খতিয়ান কি
খতিয়ানের অর্থ হল “জমির হিসাব”। ভূমি জরিপকালে ভূমি মালিকের মালিকানা নিয়ে যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয় তাকে “খতিয়ান” বলে। খতিয়ান প্রস্তত করা হয় মৌজা ভিত্তিক। আমাদের দেশে সিএস, এসএ, আরএস (CS,SA,RS) এবং সিটি জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। এসব জরিপকালে ভূমি মালিকের তথ্য প্রস্তত করা হয়েছে তাকে “খতিয়ান” বলে। যেমন সিএস (CS) খতিয়ান, আরএস (RS) খতিয়ান।
সাধারণভাবে স্বত্ব সংরক্ষণ ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে জরীপ বিভাগ কর্তৃক প্রত্যেক মৌজার ভূমির মালিক বা মালিকগণের নাম, পিতা অথবা স্বামীর নাম, ঠিকানা, হিস্যা (অংশ) এবং তাদের স্বত্বাধীন দাগসমূহের নম্বরসহ ভূমির পরিমাণ, শ্রেণী, এদের জন্য দেয়া খাজনা ইত্যাদি বিবরণসহ ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে যে স্বত্ব তালিকা বা স্বত্বের রেকর্ড প্রস্তুত করা হয় তাদের প্রত্যেকটি কে খতিয়ান বলা হয় এবং উক্ত রেকর্ডকে স্বত্ত্বের রেকর্ড বা রেকর্ড অব রাইটস (ROR) বলা হয়। এক বা একাধিক দাগের সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিমাণ ভূমি নিয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তির নামে স্মরনীয় বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যে ভূমি স্বত্ব প্রস্তুত করা হয় তাকে “খতিয়ান” বলে।
ভূমি জরিপকালে খসড়া খতিয়ান সংশোধন
ভূমি জরিপের সময় রেকর্ড প্রস্ততকালে কয়েকটি ধাপ পার করতে হয়। যেমন: ১. খানাপুরী ২. বুঝারত ৩. তসদিক ইত্যাদি। এই সবগুলো ধাপ যখন পার হয়ে যায় তখন খসড়া খতিয়ান প্রকাশ করা হয় একে খসড়া প্রকাশনা (Draft Publication) বা সংক্ষেপে ডিপি (DP) বলা হয়। অত্র প্রকাশিত খসড়া খতিয়ানে কোন ভুল থাকলে যেমন: নামের ভুল, অংশ বসানোর হিসেবে ভুল, দাগ সূচিতে ভুল, ম্যাপের সংঙ্গে রেকর্ডের ভুল, জরিপকালে পিতার মৃত্যুর কারনে সন্তানদের নামে সম্পত্তি রেকর্ড হবার কথা থাকলেও জরিপ কারকদের ভুল বা অজ্ঞাত কারনে তা মূল প্রজা বা পিতার নামে রেকর্ড হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
খতিয়ান বা খসড়া খতিয়ানে কোন ভুল-ত্রুটি থাকলে বা এ সম্পর্কে কারও কোন আপত্তি বা দাবি থাকলে, প্রজাস্বত্ব বিধি ৩০ অনুযায়ী আপত্তি দাখিল করতে হবে, অত্র আপত্তি দাখিল করতে হবে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফরমে ৪০ টাকার কোর্ট ফি দিয়ে আপত্তি দায়ের করতে হবে। অফিসার প্রয়োজন মনে করলে খতিয়ান ও নকশা সংশোধন, পরিবর্তন বা পূর্বাবস্থায় বহাল রাখার বিষয়ে রায় প্রদান করবেন এবং অবশ্যই রায় মোতাবেক রেকর্ড সংশোধন করবেন। আপত্তি কেসের রায়ে যদি কেউ অসন্তুষ্ট হয় তবে সেই প্রেক্ষিতে তিনি প্রজাস্বত্ব বিধিমালার ৩১ বিধি অনুসারে রায় প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত ফরমে ও নির্ধারিত ফি প্রদান করে সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট আপিল করতে পারেন। আপীল আবেদনের সাথে আপত্তি কেসের রায়ের কপি দাখিল করতে হবে। সেটেলমেন্ট অফিসার বা তার মনোনীত অন্যকোন আপিল অফিসার সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে নোটিশ প্রদান করে শুনানীর মাধ্যমে দ্রুত আপিল নিষ্পত্তি করবেন। সর্বশেষ আপিল রায় মোতাবেক খতিয়ান ও নকশা সংশোধন করা হয়।
চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ড বা খতিয়ানের ভুল সংশোধনের পদ্ধতিঃ মামলা করে চুরান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ড বা খতিয়ানে যদি ভুল থেকে থাকে তা সংশোধন করা যায়।
ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলার মাধ্যম
২০০৪ সালে স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫১ সংশোধন করে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল ও ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। অত্র আইন অনুযায়ী ভূমি জরিপ রেকর্ডে ভুল-ত্রুটি হলে জমির মালিক প্রতিকার পেতে এই ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারেন। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৪৫(A) ধারার ৬ উপধারা অনুসারে, চূড়ান্ত রেকর্ডের গেজেট প্রকাশের তারিখ হতে পরবর্তী ১ (এক) বছরের মধ্যে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কর্তৃক ল্যাণ্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যায়। যদি কেউ অন্যকোন কারনে ১ বছরের মামলা করতে না পারেন তবে এই আইনের ১৪৫ (A ) ধারার ৭ উপধারা অনুসারে, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে বিলম্বের কোন বিশেষ কারণ জানালে এবং ট্রাইব্যুনালে তা গ্রহণ করলে মামলা করার জন্য পরবর্তী আরো ১ (এক) বছর অর্থাৎ চূড়ান্ত রেকর্ডের গেজেট প্রকাশের তারিখ হতে পরবর্তী মোট ২ (দুই) বছরের মধ্যে মামলা করতে পারবে।
আপিল
ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালের রায়ে যদি কারো কাছে গ্রহণীয় মনে না হয় বা যদি মনে করেন এখানে কোন জালিয়াতি বা ভুল হয়েছে তখন সে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৪৫ (B) ধারার ৬ উপধারা অনুসারে, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের যেকোন রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ রায় প্রদানের পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যায়।
এই আইনের ১৪৫ (B) ধারার ৭ উপধারা অনুসারে, ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইবুনালে আপিল করতে বিলম্বের কোন বিশেষ কারণ জানালে এবং ট্রাইবুনাল তা গ্রহণ করলে আপিলের সময় উত্তীর্ণের পরবর্তী আরো ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে অর্থাৎ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের রায় প্রকাশের তারিখ হতে পরবর্তী মোট ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে আপিল করা যায়। আপিল ট্রাইব্যুন্যাল গঠিত না হলে এক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে আপিল করা যাবে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে আবেদনের মাধ্যমে
সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে আবেদন করলে স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০ (The State Acquisition and Tenancy Act, 1950) এর ৪৩ ধারা মতে, এবং প্রজাস্বত্ত্ব বিধিমালা, ১৯৫৫ এর বিধি ২৩ এর উপবিধি (৩) অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত রেকর্ডের করনিক ভুল (Clerical Mistake) সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা (Revenue Officer) নিজেই সংশোধন করতে পারেন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবেদনের প্রেক্ষিতে বা প্রজাস্বত্ত্ব বিধিমালা ১৯৫৫ এর ২২ বিধির উপবিধি (১) অনুযায়ী খতিয়ানে দৃষ্ট করনিক ভুল সংশোধনের জন্য প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর পূর্ববর্তী জরিপের কাগজপত্র, প্রাথমিক খাজনা বিবরণী, কালেক্টরের দপ্তরে সংরক্ষিত খতিয়ানের কপি এবং ২ নং রেজিস্টার পর্যালোচনা ক্রমে এবং তিনি যে ধরনের অনুসন্ধান প্রয়োজন মনে করেন, তা করে এরূপ করনিক ভুল সংশোধনের নির্দেশ দেবেন।
দেওয়ানী আদালতে মামলার মাধ্যমে
ভূমি জরীপ চলাকালে খতিয়ানে কোন প্রকার ভুল হলে খতিয়ান সংশোধনের জন্য দেওয়ানী আদালতে মামলা করা যায় না এমনকি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করার সময় থাকলেও দেওয়ানী আদালতে মামলা করা যায়না। যখন ট্রাইব্যুনাল মামলার সময়সীমা পার হয়ে যায় তখন অনেকেই হতাশায় পড়ে যান। কিন্তু এই সময়সীমা পার হবার পরেও দেওয়ানী আদালতে রেকর্ড সংশোধনের মামলা করে সংশোধন করে নিতে পারেন। এই মামলাকে ঘোষণামূলক মামলাও বলা হয়। এই মামলা করতে হয় জমির মূল্য অনুযায়ী সহকারী জজ আদালতে, সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে। এমনকি সরকারি সম্পত্তি খতিয়ানে ভুলে কোনো ব্যক্তির নামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে সরকারকেও খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে হবে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নজির হল- ‘খতিয়ান সংক্রান্ত স্বত্বের প্রশ্নে একমাত্র দেওয়ানি আদালতই সিদ্ধান্ত প্রদান করতে পারে’। (১৫ ডিএলআর ৪৮৩)
খতিয়ান সংশোধন করতে যেসব কাগজপত্র লাগবে
আমাদের দেশে বেশীর ভাগ জনগণের জমি থাকেল ও জমির সকল কাগজপত্রগুলো নিজের কাছে গুছানো থাকেনা কিন্তু যখন জমি নিয়ে ঝামেলায় পড়ে তখন এই কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে নানা রকম ঝামেলায় পরে যায় বা এসব গোছাতে গোছাতে মামলা করতে দেরী হয়ে যায়। কোন জমি নিয়ে মামলা করার প্রয়োজন থাক বা না থাক নিম্ন কাগজগুলো প্রত্যেক জমির মালিকের কাছে রাখা উচিত
- উক্ত জমিতে মালিকানার সকল দলিলপত্র (যেমন: মূল দলিলের সার্টিফাইড কপি, বায়ানা দলিল, পূর্বের খতিয়ানের কপি)
- চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত ভুল রেকর্ডের কপি আইডি কার্ডের ফটোকপি এ সমস্ত কাগজপত্র।
খতিয়ান হচ্ছে দখলের প্রামাণ্য দলিল, মালিকানার দলিল নয়, খতিয়ানে মালিক ছাড়া অন্য কারো নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে যেমন সেই ব্যক্তির মালিকানা সৃষ্টি হয় না তেমনি প্রকৃত মালিকের মালিকানা স্বত্বও নষ্ট হয় না। তাই নিজের মালিকানা জমির খতিয়ান যদি অন্যকারো নামে হয়ে যায় তাতে ভয় পাবার কিছু নেই বা আতংকিত হবার কিছু নেই যে আমার জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে আমি কি এই জমি মালিকানা পাব না। কিন্তু খতিয়ান সংশোধনের অব্যশই করতে হবে। খতিয়ান সংশোধন না করলে জমির নামজারি (Mutation) করা যাবে না, আর মিউটেশন (Mutation) না করতে পারলে জমি বিক্রয় করা যাবে না।
রীনা পারভিন মিমি : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। Email- rinaparvinmimi18@gmail.com