এ এন এম ইব্রাহিম খান: গেলো ১লা অক্টোবর ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত ৩০তম আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবস। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল “Pandemics: Do They Change How We Address Age and Ageing?” প্রবীণ হিতৈষী সংঘ বাংলাদেশ শাখা একে বাংলায় ব্যাখ্যা করেছে এভাবে- “বৈশ্বিক মহামারীর বার্তা, প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা”।
প্রতি বছর প্রবীণ হিতৈষী সংঘ কেন্দ্রীয় অফিসসহ সারা দেশের ৫৯টি জেলা শাখায় যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি উদযাপন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এ বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রবীণ দিবসের সকল কর্মসূচি স্থগিত ছিল।
প্রবীণ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সর্ব প্রথম যে সত্যটি চোখের সামনে প্রতিভাত হয় তা হল বার্ধক্য, জরা এবং অসহায়ত্ব। বার্ধক্যকে কেউ এড়িয়ে চলতে পারবে না। বার্ধক্যের স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতেই হবে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন কিছুটা শক্ত অবস্থানে থাকলেও অর্থনৈতিক কারণে কখনও কখনও পারিবারিক বন্ধনে শিথীলতা দেখা যায়।
আজকের নবীন আগামী দিনের প্রবীণ উক্তিটা উল্টো করে বললে দাঁড়ায়, আজকের প্রবীণ বিগত দিনের নবীন। অর্থাৎ যারা আজ প্রবীণ, তাঁরাও এক সময় তারুণ্য ও যৌবনের উদ্দীপনায় উদ্বেলিত ছিল। সময়ের ব্যবধানে মানুষ পৌঢ়ত্ব বরণ করে নেয়, এটাই সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম।
প্রবীণ জনগোষ্ঠী এ সমাজ ও জাতিরই অংশ। আজকের প্রবীণ লোকটিই একদিন তাঁর সমস্ত শক্তি সামর্থ দিয়ে দেশের এবং পরিবারের চাহিদা মেটাতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সুতরাং বার্ধক্যে উপনীত হয়ে তিনি যখন সকল কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ভেতর একটা হতাশা কাজ করে। এ সময় একটু সহানুভূতি, মমত্ববোধ হয়তো তাঁকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দিতে পারে।
কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণদের জন্য পৃথক করে আলোচনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়নি, কারণ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অুনযায়ী বড়দের সর্বদা সম্মান ও দেখাশুনা করার স্বাভাবিক নিয়ম প্রতিটি পরিবারে পরিলক্ষিত হত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে ভূমি সংকট, বাসস্থান সংকট, জীবিকার তাগিদে পরিবারের সদস্যদের নগরমুখী অবস্থান প্রভৃতি অন্যতম।
বাস্তবতার নিরীখে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য দেশের প্রতিটি উপজেলায় বৃদ্ধাশ্রম প্রয়োজন সেটা যেমন সত্য, সে সাথে এটাও বেদনাদায়ক যে, সন্তান-সন্ততি সব থাকার পরও একদিস যে মা-বাবা নিজেদের সবকিছু দিয়ে সন্তান মানুষ করেছেন সে সন্তান যখন মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, তার মত দুর্ভাগা আর কে হতে পারে! বৃদ্ধ মা-বাবাকে বোঝা নয় বরং সৃষ্টিকর্তার পরম আর্শিবাদ মনে করতে হবে। বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিজের সাথে রাখলেও কেউ যেন গর্ব করে এই কথটা না বলে যে, “আমার মা-বাবা আমার সাথে থাকেন” বরং বলা উচিত যে, “আমি আমার মা-বাবার সাথে থাকি”।
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রবীণদের একটি অন্যতম প্রধান সংগঠন। প্রবীণদের সমস্যা চিহ্নিত করা ও তাঁদের সুযোগ-সুবিধা এবং স্বাস্থ্যগত সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে আজ খেকে অর্ধশত বছর আগে ১৯৬০ সালের ১০ই এপ্রিল ঢাকার ধানমন্ডিস্থ নিজ বাস ভবনে দেশের প্রথিতযশা চিকিৎসক ও মানবদরদী ব্যক্তিত্ব অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম এমআরসিপি ডিগ্রীধারী প্রফেসর অব মেডিসিন অধ্যক্ষ ডাঃ এ, কে, এম, আবদুল ওয়াহেদ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ নামক এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এ সংগঠনের সাথে দেশের বহু প্রথিতযশা পেশাজীবি, বুদ্ধিজীবি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, বিচারপতি, শিক্ষক এবং নানান পেশার মানুষ সংশিষ্ট হন এবং এর অগ্রগতি তরান্বিত করেণ। সারা দেশে এ যাবত ৫৯ টি জেলায় এর শাখার মাধ্যমে প্রবীন জনগোষ্ঠীর কল্যানে এ সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের ঘোষণা এবং জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩ অনুযায়ী যাদের বয়স ৬০ বছর বা এর বেশী তাঁদেরকে প্রবীণ বলা হয়েছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সারাবিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৮ ভাগ, সেটি এ শতাব্দীর শুরুতে ১১ ভাগ ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০৫০ সাল নাগাদ শতকরা ২২ ভাগ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বের এ প্রবীণ বৃদ্ধির হারকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বাংলাদেশ। বিআইডিএস এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪.৯৮ শতাংশ ছিল প্রবীণ জনগোষ্ঠী, ২০০১ সালে যা দাঁড়ায় ৬.১০ শতাংশ, ২০১৩ সালে যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ শতাংশ এবং এই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০২৫ ও ২০৫০ সালে যা দাঁড়াবে যথাক্রমে ১১ শতাংশ ও ২০ শতাংশ। অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ হবে প্রবীণ। জীবন মানোন্নয়ন, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসকরণের জন্যই আমাদের দেশে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রবীণদের এ বৃদ্ধির হারকে সমস্যা হিসেবে না ধরে যথাযথ উদ্যোগ নিলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে মূল্যবান জন সম্পদে পরিণত করা যাবে সহজেই।
বর্তমান সরকার প্রবীণদের জন্য কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাতাপিতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ এবং ষার্টোধ্ব সকল ব্যক্তিকে সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণাসহ জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা প্রণয়ন। প্রবীণ নীতিমালার আলোকে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুত সকল সুবিধার দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
পরিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান প্রবীণদের সম্মান করুন, দেশ গড়ায় তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান, তাদেরকে করুনা নয়, ভালবাসুন। প্রবীণরা দেশের বোঝা নয়, সম্পদ। প্রবীনের যুক্তি আর নবীনের শক্তি- এ দু’য়ে মিলেইতো সমাজের মুক্তি।
এ এন এম ইব্রাহিম খান: আইনজীবী, ঢাকা জজ আদালত।