শফিকুল ইসলাম: বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা যেন একটি রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন টিভি স্ক্রিনে বা পত্রিকার পাতা উল্টালেই শুধু ধর্ষণের খবর। গতকালের কোন পৈশাচিক ঘটনা চাপা পড়ে যায় আজকের নতুন আরো বড় কোন নির্মম পৈশাচিক ঘটনার সামনে। মানুষ রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বইছে প্রতিবাদের ঝড়। অথচ এমন প্রতিবাদমুখর অবস্থাতেও ধর্ষণ কিন্তু থেমে নেই। আন্দোলন মিছিল সভা সমাবেশ থেকে দাবি করা হচ্ছে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষণের সাজা মৃত্যদণ্ড রয়েছে, যেমন ধারা ৯(২) ধর্ষণের পর হত্যা অথবা ধারা ৯(৩) অনুসারে দলবদ্ধ ধর্ষণ কারা হলে এবং এর ফলে ভিক্টিম আহত বা নিহত হলে তবেই কেবল মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে তবে এসব ক্ষেত্রেও যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি। তবে এই অপরাধ দেশে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার জনদাবির মুখে সরকার ধর্ষণের শাস্তি সংশোধন করে মৃতুদণ্ড করতে যাচ্ছে বলে বেশ কিছু গণমাধ্যমের মাধ্যমে গানা গেছে। একদিকে যদিও খবরটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বস্তিদায়ক। তবে শুধুমাত্র আইন সংশোধণে কতটা কাজ হবে সন্দেহ থেকেই যায়।
প্রথমত, অপরাধটি নির্মূল করতে হলে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। “কেন ধর্ষণ হয়”- এই প্রশ্নের জবাবে দেশের একেক শ্রেণির মানুষ একেক রকম উত্তর দেয়। তবে খুবই অবাক করা বিষয় হচ্ছে বেশীরভাগ আলোচনাকারী/উত্তরদাতা এই প্রশ্নের উত্তরে অথবা আলোচনায় যেকোন একটি বিষয়কেই প্রাধান্য দিতে চান। অথচ ধর্ষণ কেন হয় এই প্রশ্নটির উত্তর একটি কারণে মধ্যে আবদ্ধ নয়। কেউ হয়তো বলছে পোশাক, কেউবা পুরুষের মানষিকতা, আবার কেউ বলছে পর্ণগ্রাফি কিংবা সমাজে বিয়ে কঠিন হয়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন নারীর পোশাককে দায়ী করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে তাহলে শিশু ধর্ষণের কারণ কি? কিংবা মাঝ বয়সী অথবা বৃদ্ধা নারীর নির্যাতিত হওয়ার পিছনে কি কারণ? আবার যখন পুরুষের মানষিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসে তখন আবার মনে প্রশ্ন জাগে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ এর পক্ষে বিপক্ষে থাকা নানান যুক্তি নিয়ে। আসলে ধর্ষণের কারণ একটি নয় বরং অসংখ্য কারণ আছে ধর্ষণ ঘটার পিছনে। তবে ভুলটা হচ্ছে যেকোন একটি কারণকেই প্রধান বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা।সকল ধর্ষণের ঘটনা একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট বা নিয়ম মেনে ঘটে না। অনেকে বলেন শুধুমাত্র পুরুষের নোংরা মানষিকতা এর জন্য দায়ী। তাহলে প্রশ্ন আসে আমাদের দেশের পুরুষদের এমন নোংরা মানষিকতা কিভাবে হল। একদিনেই কি তৈরী হয়ে গেল এমন মানষিকতা? এর উত্তর অবশ্যই না। বর্তমানে যারা তরুণ কিংবা একটু বয়স্ক তারা সিনেমা চলচিত্রে দেখছে যে নায়িকাকে নানাভাবে বিরক্ত করে, সারাক্ষণ পিছে পিছে ঘুরঘুর করে (ইভটিজিং) করে নায়িকার মন পায় নায়ক, আর ধর্ষণ করার মাধ্যমে ভিলেন প্রতিশোধ নেয় ইত্যাদি। সব জায়গায় নারীদের ভোগ্যপণ্য বা লালসার বস্তুরূপেই দেখানো হয়েছে। এছাড়াও পশ্চিমা বিনোদন জগতে সবসসময় নারী মানেই কামনা লালসার বস্তু এটাই পুরুষদের শিখিয়েছে এবং শিখাচ্ছে, নারীদেরকে কামনাময়ী, যৌন উদ্দীপকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর আরো নোংরা দিক হল ব্লুফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি। এই সব বিকৃত পরিবেশের মধ্যে বড় হওয়া একজন পুরুষের মানষিকতা কত ভাল হবে বলে পাঠক মনে করেন অথবা কি করে ভাবেন যে তার চোখে নারীরা সম্মানিত হবে? এরসাথে এখন যোগ হয়েছে বিচারে দীর্ঘ কালক্ষেপন, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দায় এড়ানো যাবে এমন সব চিন্তাভাবনা ও সম্ভাবনা।
বাংলাদেশে বেশীরভাগ মানুষের মনে একটা ধারণা ব্যাপকভাবে বদ্ধমূল আছে যে বিচার শুধু ধনীদের জন্য এবং ক্ষমতাবানদের শাস্তি দেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না। দুঃখজনকভাবে এই ধারণাটি দিনকে দিন আরো পাকাপোক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে অনেকে আবার সামাজিক সম্মানের কথা চিন্তা করে মামলা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। যারা অন্যায়ের বিচার পেতে সাহস করে মামলা করেই বসে তাদেরও শিকার হতে হয় অজস্র সমস্যার। সমাজের নীতিবোধহীন মোড়লদের রক্তচক্ষু ও মীমাংসার চাপ, ভিলেজ পলিটিক্স, শত্রুতার ভয়ে সাক্ষ্য দিতে না চাওয়া, অনিশ্চিয়তা, হুমক-ধামকি, মামলার সীমাহীন খরচ আর সর্বোপরি দীর্ঘসূত্রতা সব মিলিয়ে একসময় বাদী আপোষ নামক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আবার আদালত থেকে রায় একেবার হলেই যেতা কার্যকর হবে সেটাও নিশ্চিত নয়। কেননা বিভিন্ন কারণে রায় কার্যকর স্থগিত, মওকুফ হওয়ার সুযোগ আছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন অপরাধে ২০১৯ সালে মাত্র ২টি মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে তবে বিভিন্ন অপরাধে মৃতুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে ৩২৭টি এবং ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে মোট মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে ২০৬৮ জনকে কিন্তু কার্যকর হয়েছে মাত্র ৩০টি।
আইনের শিক্ষার্থী হওয়ায় জুরিসপ্রুডেন্সে চারধরণের শাস্তি দেখতে পাই। এরমধ্যে একটি হল Deterrence punishment অর্থাৎ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। মৃত্যুদণ্ড মূলত এই শ্রেণীর শাস্তি। এটা এমন একধরণের শাস্তি যার ফলে সমাজের অন্যরা এথেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং অন্যায় করা থেকে বিরত থাকে। আমাদের দেশে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হচ্ছে কিন্তু এর ফলে সমাজে তেমন প্রভাব পড়ছে না। এর বড় কারণ হল বিচার ব্যবস্থা ও শাস্তি কার্যকরে অতি গোপনীয়তা। চাঞ্চল্যকর কোন ঘটনা না হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি তেমন একটা প্রচার হয় না বরং রাষ্ট্র তথাকথিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনার ভয়েই হোক বা অন্য যেকোন কারণেই হোক মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়গুলো তেমন একটা প্রচার করে না।
অন্যদিকে একটা মামলা এত দীর্ঘ সময় নিয়ে চলতে থাকে যে অনেক সময় আসামী জামিনে বের হয় এরপর সমাজে স্বাভাবিক চলাফেরা করে তখন সমাজের অন্যদের কাছে বার্তা যায় যে অপরাধ করার শাস্তি কয়েকদিন জেল এরপর সব ঠান্ডা। আবার অনেক সময় দীর্ঘকাল মামলা চালাতে না পেরে বাদী আপোষ করে মামলা তুলে নেয় অথবা হাল ছেড়ে দেয়, এটাও সমাজে নেতিবাচক বার্তা দেয় ও অপরাধ করতে উৎসাহ দেয়। আর সবচেয়ে বড় যে বিষয় হচ্ছে একটি মামলা এত দীর্ঘকাল চলে যে সমাজের অন্যরা ভুলেই যায় ঘটনার ব্যাপারে। তাই এত দীর্ঘকাল পর কোন সাজা হলেও এমনকি মৃত্যুদণ্ড হলেও সেটি মানুষের মাঝে খুব আলোচিত হয় না কারণ ততদিনে অন্য মানুষেরা সেই ঘটনার কথা অনেকটাই ভুলে গেছে এবং ততদিনে তারা আরো শত শত পৈশাচিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেছেন এবং নতুন ঘটনার বিচারের দাবিতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আছেন।
একটা কথা আছে, “justice delayed is justice denied’’ আমাদের দেশে যে দীর্ঘসুত্রিতা তা কখনোই ন্যায় বিচারের জন্য উপযুক্ত না। আর এমন দীর্ঘকাল চলা বিচারে যে শাস্তিই হোক তা কিভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে? অন্যদিকে ধর্ষণ রোধে মানুষের নৈতিকতার গুণগত উন্নয়ন, চারিত্রিক উন্নয়ন এবং বিচার বিভাগকে শক্তিশালী ও দ্রুততর করার তেমন কোন উদ্যোগই চোখে পড়ছে না। তাই সরল মনে প্রশ্ন জাগে “মৃত্যুদণ্ড কি ধর্ষণ থামাতে পারবে?”
শফিকুল ইসলাম: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।