কুমিল্লায় আট বছর বয়সী এক শিশু হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় বিচারিক (নিম্ন) আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এ মামলার একমাত্র আসামি হুমায়ুন কবির ১৬ বছর ধরে কারান্তরীণ থাকার পর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আসামির করা জেল আপিল (মঞ্জুর) করে মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের ভার্চ্যুয়াল আপীল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে জেল আপিলের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ বি এম বায়েজিদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।
আইনজীবী এ বি এম বায়েজিদ সাংবাদিকদের বলেন, ২০০৪ সালে করা এ মামলায় শিশুর বাবাসহ ১২ জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সাক্ষীই বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য দেয়নি।
আসামি পক্ষের আইনজীবীর দাবি, মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব, অসামঞ্জস্যতা ও নানা ত্রুটির কারণেই হুমায়ুন কবিরকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। এ রায়ের ফলে আসামির বিরুদ্ধে অন্য কোন মামলা না থাকলে তার মুক্তিতে কোনো বাধা নেই।
মামলার অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, শিশুটির লাশ উদ্ধারের সময় সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও) উপস্থিত ছিলেন। অথচ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিচারের সময় সাক্ষ্য ও জেরা করা হয়নি।
এছাড়া মামলার একমাত্র আসামি হুমায়ুন কবির তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, শিশুটি তার খালাতো বোনের মেয়ে। আর শিশুটির বাবা তার সাক্ষ্যে বলেছেন, হুমায়ুন কবিরকে তিনি চেনেন না। এছাড়া মামলায় শিশুর মাকে সাক্ষী করা হয়নি। মাকে সাক্ষী করলে হয়তো জানা যেত, হুমায়ুন কবির আদৌ তাদের পরিচিত কেউ কিনা। ফলে এখানে সন্দেহ রয়েই গেছে। তাছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী দুই শিশুকে এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। তাদের সাক্ষ্যে যথেষ্ট অসামঞ্জস্য ছিল।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুটির মাথার খুলি ভাঙা ছিল। আর স্বীকারোক্তিমূলক জানবন্দিতে আসামি বলেছেন, শিশুটিকে তিনি মুখ চেপে ধরে হত্যা করেন। ফলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় অমিল আছে।
এজাহারে শিশুটির চাচা মো. জসীম উদ্দিনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, হুমায়ুন কবির আমার ভাতিজিকে বাড়ি পৌঁছে না দিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কোনো নারী ও শিশু পাচারকারীর কাছে বিক্রি করে দেয়, অথবা আটকে রাখে। পরে এ ঘটনায় লাকসাম থানায় ২ জুলাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে পুলিশ।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ৩০ জুন লাকসামের কনকশ্রী গ্রামের সাকেরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী বেলা সোয়া ১০টার দিকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু স্কুল ছুটি হওয়ার পরও বাড়ি ফিরে না আসায় স্কুলে খোঁজ করে তার অভিভাবকরা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে শিশুটি স্কুলে যায়নি। এরপর আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি ও সম্ভাব্য স্থানে তাকে খুঁজে না পেয়ে ওই দিনই থানায় সাধারণ ডয়রি (জিডি) করেন শিশুটির চাচা জসীম উদ্দিন।
ওই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির প্রত্যক্ষদর্শী দুই শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়ার পথে মাথা ব্যথায় শিশুটিকে সাকেরা গ্রামের মাস্টার বাড়ির পাশে কালভার্টের উপর শুয়ে পড়তে দেখেন। এ সময় আরও ৫-৬ জন লোক ছিল সেখানে। ওই সময় হুমায়ুন কবির এসে সবাইকে তাড়িয়ে দিতে থাকেন। প্রত্যক্ষদর্শী দুই শিক্ষার্থী যাওয়ার সময় শিশুটিকে বাড়ি যেতে বললে হুমায়ুন কবির শিশুটির মামা পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি শিশুটিকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। কিন্তু হুমায়ুন কবির বাড়ি পৌঁছে দেননি।
পরে এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থার আবেদন জানিয়ে লাকসাম থানায় এজাহার দায়েরের পর ওই বছরের ২ জুলাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে পুলিশ। ওই বছরের ৪ জুলাই ট্রাকচালক হুমায়ুন কবিরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই দিনই কালভার্টের পাশে জঙ্গলের ভেতর থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ এ মামলার অভিযোগপত্র দেয়। পরে ২০০৬ সালের ৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এইচ এম মোস্তাক আহমেদ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে হুমায়ুন কবিরকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। রায়ের পর পরই মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাতে অনুমতি চেয়ে আবেদন) হাইকোর্টে আসে। ওই বছরই জেল আপিল করেন আসামি। মামলার ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল শুনানির পর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রায় দেন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ১৫ এপ্রিল জেল থেকে আপিল আবেদন (জেল পিটিশন) করেন হুমায়ুন কবির। পরে ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল আবেদনটি আপিল হিসেবে গ্রহণ করে সর্বোচ্চ আদালত।
জেল আপিলের শুনানির পর মঙ্গলবার হুমায়ুন কবিরকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ। এ হত্যাকাণ্ডের দায়ে ২০০৪ সালে গ্রেফতারের পর ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারেই আছেন হুমায়ুন কবির।