দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না মন্তব্য করে একটি রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছে, জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার করে দুর্নীতির মূল উৎপাটনের সময় এসেছে। পাশাপাশি বিচার বিভাগের দুর্নীতি রোধে করণীয় সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন, লেখা কম আসা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে আদালত।
পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে একটি রিট মামলার রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
চার ব্যক্তির আবেদনে সাড়া দিয়ে ঢাকার কাকরাইলের সাড়ে ১৬ কাঠা জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ১৯৯৫ সালে ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত যে রায় দিয়েছিল, তাকে কল্পিত, জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক বলেছে হাইকোর্ট।
আড়াই দশক আগের ওই রায়ের বিরুদ্ধে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের করা রিট আবেদন মঞ্জুর করেছে উচ্চ আদালত। সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিচারক, বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিষয়ে সতর্ক করে রায়ে বলা হয়েছে, “মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন, তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। তারা হতাশ হন, ক্ষুব্ধ হন, ক্রুদ্ধ হন, বিক্ষুব্ধ হন এবং বিকল্প খুঁজতে থাকেন। তখনি জনগণ মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মাফিয়া নেতাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাদের বিচার সেখানে চান।”
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না।…বিচার বিভাগ ব্যর্থ হলে জনগণ বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হবে, যেটি কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং এখন সময় এসেছে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার করে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা। নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের দুর্নীতি এক সাথে চলতে পারে না। বিচার বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে আইনের শাসন বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি বাস্তবে কখনোই রূপ লাভ করবে না।”
দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশে অনেক সম্পত্তি পরিত্যক্ত বলে চিহ্নিত হয়। এসব সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা, নিষ্পত্তির ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তি) আদেশ জারি করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশর প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিংবা সামরিক অভিযানে নিয়োজিত ছিল এমন ব্যক্তি বা যে ব্যক্তি বাংলাদেশে উপস্থিত নেই বা ব্যক্তির নাম পরিচয়-ঠিকানা জানা নেই বা সম্পত্তি যে ব্যক্তির দখল-তত্ত্বাবধান, ব্যবস্থাপনায় নেই, এমন ব্যক্তির সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় আদেশ।
এই আদেশের ২৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ৮ মে বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (জমি, ভবন ও অন্যান্য সম্পত্তি) বিধিও জারি করেন। এই বিধি অনুযায়ী পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলতে ‘বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি (নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও নিষ্পত্তি) আদেশের আওতায় যে কোনো প্রকারের নির্মিত কাঠামো ও জমিসহ ভবন (দালান/ইমারত) ও এসবের প্রয়োজনীয় সংলগ্ন অংশ, কৃষিজমি, উদ্যান (বাগান জমি) ও অকৃষি জমিসহ জমি ও বছরের যে কোনো এক সময় জলমগ্ন জমি এবং এ ধরনের জমি থেকে উদ্ভূত সুবিধাদিসহ জমিকে বোঝানো হয়।
পরে ১৯৮৫ সালে ‘পরিত্যক্ত বাড়ি (সম্পূরক বিধানাবলী) অধ্যাদেশ’ নামে একটি সম্পূরক অধ্যাদেশ জারি করে সরকার।
এ অধ্যাদেশ জারির পর ১৯৮৮ সালে কে এ এম আশরাফ উদ্দিন কাকরাইলের ৫৬/৫৭ হোল্ডিংয়ের ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৬),লুৎফুন্নেছা রহমান চার কাঠা (বাড়ি নং-৫৬/১) এবং ১৯৮৯ সালে এ কে এম ইদ্রিস হোসেন তালুকদার ও তার স্ত্রী জামিলা খাতুন সাড়ে ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৭) জামির মালিকানা দাবি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে সেগুলো বাতিল চেয়ে সেগুনবাগিচার সেটেলমেন্ট আদালতে আবেদন করেন।
আবেদনকারীরা সবাই দাবি করেন, তারা ১৯৭৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তারারাম জয়সুরিয়া ওরফে চিও রতন ওরফে তারারাম মুচির কাছ থেকে এই জমি কিনেছেন।
আবেদনে তারা উল্লেখ করেন, তারারাম মুচির কাছে থেকে কেনা ওই জমিতে বসবাস করা অবস্থায় ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ উল্লেখ করে ১৯৮৮ সালে ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড’ তাদের নোটিশ দেয়।
আবেদনকারীদের সে নোটিশের জবাব সন্তুষ্ট হয়ে এবং বোর্ডের ‘জয়েন্ট সার্ভে টিম’ কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জামির মালিকানা দাবিকারীদের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
পরে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত চারটি আবেদনই একসঙ্গে নিষ্পত্তি করে রায় দেয়। রায়ে আবেদন মঞ্জুর করা হয়। অর্থাৎ পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে ওই সব সম্পত্তি বাদ দেওয়া হয়।
সেটেলমেন্ট আদালতের এ রায় চ্যালেঞ্জ করে ২৫ বছর পর সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত বছর হাই কোর্টে দুটি রিট আবেদন করে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করে।
আবেদনকারীদের সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পিত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পরে চূড়ান্ত শুনানি করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ রুল যথাযথ ঘোষণা করে গত বছর ১১ ডিসেম্বর রায় দেয়।
১৪৪ পৃষ্ঠার সে পূর্ণাঙ্গ রায়টিই গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. আশরাফুল কামাল। তাতে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি রাজিক-আল-জলিল।
বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে খবর-প্রতিবেদন কম আসায় তার সমালোচনাও করা হয়েছে রায়ে। বিচারক বলেছেন, “আমাদের সমাজে, বুদ্ধিজীবী মহলে, পত্র-পত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য খবর, প্রতিবেদন লেখা বা ছাপা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ বিচারকদের (নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত) কীভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট প্রতিবেদন, লেখা বা গবেষণা দেখা যায়নি।
আদালত বলেন, “বিচার বিভাগের সকল বিচারকদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হলে প্রথমেই দুর্নীতিবাজ বিচারকদের চিহ্নিত করে দ্রুততার সাথে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।”
বিচার বিভাগের দুর্নীতি বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে বসার তাগাদা দিয়ে রায়ে বলা হয়, “দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ গড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে বসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করতে হবে।”
পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে আবেদনকারীদের সম্পত্তি বাদ দিয়ে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর রায়টি দিয়েছিল বিচারক মূসা খালেদের নেতৃত্বাধীন ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত।
ওই রায় নিয়ে হাই কোর্ট বলেছে, “তারারাম যে এসব সম্পত্তির মালিক ছিলেন সেটেলমেন্ট আদালতের রায়েই তা প্রমাণ হয়নি। সেটেলমেন্ট আদালত কল্পিত রায় প্রদান করেছেন যা জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক। অত্যন্ত দুঃখজনক আমরা এমনটি অবলোকন করলাম, প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত এ রকম গুরুত্বপূর্ণ জনগণের সম্পত্তির বিষয়ে প্রচণ্ড রকম দায়িত্বহীনতার পরিচয় প্রদান করেন।”
রায়ে বলা হয়, ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি তারারাম মুচির দখলে থাকলে অবশ্যই বিদ্যুৎ, পানির বিল বা পৌরকর থাকত। কারণ সম্পত্তিটি ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে। অথচ তারারাম মুচির মালিকানার পক্ষে কোনো প্রকার দালিলিক বা মৌখিক সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়নি। কিন্তু মূসা খালেদের নেতৃত্বাধীন প্রথম সেটেলমেন্ট আালত কোনো প্রকার দালিলিক এবং মৌখিক সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই আবেদনকারীদের আবেদনের বর্ণনার ভিত্তিতে তারারাম মুচিকে এমিনিয়া তাঁতির ওয়ারিশ ও উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছেন।
আদালত আরও বলেন, “মূসা খালেদের নেতৃত্বে তৎকালীন প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং জালিয়াত চক্রকে দালিলিক এবং সাক্ষ্য ব্যতিরেকে হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি জালিয়াত চক্রের হাতে তুলে দিয়েছেন।”
এই কাজের মাধ্যমে তৎকালীন প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত বিচার বিভাগের মর্যদাহানি করেছে উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়, “দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই যখন জালিয়াত চক্র দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়ে যায় তখন জনগণের কাছে যে বার্তা পৌঁছায় তা হল, বিচার বিভাগ জালিয়াত, ঠক, বাটপার এবং অর্থ বিত্তশালীদের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য নয়।”
রায়ে বলা হয়েছে, “হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি, জনগণের সম্পত্তি প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই জালিয়াত, ঠগ, বাটপার এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের হাতে তুলে দিয়েছেন।”
এর ব্যাখ্যায় রায়ে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত সব পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র সমর্থনকারী ব্যক্তিদের। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করেছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে গিয়ে সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
“পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিকরা যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে সেহেতু তারা এবং তাদের বংশধররা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সুতরাং কেউ যদি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে সম্পত্তি প্রত্যাহার করতে সেটেলমেন্ট আদালতে আসে তাহলে আদালত প্রথমেই তার কাছ থেকে আইন মোতাবেক যেটি প্রমাণ হিসেবে চাইবেন তা হল, সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী বাংলাদেশের দুই লক্ষ মা-বোনের ধর্ষণকারী কিংবা তাদের সহযোগী নন, ৩০ লক্ষ শহীদের হত্যাকারী বা তাদের সহযোহী নন, কোনো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার পঙ্গুত্বের জন্য তিনি দায়ী নন এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর ছিলেন না” বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র- বিডিনিউজ