দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার মধ্যেও মাগুরা জেলা জজ আদালতে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করলেন দায়িত্বরত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াউর রহমান। সম্ভ্রম রক্ষায় প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে কলেজপড়ুয়া একটি মেয়েকে ‘কল্প’ নামে অভিহিত করে তিনি ২৮ সেপ্টেম্বর সোমবার একটি মামলার রায় ঘোষণা করেছেন।
দেশের বিচার ব্যবস্থায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কিংবা বিচারপ্রার্থীর নিজ নামের পরিবর্তে প্রতীকী নামে রায় ঘোষণার ইতিহাস এটিই প্রথম বলে জানা গেছে।
অশ্লীল ছবি সংরক্ষণ এবং প্রচারের অভিযোগে ২০১৭ সালে কল্প’র দায়েরকৃত মামলার আসামি যুবায়ের হোসেনকে দোষী সাব্যস্ত করে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ জরিমানার অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভিকটিম প্রাপ্ত হবে বলে নির্দেশনা দিয়েছেন বিচারক।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, জুবায়ের হোসেন দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় কল্প’র সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর এক পর্যায়ে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে সে মেয়েটির ব্যক্তিগত কিছু ছবি নিজ মোবাইল ফোনে ধারণ করে। বিষয়টি জানতে পেরে কল্প তার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানে। এ অবস্থায় ধারণকৃত এসব ছবি মুছে ফেলা হয়েছে জানিয়ে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালায় জুবায়ের। কিন্তু তাতেও রাজি না হওয়ায় সে মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ছবিগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে। এ অবস্থায় কল্প ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট থানায় বিচার চেয়ে মামলা করেন।
এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ওয়াজেদা বেগম বলেন, পুলিশি তদন্তের পর সাক্ষ্য-প্রমাণাদি শেষে বিচারক জিয়াউর রহমান সোমবার আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে এ মামলায় যুগান্তকারী একটি রায় দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় এ ধরনের রায়ের কোনো নজির না থাকায় বিচারক ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের ছদ্মনাম ‘নির্ভয়া’র একটি মামলা এবং ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত দুইজন আসামির প্রকৃত নামের পরিবর্তে ‘এন ওয়ান’ এবং ‘এইচ ওয়ান’ অভিহিত করে রায় প্রদানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন।
আলোচিত এ মামলাটির আসামি পক্ষের আইনজীবী শফিকুজ্জামান বাচ্চু বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাধীনতা চর্চায় উন্নত দেশের তুলনায় আমরা পশ্চাৎপদ অবস্থানে। ব্রিটেন আইন করে ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ধর্ষণসহ যৌন অপরাধে ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ নিষিদ্ধ। আমাদের দেশেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ১৪ ধারা অনুযায়ী ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ পায় এমন কিছু প্রকাশ নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ মানছে কেউ মানছে না। এ অবস্থায় ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ না করে রায় প্রদানের ঘটনা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। তবে মামলার রায়ে তিনি সন্তুষ্ট নন বলে উল্লেখ করেন।
মাগুরা মহিলা পরিষদের সভানেত্রী মমতাজ বেগম বলেন, আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় বাস করি যেখানে যৌন সংক্রান্ত অপরাধে অপরাধীর চেয়ে ভিকটিম নারীকেই বেশি করে দোষারোপ করা হয়। সমাজ তার গায়ে এমনভাবে কালিমা লেপন করে দেয় যেন সব দোষ তার। কেবল সে নারী বলেই। এতে সামাজিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েও নারী এক ঘরে হয়ে পড়ে। সে নিজে অপরাধ না করেও লজ্জা, গ্লানি এবং তথাকথিত সমাজের ধিক্কার নিয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেয়।
তিনি জানান, এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাগুরার আদালত ওই সব নারীর সম্মান রক্ষায় অবস্থান নিয়েছেন। পরিচিত নামের পরিবর্তে ভিন্ন নামে অভিহিত করে রায়টি দেয়া হয়েছে। এজন্য মাগুরার আদালতকে সাধুবাদ দেয়া যায়।
সূত্র- যুগান্তর