ইমরান হোসেন:
৫ম সংশোধনী মামলায় আপিলের রায়ের শেষ বাক্য- “Let us bid farewell to all kinds of extra constitutional adventure forever.” এই মামলায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কাজগুলো বৈধ নাকি অবৈধ তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে আপিল বিভাগ কিছু কাজকে মার্জনা করেছেন। সেগুলো হলো- ১) past and closed transactions; ২) যেসব acts and legislative measures সামরিক আইনের আগের আইনি কাঠামোতে করা যেত; ৩) সেসব কাজ যা জনকল্যাণ তরান্বিত করে; ৪) routine work.
মূলত আসমা জিলানী (Asma Jilani) মামলায় বিচারপতি হামুদুর রহমান (পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি) প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ আদালত গ্রহণ করেছেন। এই একই পর্যবেক্ষণ ষোড়শ সংশোধনীর রায়েও আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন। ৫ম সংশোধনীতে মুখবন্ধে বিসমিল্লাহ যুক্ত করলেও রায়ে তা মার্জনা করা হয়নি এবং বিসমিল্লাহ’র ওপর প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ রাষ্ট্রধর্ম নিয়েই। যদিও সেখানে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইস্যু (issue) ছিল না। আদালতের রায়ের দুটো অংশ থাকে। একটা- Ratio decidendi, আরেকটা obiter dicta. সবাই জানে ratio decidendi নজির হিসেবে কাজ করে। কিন্ত, কোনটা ratio তা শনাক্ত করবো কিভাবে? ৩ টা শর্ত আছে। একটা ইস্যু ‘raised, deliberated upon and decided’ হতে হবে। যখন একটা ইস্যুতে এই ৩টা কাজ একসাথে হবে তখন সে ইস্যু এর ওপর প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ নজির (precedent) হিসেবে সংবিধানের আলোকে বাধ্যতামূলক হয়। ৫ম সংশোধনীর রায়ে ২ক ইস্যু ছিল না, ষোড়শ সংশোধনীর রায়েও ইস্যু ছিল না। তবে দুটোর রায়েই আপিল বিভাগ রাষ্ট্রের ধর্মীয় বৈশিষ্ট নিয়ে আলোচনা করে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নিরুৎসাহিত করেছেন। ৫ম সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ বলেন- সেক্যুলারিজম বাদ দেয়ায় একটি মৌলিক নীতি (fundamental policy) বাদ দেয়া হলো, যা মুক্তিযুদ্ধের একটি ভিত্তি বা মূল নীতি (basis) ধ্বংস করার মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় চরিত্র পাল্টে দিয়েছে। রায়ের ১৩৮ নং প্যারায় ধর্মভিত্তিক করা হলে তা মূল কাঠামোর (basic structure) পরিবর্তন ঘটাবে বলা হয়েছে। এই মামলায় হাইকোর্ট বলেন- পাকিস্তানিরা ধর্মের নামে এদেশে মানুষ খুন করতো। ইসলাম রক্ষার জন্য এদেশের ‘আধা-মুসলিম’(সামরিক বাহিনী সমর্থিত পাকিস্তানি সরকারের ভাষায়) এবং হিন্দুদের খুন, ধর্ষণ করতো। স্বাধীনতার পর এসব ঘটনা মানুষের মনে দগদগে ছিল। তাই মানুষ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চায়নি। এর প্রতিফলন ঘটে ৭২ এর সংবিধানে।
যদিও ২ক ইস্যু ছিল না, কিন্ত রাষ্ট্রের ধর্মীয় চরিত্র ইস্যু ছিল বিসমিল্লাহ, ৮,১২,৩৮(২) প্রভৃতি অনুচ্ছেদের কারণে। সুতরাং,বর্তমানে ধর্মীয় চরিত্র আবার ইস্যু হওয়ায় ওই পর্যবেক্ষণ ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বর্তমান আপিল বিভাগের ওপর বাধ্যতামূলক, যা good and cogent reason ছাড়া reversal এর আগে না মানলে সংবিধান ভঙ্গ করার শামিল বলে প্রতীয়মান হয়।
৮ম সংশোধনী মামলায় ২ক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তবে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে ২ক issue না হলেও আপিল বিভাগ বলেন- ২ক যুক্ত করা এবং ১৫ তম সংশোধনীতে তা রেখে দেয়া মানে ধর্মনিরপেক্ষতা (secularism) কে ‘totally compromised and buried’ করা হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে এত কথার পর বিশেষ করে ৫ম সংশোধনী রায়ের পর্যবেক্ষণের কারণে ২ক এর পক্ষে বলার সুযোগ কমে গেছে।
বাংলাদেশ কেন সেক্যুলার হবে?
The Rape of Bangladesh বইয়ে অ্যান্থনি বলেছেন, সংবিধানে বুলি কপচানো ছাড়া পাকিস্তানের আর কোথাও ইসলাম ছিল না। যদি তাই হতো, তাহলে পাকিস্তান মুসলিম দেশ হিসেবে ভারত থেকে আগমন প্রত্যাশী মুসলমানদের জন্য এর সীমানা খুলে দেয় না কেন? মুসলমানদের বসতি হিসেবেই তো পাকিস্তান গড়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারে শেখ মুজিবুর রহমান রোজা রেখে সারা দেশে ঘুরেছেন, অথচ দুজন মুসলিম লীগ নেতার সাথে আমি খাবার খেয়েছি দিনের বেলা। খুশবন্ত সিং তার ‘দিল্লী’ বইয়ে লিখেছেন- ইসলামের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান হয়েছে। অথচ মুসলমানদের নেতা জিন্নাহ ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ এ রমজান মাসের দিনের বেলায় ইংরেজদের সাথে মদপান করছিলেন। এর অর্থ হলো- জিন্নাহ নিজে ধার্মিক ছিলেন না। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ও চাননি। চেয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নতুন বসতি। তিনি যে ইসলামি রাষ্ট্র চাননি তার প্রমাণ পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রথম বক্তব্য থেকেই পরিস্কার। তিনি বলেন-
“ ….If you change your past and work together in a spirit that everyone of you…no matter what is his color, caste or creed,is first second and last a citizen of this state with equal rights,privileges and obligations,there will be no end to the progress..”
“You may belong to any religion or caste or creed-that has nothing to do with the business of the State.”
“…you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims,not in the religious sense because that is the personal faith of each individual,but in the political sense as citizens of the State.”
পাকিস্তানের জাতির পিতা ধর্মভিত্তিক দেশ চাননি, তাই তিনি ধর্মহীন ছিলেন? তাকে কেউ নাস্তিক বলে না কেন? সুতরাং, পাকিস্তান শুরু থেকে ভুলের উপর আছে। আমরা তাদের অনুসরণ করবো না বলেই এসব ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে বিবাদ হয়। সেই বিবাদে আমরা তাদের থেকে আলাদা হয়েছি। আজকের মানুষ ধার্মিক নয়, ধর্মান্ধ। ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগ ধর্মভিত্তিক দেশ গঠন করবে এমন ম্যান্ডেট দেয়নি। তবুও জনগণ তাদের ভোট দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা ধর্মীয় রাষ্ট্র চায়নি। চাইলে মুসলিম লীগকেই ভোট দিতো। ভোটদানকারী এসব মানুষ তাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ করেছে, অন্যান্যের মাঝে। এ মানুষের মধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ ও ছিল। তারা কী ধর্মীয় রাষ্ট্র্রের জন্য যুদ্ধ করেছে? উত্তর হচ্ছে, না। কারণ, তাদের ধর্ম ইসলাম নয়। রাষ্ট্রীয় পতাকা, সঙ্গীত যেমন সকলের, ধর্ম তেমন সকলের করা যায়?
ইসলামি রাষ্ট্র মানে বাংলাদেশের ধর্ম ইসলাম। এর অর্থ- বাংলাদেশের সব নাগরিকের ধর্ম সাংবিধানিকভাবে ইসলাম, ব্যক্তিগতভাবে হিন্দু হলেও। এটা অন্যের ওপর ধর্ম চাপিয়ে দেয়া- যা ঘৃণিত কাজ। যদি সব ধর্মকেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম করা হয় এর অর্থ- সব ধর্ম সবার। তখন একজন মুসলমান রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্তত ৪টি ধর্ম লালন করছে বর্তমানে। এতবড় দ্বিমুখী আচরণ রাষ্ট্র তো পারেই না, ধার্মিক ও পারে না। একসাথে ৪টা রাষ্ট্রধর্ম থাকা মানে রাষ্ট্র প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। রাষ্ট্রের মর্জিমত রাষ্ট্র মসজিদ-মন্দির-গীর্জায় যাবে, অথচ রাষ্ট্র তা পারে না। যখন মুসলিমদের পক্ষে গেলে সুবিধা তখন হিন্দুদের অসুবিধা হলেও মুসলিমদের পক্ষে থাকবে। একইভাবে অন্য ক্ষেত্রেও।
৭০ সালে জনগণ ধর্মীয় দলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে যেন ধর্ম রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ না করে। তাদের প্রতিনিধিরা ৭২ এ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করে। ৭০ সালের জনগণ ৫৬, ৬৮ এর মুসলিম লীগ প্রণীত সংবিধান দেখেছে। সেসময়ের মানুষ নিরক্ষর ছিল। এমতাবস্থায়ও যদি মুসলিম লীগের ইসলামি রাষ্ট্রপন্থী দলকে ভোট না দেয়, তাহলে তা জনঅসন্তোষই বুঝায়। মানুষ ধর্মীয় দলে আস্থা না পেয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় ধর্মহীন নয়, ধর্মনিরপেক্ষ হতে। ৭০ এ নির্বাচন হয়েছিল এ সংবিধান প্রনয়ণের জন্য। সেই সংবিধান বিকৃত করার ম্যান্ডেট এরশাদ জনগন থেকে নিয়েছিল? নির্বাচনী ইশতেহারে ২ক সংযুক্ত করবে তা বলা ছিল? একটা সংশোধন কিছু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় সংবিধানের অংশ হতে গেলে। যেমন-
১) mandatory procedural requirements strictly অনুসরণ করা হয়েছে
২) আইনের সাথে প্রতারণা করা হয়নি
৩) এটি সংবিধানকে অকার্যকর করবে না
৪) basic structure ধ্বংস করেনি।
২ক বা ৮ম সংশোধনী এসব পরীক্ষায় পাস করেছে? করেনি। কারণ, এটি basic structure নষ্ট করেছে। বর্তমান অনুচ্ছেদ ৭ তখনো বলবৎ ছিল। এই অনুচ্ছেদের বর্তমানে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোন আইন প্রনয়ণ করা যায় না। যেহেতু, সংবিধান(৮ম সংশোধন) আইন, ১৯৮৮ অনুচ্ছেদ ১৫২ অনুযায়ী একটি আইন, সুতরাং ২ক সহ এই আইনের যতটুকু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল, ততটুকু সংবিধানের অংশই হতে পারেনি। সুতরাং, এমন একটি ‘extra constitutional adventure’ নিয়ে মানুষের এত আস্ফালন কেন?
আদালত ২ক বাতিল করলে কী হবে?
গত ৩২ বছর ধরে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এর ফলে মুসলিমরা সব নামাজ পড়ে না, হজ্ব করে না, যাকাত দেয় না। বরং, ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং তাগিদে করে। আজ যদি আদালত ২ক বহাল করে, কাল ফজর থেকে ইসলামি দেশের ৯০% মুসলিম জামাতে নামাজ পড়বে? কোনো মুসলমান নারী-শিশু নির্যাতন বন্ধ করে দিবে? হত্যা-ধর্ষণ, মাপে কম দেয়া, পরকীয়া-ব্যভিচার, ঘুষ-সুদ এসব খাওয়া বন্ধ হবে? মাছওয়ালা ভালো মাছ দিবে? কর্জে হাসানা দিবে? গীবত ছেড়ে দিবে? এর কিছুই হবে না। বিগত ৩২ বছরে রাষ্ট্রধর্ম কোনো প্রভাব ফেলেনি মানুষের আচরণে। ভবিষ্যতেও ফেলবে না। রাষ্ট্রধর্ম বাতিল হলে কী হবে? তাও কিছু হবে না। তবে বিতর্ক শেষ হবে। আসুন, আপিল বিভাগের সমর্থনে সংবিধান বহির্ভূত সকল অন্যায় আবদারকে বিদায় জানাই। আমাদের ‘State religion’ দরকার নেই, বরং ‘state of religion’ এ মনোযোগ দেয়া দরকার।
ইমরান হোসেন: শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জজ কোর্ট, ফেনী।