ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এ আইনে মামলার সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৭৩৪টি মামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানায় করা আরও ৩৩০টি মামলা বিচারের জন্য এ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।
এসব মামলার মধ্যে বেশির ভাগই হয়েছে আইনটির ২৫ ও ২৯ ধারায়। মূলত রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং মানহানির অভিযোগে এ দুটি ধারায় মামলাগুলো হয়েছে। এ আইন হওয়ার আগে একই রকম অভিযোগে মামলা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায়।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত বছর সারা দেশে ৭৩২টি মামলায় ১ হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি বছরের প্রথম দুই (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) মাসে ১৬৫ মামলায় ৩৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর এ আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অন্তত ৫০টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৭ জন সাংবাদিককে।
আইনটি পাস হওয়ার আগে ও পরে এর কিছু ধারার অপপ্রয়োগ হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আইনটির ৯টি ধারা বাক্স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এসব ধারা সংশোধনের দাবি করে আসছে সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি আমলে ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মানহানি ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া সংক্রান্ত ধারাগুলো একই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। আইনটি সরকার বা সরকারদলীয় ব্যক্তিদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে বেশি প্রয়োগ হচ্ছে।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কেবল ট্রাইব্যুনালে নালিশি মামলা হয়েছে ৪৬৮টি। আর চলতি বছরের গত আট মাসে মামলা হয়েছে ২২০টি। অবশ্য এ ২০ মাসে উপাদান না থাকায় ৩২৯টি মামলা সরাসরি খারিজ করে দেন আদালত।
বেশির ভাগ অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে না
আগের আইসিটি আইন ও বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা সারা দেশের মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে। এ আদালতে এ পর্যন্ত বিচারের জন্য মামলা এসেছে ২ হাজার ৬৮২টি। এর অর্ধেকের বেশি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় করা মামলা।
বর্তমানে এ ট্রাইব্যুনালে ১ হাজার ৬৯২টি মামলা বিচারাধীন, যার মধ্যে ১২টির বিচারকাজ চলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। উচ্চ আদালতের আদেশে বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে ৩১টির।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ দুই আইনে করা বেশির ভাগ মামলা টিকছে না। ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে গত সাত বছরে ৯৯০টির মতো মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে চার শর বেশি মামলা চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি হয়। এ ছাড়া অনেক মামলায় অভিযোগ গঠনের উপাদান না থাকায় আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, কেবল ২৫টি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। এর ২৪টি আইসিটি আইনের ও একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা অনেক বেড়ে গেছে। মামলার মধ্যে সত্যতা থাকে না, কোনো প্রমাণপত্র থাকে না, এমন অনেকে মামলা করতে চলে আসেন। অনেকে আছেন, যাঁরা অযথাই মামলা করেন।’
অনেক মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসার কারণ সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানহানিকর স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য একজন মামলা করছেন। কিন্তু মামলায় তিনি কোনো লিংক দেননি। পরে আসামি তা মুছে ফেলেন। আবার ফেসবুক থেকেও তথ্য পাওয়া যায় না। যখন কোনো তথ্য না পাওয়া যায়, তখন সেই মামলায় স্বাভাবিকভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসে। অনেকে আপসও করেন।
মামলা বেড়ে চলেছে
২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য পাঠানো মামলার সংখ্যা ছিল তিনটি। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩টি। পরের বছর মামলা আসে ১৫২টি। ২০১৬ সালে আসে ২৩৩টি। এই সংখ্যা পরের বছর দ্বিগুণের বেশি, ৫৬৮টি। ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি ও চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারের জন্য আসা মামলার সংখ্যা ২৯৬টি। অর্থাৎ সাত বছরের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচারের জন্য আসা মোট মামলা ২ হাজার ৬৮২টি।
মামলা বেড়ে যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ প্রমাণিত না হওয়া প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করার অধিকার মানুষের আছে। ভুল বুঝে মামলা করুক, সত্য বুঝে মামলা করুক, সেখানে তো আমরা হাত দিতে পারব না। মামলা গ্রহণ করার এখতিয়ার কোর্টের। কোর্ট যদি মনে করেন এটা ঠিক না, তাহলে খারিজ করে দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘যেসব মামলা নেওয়ার মতো না, সেটা কিন্তু আদালত খারিজ করে দিচ্ছেন। আর সঠিকভাবে তদন্ত হচ্ছে বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হচ্ছে।’
বেশি মামলা ২৫ এবং ২৯ ধারায়
২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হয়। ওই বছরের তিনটি মামলাই ছিল আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায়। পরের বছরের ৩৩টি মামলার মধ্যে ২৫টি মামলাই ছিল ৫৭ ধারায়। ৫৭ ধারা বাতিল করে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর এ আইনে করা বেশির ভাগ মামলা হচ্ছে ২৫ ও ২৯ ধারায়। সাইবার ট্রাইব্যুনালে সারা দেশ থেকে বিচারের জন্য আসা ৩৩০টি মামলার মধ্যে দুই শটির বেশি হয়েছে ২৫ ও ২৯ ধারায়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী, ওয়েবসাইটে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শন, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করা, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করা, মিথ্যা বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য তথ্য প্রচার করা অপরাধ। আর ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রচার করা ২৯ ধারার অপরাধ।
আর আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা ছিল, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তা হবে একটি অপরাধ।’
৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর সরকার ওই ধারাসহ আইসিটি আইনের পাঁচটি ধারা বিলুপ্ত করা হয়। নতুন আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য আইনটির ২৫, ২৯ ধারাসহ মোট ৯টি ধারা সংশোধন করার জোর দাবি জানায় সম্পাদক পরিষদসহ গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন।
৫৭ ধারাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় বিভিন্ন আসামির পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি মতপ্রকাশের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। মামলা হওয়ার মতো উপাদান নেই তারপরও মামলা করা হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এই আইন মানুষকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
অধিকাংশ মামলায় যখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়ে যায়, তখন ধরে নিতে হবে অপরাধ হওয়ার মতো উপাদান ছাড়াই মামলাটি করা হয়েছে। এখানে আইনে সংশোধনী আনতে হবে। তাতে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে বাদীর বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে মামলা করার বিধান যুক্ত করতে হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মামলা করার অধিকার নেই
দণ্ডবিধি কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মিথ্যা মামলা করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আইনি প্রতিকার পেতে পারেন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মিথ্যা মামলার শিকার কোনো ব্যক্তি আইনি প্রতিকার পাচ্ছেন না। কারণ, মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, অধিকাংশ মামলায় যখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়ে যায়, তখন ধরে নিতে হবে অপরাধ হওয়ার মতো উপাদান ছাড়াই মামলাটি করা হয়েছে। এখানে আইনে সংশোধনী আনতে হবে। তাতে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে বাদীর বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে মামলা করার বিধান যুক্ত করতে হবে। তা না হলে এ আইনে আসামি হয়ে মানুষ ভুক্তভোগী হতে থাকবে। সূত্র- প্রথম আলো