হাইকোর্ট এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা

বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে রিটের চূড়ান্ত শুনানি ঝুলে আছে ১৪ বছর

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে দুটি রিট আবেদনের শুনানি ঝুলে আছে বছরের পর বছর। এর মধ্যে একটি রিট ১৪ বছর আগে, আরেকটি ১১ বছর আগে করা হয়েছিল।

দীর্ঘদিনেও এই দুই রিটের শুনানি না হওয়ার জন্য রিট আবেদনকারীরা রাষ্ট্রপক্ষের নির্লিপ্ততাকে দায়ী মনে করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এত বছরেও আদালতের রুলের জবাব দেয়নি।এ ছাড়া কথিত বন্দুকযুদ্ধের এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এক দশক আগে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুল দিয়েছিলেন। সেটারও এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি।

বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে প্রথম রিটটি হয় ২০০৬ সালের আগস্টে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৬ আগস্ট হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে নিরাপত্তা হেফাজতে আটক ব্যক্তিদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।

এরপর গত ১৪ বছরেও শুনানি হয়নি। এর কারণ জানতে চাইলে রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ক্রসফায়ার-সংক্রান্ত ওই রুলের জবাব এখন পর্যন্ত সরকারপক্ষ দেয়নি। তিনি বলেন, শুনানির জন্য বিষয়টি কার্যতালিকার শীর্ষে আসার পর দেখা গেল আদালতের অবকাশ শুরু হয়ে গেল। তালিকার শীর্ষে আসতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। আবার অনেক সময় আদালতের বিচারিক এখতিয়ারও পরিবর্তন হয়। আবার শুনানির জন্য উঠলেও বিবাদীদের রুলের জবাব না আসায় শুনানি পিছিয়ে যায়। রুলের জবাব পেলে বিষয়টি শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান এই আইনজীবী।

এরপর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও অবৈধ ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালের ২১ জুন হাইকোর্টে আরেকটি রিট হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও কর্মজীবী নারী জনস্বার্থে এই রিট করে।

প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৯ জুন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল দেন। রুলে ক্রসফায়ারের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, এ মর্মে কারণ দর্শাতে বলা হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র‍্যাবের মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু গত ১১ বছরেও রুলের জবাব আসেনি বলে জানান আসকের আইনজীবী মো. শাহীনুজ্জামান।

এ জন্য রাষ্ট্রপক্ষের নির্লিপ্ততাকে দায়ী করেন আসকের চেয়ারপারসন ও ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ বারবার সময় নেয়, যে কারণে শুনানি পিছিয়ে যায়। এ ছাড়া পদ্ধতিগত জটিলতা ও সময়মতো রুলের জবাব না দেওয়া রুল শুনানির অন্তরায়। এ ধরনের জনস্বার্থ মামলা শুনানির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের নির্লিপ্ততার ব্যাপারেও আদালতের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
বিজ্ঞাপন

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রুল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের নির্লিপ্ততার কোনো অবকাশ নেই। কেননা, যারা রিট আবেদনকারী, তাদের শুনানির উদ্যোগ নিতে হয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্র কখনোই বিচারবহির্ভূত হত্যা সমর্থন করে না। তবে কেন ও কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনা ঘটেছে, তা-ই এখানে বিচার্য।

আরও দুটি রুল
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ২৫ মে হাইকোর্ট বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রশ্নে রুল দিয়েছিলেন। লালবাগের টুন্ডা ইসমাইল পুলিশি হেফাজতে মারা যান। ওই ঘটনার কেন যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। আজ পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত রুল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।

২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর মাদারীপুরে র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ভাই লুৎফর খালাসী (৪৫) ও খায়রুল খালাসী (৩০) নিহত হন। সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ পরদিন বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান (এখন অবসরপ্রাপ্ত) ও বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেন। বন্দুকযুদ্ধে দুই ভাই নিহত হওয়ার ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়।

ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ রুলের জবাব দেয়। তাতে বলা হয়, এ নিয়ে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, সে ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তখন রাষ্ট্রপক্ষের সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর অবকাশ শেষে আদালত খোলার এক সপ্তাহ পর শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছিলেন হাইকোর্ট। পরবর্তী সময়ে রুল ইস্যু করা দ্বৈত বেঞ্চ পুনর্গঠন ও বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতির এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ার পর ওই রুলের ওপর আর শুনানি হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, হাইকোর্টের জারি করা স্বতঃপ্রণোদিত রুল উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। রুল ইস্যু করা বেঞ্চ পুনর্গঠন বা এখতিয়ার পরিবর্তন হলে প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলে স্বতঃপ্রণোদিত রুলের শুনানি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। এ মুহূর্ত থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমাপ্তি চাই। ’

কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সম্প্রতি কক্সবাজারে এক তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর এই আলোচনা আবার ব্যাপকভাবে সামনে এসেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমও বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সূত্র- প্রথম আলো