প্রতারণার মামলায় দোষী প্রমাণিত হলেও কারাগারে যেতে হচ্ছে না অভিযুক্ত এক আসামিকে। কারাবাসের বদলে তাকে বই পড়তে হবে। গাছ লাগাতে হবে। খাওয়াতে হবে এতিমদের। নিয়মিত পড়তে হবে নামাজ। মাদক থেকেও দূরে থাকতে হবে।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার একটি আদালতে অভিনব এ রায় দেওয়া হয়েছে। আসামিকে সংশোধনের সুযোগ দিতেই এ রায় দিয়েছেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দেব। আর তাই রায়ে আসামির ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ হলেও তা স্থগিত রাখা হয়েছে। আইনের পরিভাষায় এটাকে বলে স্থগিত সাজা।
দণ্ডিত এই আসামির নাম সুলতান আহমেদ। চকরিয়া উপজেলার ১নং ফাসিয়াখালী ওয়ার্ডের বাসিন্দা তিনি। বিদেশ পাঠানোর নামে টাকা গ্রহণ করে প্রতারণা করার অভিযোগে ২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়। ৯ বছর মামলা চলার পর গত ২৪ আগস্ট এই রায় দেন বিচারক। এই রায়ে খুশি বাদী-বিবাদী উভয়ই।
রায়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে প্রবেশন কর্মকর্তা করে আসামিকে ১২টি শর্ত মেনে চলতে বলা হয়েছে। আসামি সব নির্দেশনা যথাযথভাবে মানছে কিনা প্রবেশন কর্মকর্তা সে ব্যাপারে প্রতি তিন মাস পরপর প্রতিবেদন দিয়ে জানাবেন আদালতকে। প্রতিবেদন সন্তোষজনক না হলে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ ভোগ করতে হবে আসামিকে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ এমরান বলেন, বিদেশ পাঠাতে ভিসা বিক্রির চুক্তিপত্র করেও প্রতারণা করার অভিযোগে ২০১১ সালের নভেম্বরে সুলতান আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি এই মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। নয় বছর মামলা চলার পর গত ২৪ আগস্ট আসামিকে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। তবে আসামির বয়স ষাটোর্ধ্ব হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় এনে আদালত তাকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন। ছয় মাসের দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে আসামিকে ১২টি শর্ত দিয়েছেন। এসব শর্তের ব্যত্যয় হলে কারাদণ্ডাদেশ ভোগ করতে হবে আসামিকে।
বিচারক রাজীব কুমার প্রবেশনকালীন সময়ে আসামিকে যে ১২টি শর্ত পূরণ করতে বলেছেন, সেগুলো হলো- কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবেন না; শান্তি বজায় রাখবেন এবং ভালো ব্যবহার করবেন; আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তলব করলে যথাসময়ে উপস্থিত হবেন; কোনো ধরনের মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করবেন না; নিয়মিত নামাজ পড়বেন; ভিসা গ্রহণ বা প্রদান সংক্রান্ত কাজে কোনোভাবে অংশগ্রহণ করবেন না; মুক্তিযুদ্ধের ওপর কমপক্ষে দুটি বই পড়বেন; পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে ঘরের চারপাশে ৪০টি গাছ লাগাবেন; এলাকার সব বাসিন্দার সঙ্গে সু-সম্পর্ক রাখবেন; স্থানীয় ফাসিয়াকালী আশরাফুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার সব এতিমকে ছয় দিন একবেলা দুপুরের খাবার খাওয়াবেন, প্রত্যেককে একটি লুঙ্গি-গেঞ্জি ও প্রতিষ্ঠানে ১০টি কোরআন শরিফ প্রদান করবেন। স্থানীয় রশিদ আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এক থেকে ১০ পর্যন্ত রোলধারী ছাত্র-ছাত্রীর প্রত্যেককে ১২টি বলপেন, ১০টি খাতা, একটি জ্যামিতি বক্স, একটি স্কুলব্যাগ ও একটি ভ্রমণবিষয়ক গল্পের বইও কিনে দিতে হবে সুলতান আহমেদকে। সমাজের সদস্যদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবেন মর্মে ঘোষণাপত্রও দিতে হবে আসামিকে।
জানতে চাইলে দণ্ডিত সুলতান আহমেদ বলেন, ‘সংশোধনের সুযোগ দেওয়ায় বিজ্ঞ বিচারকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এরই মধ্যে স্কুলের জন্য বই, বলপেন, জ্যামিতি বক্স ও খাতা আমি কিনেছি। দু-একদিনের মধ্যে এটা স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে বণ্টন করব। আদালতের অন্যান্য নির্দেশনাও যথাযথভাবে পালন করব আমি।’
আসামির আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, ‘আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করতে আইনজীবী হিসেবেও ভূমিকা রাখব আমি।’
মামলার পর্যবেক্ষণে বিচারক রাজীব কুমার বলেছেন, সুলতান আহমেদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৮৬০-এর ৪২০ ধারায় গঠিত অভিযোগটি প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ৪০৬ ধারার অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। আসামির বয়স ৬৪/৬৫। তিনি যথেষ্ট অর্থবিত্তের মালিক। তার বিরুদ্ধে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে তাই আসামিকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
চকরিয়ার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হামিদুল্লাহ মিয়া বলেন, ‘তিনি তাকে প্রবেশন কর্মকর্তার দায়িত্ব দিয়ে আদালতের পাঠানো রায়ের অনুলিপি পেয়েছেন। প্রতি তিন মাস পরপর আদালতে এ ব্যাপারে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেবেন তিনি।’
কক্সবাজার জেলা আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মোহাম্মদ ফরিদুল আলম বলেন, ‘কক্সবাজারে আমার জানামতে এমন রায় প্রথম। আসামি সুলতান আহমেদকে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেটি সমাজের আরও হাজারো মানুষকে নতুন একটা বার্তা দেবে। এ রায়কে তাই স্বাগত জানাই।’
জানা গেছে, গত মার্চে মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমানও পারিবারিক বিরোধ সংক্রান্ত একটি মামলায় এ ধরনের একটি রায় দিয়েছিলেন। সূত্র- সমকাল