গে শেখ রেহানাও ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলে ঐ শাসনামলের অবসান ঘটে। সুতরাং, বলা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল মাত্র ৩ বৎসর ৭ মাস ৩ দিন স্থায়ী ছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। এই অধ্যাদেশের মূল কথা হলো, ১৫ আগস্ট ভোরে আইন পরিপন্থী যাই ঘটুক না কেন- এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না এবং রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করলেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা-অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত চার বছরের মধ্যে সামরিক আইনের আওতায় সবকিছু পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়। এভাবেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে শুরু হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বা ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। পরবর্তীতে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা করেন। অতঃপর, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫১ কার্যদিবসে ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৯ জন আসামির মধ্যে ১৫ জনকে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে রায় কার্যকরের আদেশ দেন।
আইনানুযায়ী মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত করার জন্য মামলাটি হাইকোর্ট বিভাগে যায় ‘ডেথ রেফারেন্স’ আকারে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ জন আসামি আপিলও করে। আসামিদের আপিল এবং ডেথ রেফারেন্সগুলো হাইকোর্টে একত্রে শুনানি করা হয়। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৯৮ সালে নিম্ন আদালতের রায় হলেও হাইকোর্টের একাধিক বিচারপতি মামলাটি শুনানি করতে বিব্রতবোধ করার কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। অবশেষে ২০০০ সালের ২৮ জুন বিচারপতি মোঃ রুহুল আমীন এবং এবিএম খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ দ্বিধাবিভক্ত রায় ঘোষণা করেন। বিচারপতি খায়রুল হক নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখে ১৫ জনকেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে বিচারপতি মোঃ রুহুল আমীন ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং ৫ জনকে খালাস দেন। ফয়সালার জন্য বিচারপতি ফজলুল করিমের সমন্বয়ে তৃতীয় একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়। ৩০ এপ্রিল ২০০১ এই বেঞ্চ ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং ৩ জনকে খালাস প্রদানের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করে। পরে মহিউদ্দিনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আনার পর সেও জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। সবগুলো আপিল একসাথে শুনানি করার পর ২৪ আগস্ট ২০০৭ পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল মঞ্জুর হয় এবং নিয়মিত আপিল দায়েরের আদেশ দেয়া হয়।
লিভ গৃহীত হওয়ার পর আপিল বিভাগের মামলাটি প্রায় সাত বছর শুনানিহীন থাকে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পরিবর্তিত হয়ে আওয়ামী মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি শুনানি করার উদ্যোগ নেয়। প্রধান বিচারপতি মামলাটির শুনানির জন্য ৭ আগস্ট ২০০৯ বিচারপতি মোঃ তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মোঃ আব্দুল আজিজ, বিচারপতি বিজন কুমার দাস, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ২৯ দিনের শুনানি শেষে ১৯ নভেম্বর এই বেঞ্চ মামলার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন। অবশেষে আপিল বিভাগের রায়ের মধ্য দিয়ে শেষ হল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দীর্ঘ ৩৪ বছরের পথপরিক্রমা।
পরবর্তীতে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরো সাত আত্মস্বীকৃত খুনি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন– খন্দকার আবদুর রশিদ, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, আবদুল আজিজ পাশা ও ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ [২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়]। এই নরপিশাচদের মধ্যে আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান। রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতে গ্রেফতার হওয়ার খবর প্রকাশ পায়, যদিও তার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায় নি।
সুশাসনের মানদণ্ড হচ্ছে আইনের শাসন। আইনের শাসন রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সকল ক্রিয়াকর্ম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ব্যবহারিক ভাষায় আইনের শাসনের অর্থ এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সর্বদা আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যেকোন নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সকল নাগরিকের সমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার কাজ শেষ করার মধ্য দিয়ে এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
লেখক: আইনজীবী