বাংলাদেশ বিচার বিভাগের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের পুরনো। সুদীর্ঘকাল যাবত ভারতীয় বিচার বিভাগের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের ফলে আজকের বিচার বিভাগ এই পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসের ক্রমপর্যায়কে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথাক্রমে- হিন্দু শাসনকাল, মুসলিম শাসনকাল, ব্রিটিশ শাসনকাল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়।
প্রাচীনকালে বিচারকার্য ধর্ম এবং সামাজিক রীতিনীতির আলোকে পরিচালিত হতো। তৎকালীন রাজাগণ আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। শ্রুতি, স্মৃতি, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ ইত্যাদি আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো। এছাড়াও অর্থশাস্ত্র এবং মনুস্মৃতি ভারতীয় আইনের উল্লেখযোগ্য বিধান হিসেবে বিবেচিত হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশে ১১০০ সালের দিকে মুসলিম শাসনকাল আরম্ভ হয়। মুসলিম বাদশাহগণ রাজ্য পরিচালনা করাকালে পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদিস, ইজমা এবং কিয়াসের আলোকে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। সে সময়ে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য সুলতান কর্তৃক ‘কাজী’ নিযুক্ত হতো এবং সর্বোচ্চ আদালত ছিলো সম্রাটের আদালত যা সম্রাট স্বয়ং পরিচালনা করতেন। সুলতানকে এ কাজে সহায়তা করতেন দুইজন ‘মুফতি’। মুসলিম শাসনামলে আদালতসমূহ দুইটি বিধানের আলোকে পরিচালিত হতো- ফিকহ-ই-ফিরোজ শাহ এবং ফতোয়া-ই-আলমগীরী।
ব্রিটিশ কলোনিয়াল পদ্ধতি সূচনার সাথে সাথে ভারতীয় বিচার বিভাগে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। ব্রিটিশ শাসনামল আঠারো’শ শতকের মাঝামাঝি হতে শুরু হয়ে প্রায় দুইশ বছর পরিচালিত হয়। ১৬৬১ সালে চার্লস ২য় কর্তৃক প্রদত্ত সনদ অনুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে নিয়ন্ত্রিত ফ্যাক্টরি এবং মাদ্রাজ, বোম্বে ও কলকাতায় অবস্থিত কোম্পানির নিয়ন্ত্রনাধীন ব্যবসায়িক কেন্দ্রসমূহের দেওয়ানি এবং ফৌজদারি উভয় প্রকারের বিচারকার্য ব্রিটিশ আইন দ্বারা পরিচালিত হতো। ১৬৬৮ সালে প্রদত্ত সনদ দ্বারা কোম্পানি বোম্বেতে তাদের শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে আইন তৈরির ক্ষমতা লাভ করে। ১৬৮৬ সালে প্রদত্ত সনদের বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৮৭ সালে মাদ্রাজে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য মিউনিসিপ্যালিটি এবং মেয়র আদালত স্থাপন করে। পরবর্তিতে বোম্বে এবং মাদ্রাজেও একই ধরনের আদালত স্থাপিত হয়।
রাজা প্রথম জর্জ কর্তৃক ১৭২৬ সালে প্রদত্ত সনদ অনুযায়ী কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বের প্রধান শহরগুলোতে ১৭২৮ সালে মেয়র আদালত স্থাপনের সাথে সাথে ভারতবর্ষে আধুনিক বিচারবিভাগের সূচনা হয়। উক্ত সনদে উল্লেখিত ছিলো যে, গভর্ণর এবং কাউন্সিলের পাঁচজন সিনিয়র সদস্য কর্তৃক ফৌজদারি অপরাধের বিচারকার্য সম্পাদিত হবে এবং তারা জাস্টিস অব পিস হিসেবে বিবেচিত হবে। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং এ্যাক্ট অনুযায়ী ১৭৭৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে সুপ্রীম কোর্ট স্থাপনের সনদ ইস্যু করা হয়। ১৮৩৪ সাল হতে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে রাজার আদালত এবং কোম্পানীর আদালত নামে দুই ধরনের আদালত বিচারকার্য সম্পাদন করতো। ১৮৩৩ সালের জুডিসিয়াল কমিটি আইন পাশ হবার পর হতে প্রিভি কাউন্সিলের নাম হয় জুডিসিয়াল কমিটি অব প্রিভি কাউন্সিল।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিলোপ সাধিত হয় এবং ইংল্যান্ডের রাজা ভারতবর্ষ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান হাইকোর্ট এ্যাক্ট পাশ করা হয়। উক্ত আইন পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে সুপ্রীম কোর্ট, সদর দেওয়ানী আদালত এবং সদর নিজামত আদালতের বিলোপ সাধিত হয় এবং কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। পরবর্তিতে ১৯১৫ সালে ভারত শাসন আইন পাশ হয় যার মাধ্যমে হাইকোর্টের গঠন, এখতিয়ার এবং ক্ষমতা নির্ধারিত হয়।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ভারতের হাইকোর্ট হতে প্রদত্ত সিদ্ধান্তের আপীল শুনানীর জন্য ভারতে ফেডারেল আদালত স্থাপিত হয়। কিন্তু উক্ত ক্ষমতা খুবই সীমিত ছিলো কেননা আইনের ব্যাখ্যা এবং ভারত শাসন আইনের ব্যাখ্যা ব্যতীত অন্য সব আপিল প্রিভি কাউন্সিলে দায়ের করা হতো।
১৯৪৭ সালে পাশকৃত হাইকোর্ট অব বেঙ্গল অর্ডার এর ৯ নং ধারা অনুযায়ী ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হয় যার দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য জন্য পৃথক হাইকোর্ট ঢাকাতে স্থাপিত হয়।
১৯৪৭ সালের ফেডারেল কোর্ট অর্ডার অনুযায়ী পাকিস্তানের করাচিতে ফেডারেল আদালত স্থাপিত হয় । ফলে সেসময় থেকে প্রিভি কাউন্সিলে আপিল দায়েরের পরিবর্তে পাকিস্তানের ফেডারেল আদালতে আপিল দায়ের করা শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার ফলে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে ফেডারেল আদালতের পরিবর্তে সুপ্রীম কোর্ট বিবেচিত হয়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ল’স কন্টিনিউএন্স এনফর্সমেন্ট অর্ডার, ১৯৭১ পাশ করা হয় যার ফলে বাংলাদেশে ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এর পূর্বে পাশকৃত সকল আইন বলবত করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭৪০ টি আইন, ৫০৭ টি অধ্যাদেশ এবং বহু রেগুলেশন প্রচলিত রয়েছে।
সূত্র: বিচার বিভাগীয় বাতায়ন