অধ্যাপক ড. শাহ আলম

স্মরণে আইনজগতের দিকপাল অধ্যাপক ড. শাহ আলম

অধ্যাপক ড. শাহ আলম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডিন এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ আইন কমিশনের সাবেক সদস্য বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ সোমবার (৩১ আগস্ট) রাতে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। সর্বশেষ স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হন। আইনের খ্যাতিমান এই শিক্ষকের মৃত্যুতে আইনাঙ্গনে শোকের মাতম। অধ্যাপক ড. শাহ আলম স্মরণে তাঁর ছাত্রদের কিছু মন্তব্য ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য তুলে ধর হল।

১.

একটি বিনীত প্রস্তাব-

অধ্যাপক ড. খবির উদ্দিন স্যারের পর অধ্যাপক ড. শাহ আলম স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আইন বিভাগের সোনালী প্রজন্মটি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।

ড. শাহ আলম স্যারের বিদায়ের পর বিভাগীয় সভা বা স্মরণ সভায় ব্যক্তিগতভাবে হাজির হওয়ার সুযোগ হয়তো পাবো না। তাই নিজের ওয়ালে প্রস্তাবটি দিয়ে রাখছি। প্রফেসর ড. এম শাহ আলম আমাদের অস্তিত্ব এবং যাত্রা শুরুর কান্ডারী। আমাদের শত শত শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবী ও শিক্ষার্থীর আইনের প্রথম পাঠ ড শাহ আলম। জীবন বোধেরও। আমাদের আত্ন পরিচয়ও তিনি। আমাদের লাল দালানের সামনের যে সবুজ চত্বরটি আমরা ফুলে ফুলে সাজিয়েছি সেটি কি ড শাহ আলম চত্বর হতে পারে? স্যারের একটি ম্যুরাল সহ? এ কে খান আইন অনুষদ ভবন নাম ফলকটির দ্শ্যমান গুরুত্বের কোন ক্ষতি না করে যেভাবে কাজটি করা সম্ভব হয়। আশা করি আমার শিক্ষকরা ব্যাপারটি বিবেচনা করবেন।

খবির স্যারের ইন্তেকালের পর বিভাগীয় স্মরণ সভায় আমাদের সেমিনার লাইব্রেরীটি খবির স্যারের নামে নামকরণ করার প্রস্তাব করেছিলাম। পরে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির সভায় প্রস্তাবটি পাশ হয়। পুরনো ল ক্লিনিকের পাশের সেমিনার লাইব্রেরীটি খবির স্যারের নামেই নামাঙ্কিত হয়। পরে এ কে খান ভবনে আসার পর সেমিনার লাইব্রেরীটিতে খবির স্যারের নামের সাইন বোর্ডটি আর স্থাপিত হয় নি। এটি পুনঃস্থাপিত হওয়া জরুরী। নতুন প্রজম্ম আমাদের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের ভুলে যেতে পারে না।

-জসিম আলী চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

২.

নগণ্য ছাত্রের জন্য অনন্য উচ্চতার ব্যক্তিত্বের আন্তরিকতা-

অনার্স তৃতীয় বর্ষে ‘ল ভিশন’ এর জন্য সাউথ তালপট্টি দ্বীপ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিরোধ নিয়ে লিখব বলে ঠিক করে রুবাইয়াত কে সাথে নিয়ে শাহ আলম স্যার এর কাছে যাই রিসোর্সের জন্য। আমি বলার আগে রুবাইয়াত, তার বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে স্যার বল্লেন, ‘তোমার বন্ধু হতে হবে কেন? সে আমার ছাত্র!’ তারপর, স্যার দিনক্ষণ জানিয়ে দিয়ে আসতে বললেন। নির্ধারিত দিনে স্যার এর অফিস কক্ষে গিয়ে দেখলাম, স্যার তার নিজের, ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ সহ আরো সংশ্লিষ্টজনদের বেশকিছু লেখা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। নিয়মানুবর্তিতা ছাড়াও আমি অভিভূত হলাম একজন নগণ্য ছাত্রের জন্য অনন্য উচ্চতার ব্যক্তিত্বের আন্তরিকতা দেখে। স্যার আমাকে নিজের হাতে শিখিয়ে দিলেন আমি এসব আর্টিকেল হতে সাইট করলে, ঠিকমত যেন রেফারেন্সিং করি। পরে আমার লেখা পাবলিশ হলে স্যার কে দেখাতে নিয়ে গেলাম। স্যার খুব খুশি হলেন। খুব উতসাহ দিলেন। স্যার এমন মানুষ ছিলেন, যার কল্যানে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা হাজারো ছাত্রের শুধু জীবন নয়, জীবনবোধ পাল্টেছে। এই মহান ব্যক্তিকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাওয়া ছিল আমাদের পরম সৌভাগ্যের।

ক্লাসে স্যার এর লেকচার শুনে মনে হত, আইন এত সহজ আর এত সাধারণ! স্যার এর প্রশ্নের যে উত্তর আমরা যেভাবেই দিতাম না কেন, সঠিক উত্তরটা না পেলেও স্যার বলতেন, ‘উত্তরটা একটা আসপেক্ট থেকে ঠিক আছে!’

তিনি একজন। একজন শাহ আলম স্যার। একজন শিক্ষক। উপমহাদেশে আইনজগতে একজন দিকপাল। একজন দার্শনিক। একজন ন্যায়পরায়ন, মানবিক মানুষ। অনেকেই হয়ত জানেনা, দেশ কত বড় সম্পদ হারালো। কায়মনোবাক্যে স্যার এর জন্য দোয়া করছি, স্যারকে যেন আল্লাহ পরপারে ভালো রাখেন!

-কাজী মোহাম্মদ মোহসেন: বিচারক; বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস।

৩.

শাহ আলম স্যারের ছাত্র হওয়া আমার জীবনের এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা-

পৃথিবীতে ক্ষণস্থায়ী জীবনে আমাদের যত অভিজ্ঞতা হয় তার মাঝে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা সারা জীবন আমাদেরকে প্রভাবিত করে। কম বা বেশি যাই হোক না কেন সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমরা সারা জীবন বয়ে বেড়াই। শাহ আলম স্যারের ছাত্র হওয়াও আমার জীবনের এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। স্যারের অনেক সৌভাগ্যবান ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে আমিও একজন যে কিনা সারা জীবন স্যারের ছাত্র হবার গৌরব বয়ে বেড়াব। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন আজ স্যারের মৃত্যুতে আমাদের চবি আইন পরিবার বেদনায় শোকে কাতর। আমাদের চবি আইন পরিবারের সেই কর্তা শাহ আলম স্যার গতকাল রাতে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।

এইচএসসি পড়ার সময় হতেই আইনের ছাত্র হবার পরিকল্পনা ছিল। আমি মোটেও জানতাম না আইন কিভাবে পড়তে হয়। শাহ আলম স্যারের হাতেই আমার আইন শিক্ষার হাতে খড়ি। জীবনে কত ভাল কাজ করেছি জানি না তবে কোন এক ভাল কাজের পুরস্কার হিসাবে যে আইন শিক্ষায় সবার প্রথমে জুরিস্প্রুডেন্স ক্লাসে শাহ আলম স্যারের লেকচার পেয়েছি তার জন্য সারা জীবনই ধন্য মনে হবে।

স্যার আইন বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব পড়াতেন। সেই প্রথম বর্ষ থেকে যখনই পারি জুরিস্প্রুডেন্সের বই সংগ্রহ করি। শাহ আলম স্যারের ক্লাসেই শিখেছিলাম When does Question of Fact transform into a Question of Law? প্রতিদিন যত মামলাই করি না কেন এই প্রশ্নের উত্তরই সব মামলায় খুঁজি।

যতদিন আইন পেশায় থাকব ততদিনই এই প্রশ্নের উত্তর খুজে নিতে হবে আমাদের। শাহ আলম স্যার আজ নেই কিন্তু স্যারের শিক্ষাটুকু সারাজীবন থেকে যাবে। স্যার শত সহশ্র ছাত্র ছাত্রীর মাঝে বেচে থাকবেন। সবাই স্যারের জন্য দোয়া করবেন।

-মোকাররামুছ সাকলান: আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

৪.

স্মরণে ড. শাহ আলম স্যার-

২০০৮ সাল। ১/১১ পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদল বাংলাদেশে। দুই নেত্রী কারাগারে। ঘরোয়া রাজনীতির উপর ঝুলছে নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। আমরা তখন সম্মান ২য় বর্ষে পড়ি। সাংবিধানিক আইন পড়াচ্ছেন অধ্যাপক ড. শাহ আলম স্যার। বলে রাখি তিনি প্রথম বর্ষে আমাদের আইনবিজ্ঞান পড়ালেও আমি সে বছর খুবই কম ভার্সিটিতে গিয়েছি বলে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য স্মৃতি নেই।

সাংবিধানিক আইন ক্লাস করতে গিয়ে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। নিষিদ্ধ ঘরোয়া রাজনীতি কী অবলীলায় উন্মুক্ত হয়ে গেছে আমাদের ক্লাসে! আমাদের শিক্ষক ক্লাসকে করে দিয়েছেন মতপ্রকাশের মঞ্চ। স্যার পড়িয়ে চলেছেন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, পঞ্চম সংশোধনী, অষ্টম সংশোধনী, চতুর্দশ সংশোধনী। কোন প্রেক্ষাপটে এগুলো আনা হয়েছিল, আখেরে কার কী লাভ হয়েছে এ নিয়ে স্যার ফ্লোর উন্মুক্ত করে দিতেন।

আমাদের মেধাবী নাবিলা, দুর্দান্ত সাজেল তাদের মত করে ব্যাখ্যা করতেন। বন্ধু সোহেল, শোয়েব গণি কিংবা আমার মত ব্যাক বেঞ্চার আলোচনা করতাম রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমাদের ব্যাখ্যা হতো দুর্বল। গলায় আওয়াজ থাকতো বেশি। আমরা তখন দলকে ভালোবাসি। আমাদের স্যার রথি মহারথীদের কথা শুনতেন। আমার মত অধমকেও থামিয়ে দিতেন না। এরপর স্যার ব্যাখ্যা করতেন। এমনভাবে করতেন আমাদের মনে হতো আমাদের ব্যাখ্যা স্যার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেননি। আমার জীবনে আমি বহু শিক্ষকের ক্লাস করেছি। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এমন গণতান্ত্রিক চর্চা আর দেখিনি। অনেক শিক্ষককে দেখেছি তাদের মতের বাইরে গিয়ে আওয়াজ করলে ক্লাস থেকেই বের করে দিতে। ড. শাহ আলম স্যার সেটা করেননি। এই যে ছাত্রকে গুরুত্ব দেয়া এটাই আমাদের সিংহভাগ শিক্ষক করেন না। শুধু এ একটি জায়গাতেই স্যার অনন্য, অতুলনীয়।

বিভাগে বিতর্ক প্রতিযোগিতা হবে। আমাদের ডিবেট বড় ভাইয়া আপুদের সাথে। টপিকটাই ধরতে পারছিলাম না। আইনবিভাগের শিক্ষকদের বসার পুরনো দালানে স্যার বসতেন। অনুমতি নিয়ে ঢুকলাম। স্যার খুব ব্যস্ত পাঁচ মিনিট সময় আছে বলার পর পনেরো মিনিট সময় দিলেন। প্রতিপক্ষ কীভাবে এ বিষয়টা ভাববে সে দিক থেকে স্যার বোঝালেন। বিতর্কের একটা নতুন দিক শিখলাম। কী তাঁর বিশ্লেষণের সামর্থ্য বলে বোঝাতে পারব না!

আমি বহুবার জুডিশিয়ারির ভাইভা দিয়ে বুড়ো বয়সে চাকুরি পাই। একাদশ জুডিশিয়ারির ভাইভায় আল্লাহর রহমতে আমি একটা ছাড়া সব প্রশ্নের উত্তর বলতে সক্ষম হই। পারাটা অস্বাভাবিক নয় কারণ পাঁচ বছর পরীক্ষা দিতে দিতে ততদিনে জুডিশিয়ারি পরীক্ষার ওপর আমার অনার্স মাস্টার্স হয়ে গেছে! ভাইভা বোর্ডের শেষ প্রশ্ন ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশান কী? আমি বলতে পারিনি। দু:খিত বলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী শিক্ষক রহমতউল্লাহ স্যার বললেন “তুমি শাহ আলম স্যারের বই পড়োনি? কী সুন্দর করে লিখেছেন?” এরপর ভাইভা বোর্ড সদস্যরা বইটার প্রশংসা করেছেন। আমার ভালো লাগছিল আমার শিক্ষককে ও তাঁর বইকে এত সম্মান করে দেখে!

আমি একসময় সাড়ে পাঁচ বছর একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। সেখানে সাংবিধানিক আইন পড়ানোর সময় প্রথম ক্লাসেই ছাত্রছাত্রীদের বলতাম “আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি সাংবিধানিক আইন শিখেছি ড. শাহ আলম স্যারের ক্লাসে আর আপনারা শিখছেন আমার ক্লাসে! এ বিশাল মানগত পার্থক্যে আপনাদের শিখতে হচ্ছে বলে আমি দু:খিত।”

স্যার গতরাতে (৩১ আগস্ট) আমাদের রেখে চলে গেছেন। আল্লাহ স্যারকে জান্নাত দান করুন। স্যার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন সবাই শিক্ষক নন, কেউ কেউ শিক্ষক।

প্রসঙ্গত বলে রাখি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ডিন ছিলেন। ছিলেন আইন কমিশনের সদস্য। সবচেয়ে বেশি ছিলেন প্রকৃত শিক্ষক। যা আজকের প্রেক্ষাপটে বড় বিরল!

-কাজী শরীফ: সহকারী জজ; নোয়াখালী